ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ঈশ্বরদীতে এবার লিচুর বাম্পার ফলন

প্রকাশিত: ০৯:৩৯, ১২ মে ২০১৯

ঈশ্বরদীতে এবার লিচুর বাম্পার ফলন

তৌহিদ আক্তার পান্না, ঈশ্বরদী ॥ লিচুর রাজধানী হিসেবে দেশ-বিদেশে সুপরিচিতি পেয়েছে ঈশ্বরদী। এক পৌরসভা আর সাত ইউনিয়নের সব স্থানে লিচু চাষ দিনে দিনে বেড়েই চলছে। এ কারণে প্রতিবছর চাষীরা আখসহ অন্য আবাদ কমিয়ে লিচু চাষে ঝুঁকে পড়ছেন। এবারও ঈশ্বরদীতে ২০ হেক্টর জমিতে লিচুর আবাদ বেড়েছে। কোন কোন এলাকায় প্রচ- খরতাপে কিছু লিচু ফেটে যাবার খবর পাওয়া যায়। তার পরও এবার লিচুর ভাল ফলনে চাষীর মুখে হাসি ফুটেছে। তারা আশাবাদী, এবার লিচু বিক্রি করে অতিরিক্ত লাভবান হবেন। এখন প্রতিটি বাগানে বাতাসে দোল খাচ্ছে থোকায় থোকায় হালকা লাল সবুজ রঙের আঁটি লিচু। বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদকপ্রাপ্ত অভিজ্ঞ লিচু চাষী আব্দুল বারী ওরফে কপি বারী,লিচু বাগান মালিক বরকত আলী, এ্যাডভোকেট হেদায়েত উল হক ও ব্যাপারী রহমত আলীসহ অনেকেই সাংবাদিকদের কাছে একই আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। তারা বলেছেন,বর্ষণ কম হওয়ায় এবং আবহাওয়া ভাল থাকায় এবার ঈশ্বরদীতে লিচুর বাম্পার ফলন হয়েছে। আমার তিনটি বাগান মিলে দেড় শ’ লিচু গাছ রয়েছে। প্রত্যেকটি গাছেই ভাল ফলন হয়েছে। এবার কমপক্ষে ৬/৭ লাখ টাকার লিচু বিক্রি করতে পারব বলে মনে হচ্ছে। এখানে উৎপাদিত লিচু ঢাকