ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বৃষ্টির পূর্বাভাস নেই আবহাওয়া অধিদফতরে

কাঠফাটা রোদ আর তাপপ্রবাহে পুড়ছে দেশ

প্রকাশিত: ১১:০৭, ১৩ মে ২০১৯

 কাঠফাটা রোদ আর  তাপপ্রবাহে পুড়ছে দেশ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ প্রায় এক মাস ধরে তাপপ্রবাহে পুড়ছে সারাদেশ। বায়ুমন্ডল ও মাটি এখন প্রচন্ড উত্তপ্ত। তীব্র গরমে অতিষ্ঠ জনজীবন। বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ বেশি থাকায় আরও বেশি অসহনীয় হয়ে পড়ছে। ব্যাহত হচ্ছে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। খা খা করছে মাঠ প্রান্তর। ঘরে বাইরে সব খানেই অস্বস্তিকর পরিস্থিতি। শহর, বন্দর ও গ্রামে চিত্রও একই। বৃষ্টিতে প্রশান্তি পেতে উদগ্রীব মানুষ। তবে আগামী কয়েকদিনের মধ্যে দেশজুড়ে বৃষ্টির কোন খবর দিতে পারছে না আবহাওয়া অফিস। তীব্র গরম অনুভূত হওয়ার পেছনে উপউষ্ণমন্ডলীয় চাপবলয়ের ভূমিকা রয়েছে। উপসাগর থেকে দখিনা বাতাস ও জলীয়বাষ্প আসতে বাধা দিচ্ছে একটি উপউষ্ণমন্ডলীয় চাপবলয়, যা পুবালী ও পশ্চিমা বাতাসের মিলন হতে দিচ্ছে না। পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে বায়ুমন্ডলের নানা উপসর্গ। বায়ুমন্ডলে নেই প্রয়োজনীয় অস্থিরতা। পুবালী বাতাস ও পশ্চিমা বাতাসের সংযোগ হলেই সৃষ্টি হবে মেঘ, ঝরবে বৃষ্টি। অধিদফতরের পূর্বাভাসে আজ সোমবারও তাপপ্রবাহ নতুন নতুন এলাকায় বিস্তার লাভ করার খবরে অস্বস্তিতে পড়েছে দেশবাসী। এ সময়ে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও বেড়েছে। হিটস্ট্রোকের বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। আবহাওয়াবিদরা জানান, দেশের বায়ুমন্ডল এবং মাটি এখন প্রচন্ড উত্তপ্ত। এ অবস্থায় উচ্চ চাপ বলয়ের শক্তি কমে গেলে এবং বঙ্গোপসাগর থেকে জলীয়বাষ্প ভেসে এলে তীব্র কালবৈশাখী এবং টর্নেডো হতে পারে। ভূমধ্যসাগরে সৃষ্ট পশ্চিমা লঘুচাপ হিমালয়ের গা বেয়ে পূর্বদিকে বিস্তৃতি হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এর সঙ্গে পুবালী লঘুচাপের সংযোগ এবং পশ্চিমবঙ্গের শুকনো হাওয়া মিলেমিশে তৈরি করে বজ্র মেঘ। এই বজ্র মেঘই কালবৈশাখী হয়ে লন্ডভন্ড করে দেয় সমগ্র চরাচর। বাংলাদেশ এপ্রিল ও মে মাসে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকে। এ সময় তীব্র গরমের পরপরই আধ ঘণ্টার ব্যবধানে ঝড়ো আবহাওয়া তৈরি হয়। প্রাক বর্ষা মৌসুমে তাপমাত্রা বেশি থাকায় কালবৈশাখীর দাপটও থাকে বেশি। তারা আরও বলেন, বর্তমানে পুবালী বাতাস ও পশ্চিমা বাতাসের সংযোগ ঘটছে না। এ সব কারণে দেশে খরা পরিস্থিতি চলছে। কালবৈশাখী ঝড়ও হচ্ছে না। জলীয়বাষ্প আসতে না পারায় মেঘ সৃষ্টি হচ্ছে না, বৃষ্টিও হচ্ছে না। সূর্যের কিরণকাল বাড়ছে। এটা আগামী জুনের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। সূর্য রশ্মি এখন তীর্যকভাবে পড়ছে আমাদের অঞ্চলে। বাতাসে জলীয়বাষ্প কম থাকার কারণে অসহনীয় হয়ে পড়ছে। বাতাসে আর্দ্রতা কম থাকায় ঘাম ঝরছে কম। বিশ্ব উষ্ণায়নের পাশাপাশি বেশি সংখ্যক বহুতল ভবন, কাচের তৈরি ভবন, বন উজাড় ও গাছপালা না থাকাটাও দায়ী ঢাকার তীব্র তাপমাত্রার পেছনে দায়ী। ভ্যাপসা গরম অনুভূত হওয়ার বিষয়ে আবহাওয়াবিদরা বলেন, দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা খুব বেশি না। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা এখনও ৩৮ ডিগ্রী সেলসিয়াসের নিচে রয়েছে। আর রাজধানীর তাপমাত্রা রেকর্ড হচ্ছে ৩৬ ডিগ্রী সেলসিয়াসের কম। দিনভর টানা প্রখর রোদ, সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পার্থক্য হ্রাস এবং ভূপৃষ্ঠ উত্তপ্ত থাকার কারণেই ভ্যাপসা গরম অনুভূত হচ্ছে। জনদুর্ভোগ ॥ বৈশাখের শেষ দিন আজ মঙ্গলবার। কাঠফাটা রোদ আর লু হাওয়ার মতো তাপপ্রবাহ দেশবাসীর দুর্ভোগের মাত্রা বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। পথচারীরা যেন আগুনের হল্কা ছুয়ে চলাফেরা করে। ঘন ঘন লোডশেডিং দুর্ভোগের মাত্রা আরও বাড়াচ্ছে। অনেক হাসপাতাল ও ক্লিনিকে নিয়মিত জেনারেটর চালানোর ব্যবস্থা না থাকাতে চিকিৎসাধীন রোগীদের দুর্ভোগ বেড়ে গেছে। খোলা জায়গায় কাজ করছে এমন শ্রমিকদের কষ্টের যেন শেষ নেই। এদিকে তীব্র গরম, লোডশেডিং ও ওয়াসার দুর্গন্ধযুক্ত পানি অতীষ্ঠ করে তুলেছে রাজধানীবাসীর জীবন। প্রখররোদ উপেক্ষা করেই চলতে হয় পথচারীদের। নগরীর পাবলিক পরিবহনে উঠতে হলে এক প্রকার তুমুল প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হয়। তার ওপর আবার বাসগুলোর অতিরিক্ত যাত্রী উঠানোর স্বভাব। এত অস্বাভাবিক গরমে পরিবহনগুলোর ভেতরের ঘেষাঘেষি পরিবেশে অস্থির হয়ে ওঠে যাত্রীরা। এমন খরতাপ পরিবেশে যানজটে আটকে গেলে যাত্রীদের দুর্ভোগের যেন সীমা থাকে না। প্রখর রোদ উপেক্ষা করে পরিবহনের অপেক্ষায় অনেক যাত্রীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। দুর্বিষহ রোদে জর্জরিত মানুষের কাছে বেড়ে যায় ঠান্ডা পানীয়ের চাহিদা। তৃষ্ণা মেটাতে রাস্তাঘাট থেকে আখের রস, রং ও বরফ মিশ্রিত শরবত এবং খোলা আকাশের নিচে ধুলোবালি মিশ্রিত তরমুজ, পেঁপে ও কাঁচা আমের আচার কিনে খাচ্ছে মানুষ। নিয়মিত বিদ্যুত না থাকার কারণে রিফ্রিজারেটরগুলোতে রাখা খাদ্যদ্রব্য তীব্র গরমে নষ্ট হয়ে তৈরি করছে জীবাণু। দুপুরে আবহাওয়া গরম হবে তা কিন্তু ভোরের দিকে বোঝা যাচ্ছে না একেবারেই। ঘড়ির কাঁটা সাড়ে আটটা পেরোতেই বদলে যাচ্ছে পরিস্থিতি। উধাও হাওয়া। ঘড়ির কাঁটা ৭টা ছুঁতেই তীব্র তাপপ্রবাহ বইতে শুরু করে। আর দশটার পর থেকে তা তো আগুনের হল্কা পুড়িয়ে দিচ্ছে চামড়া। অবশ্য তার সঙ্গে মাঝে মধ্যে শরীর ছুঁয়ে যায় শুকনো বাতাস। কিছুক্ষণ পরপর পানি ছিটিয়েও শাক সবজি সতেজ রাখতে পারছে না কাওরানবাজারের বিক্রেতা মোঃ হাসান। পলিথিনের ছাউনির নিচে বেগুন, পটলসহ কয়েক প্রকারের শাক সবজি সাজানো রয়েছে। তিনি জানালেন, তীব্র তাপে শাক সবজি খুব তাড়াতাড়ি শুকিয়ে চ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছে। বারবার পানি ছিটিয়েও সতেজ রাখতে পারছি না। চ্যাপ্টা হতে দেখলে ক্রেতারা কিনতে চান না। বড় বিপদে আছি। তপ্ত রোদ উপেক্ষা করেও আগুনে পোড়ানো রড পিটিয়ে চলেছেন কাওরানবাজারের কামার কৈলাস বাবু। আগুনের হলকায় কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকলেও এবারের তীব্র তাপপ্রবাহের কাছে হার নেমেছেন তিনি। কৈলাস বাবু জানান, অসহ্য গরমের মধ্যে কাজ করছি। তাপপ্রবাহ চলে যেতে এবার দীর্ঘ সময় নিচ্ছে। আগুনের সঙ্গী আমরা। আমরা যদি এমন কথা বলি তবে অন্যদের কি অবস্থা হবে তা বুঝতেই পারছি। ব্যবসার কথা ভেবে কুমার কৈলাস বাবু কাজ করলেও রোদের মধ্যে সাত রাস্তা মোড়ে যেতে রাজি নন রিক্সাচালক সাইফুল মিয়া। ওয়াসা ভবনের পাশে রিক্সা দাঁড় করিয়ে বিশ্রাম নিতে চান তিনি। সাইফুল মিয়া অলসের সুরে জানালেন, ভাই, কিছুক্ষণ আগে নাবিস্কো থেকে আসলাম। গরমের মধ্যে অনেক পথ ঘুরতে গিয়ে কাহিল হয়ে গেছি। ভাগ্যে যা থাকে, শরীর ঠান্ডা না হলে বের হবো না। শুধু রিক্সচালক সাইফুল মিয়া নন, দাবদাহে অতীষ্ঠ হয়ে উঠেছে সারাদেশ। এদিকে এমন অবস্থায় হিটস্ট্রোক ও ডায়রিয়ার বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। গত বছর এমন সময়ে হিটস্ট্রোকে অনেক মানুষের মৃত্যু ঘটে। এ বছরও ইতোমধ্যে কয়েকজনের মৃত্যৃ ঘটেছে। রাজধানীতে ইতোমধ্যে তাপমাত্রার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নতুন করে ডায়রিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে। তাপমাত্রা বাড়লে ডায়রিয়ার জীবাণুগুলোর সংক্রমণের ক্ষমতা বেড়ে যায়। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডায়রিয়ামুক্ত থাকতে পানি ফুটিয়ে খেতে হবে। আর হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার আগেই সতর্ক থাকতে হবে। দীর্ঘক্ষণ রোদে থাকা যাবে না। অতি প্রয়োজন না হলে রোদ এড়িয়ে চলতে হবে। রোদে কাজ করার সময় মাথা ও শরীরে ঢাকনা দেয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে। প্রচুর পরিমাণ তরল জাতীয় কিছু খেতে হবে। ঢিলাঢালা পোশাক বিশেষ করে সুতি কাপড় পরিধান করতে হবে। হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হলে তাকে ছায়াচ্ছন্ন স্থানে শুইয়ে দিতে হবে। ঠান্ডা পানি (রেফ্রিজারেটরের পানি নয়) নিয়ে শরীর মুছে দিতে হবে। এতে উন্নতি না হলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
×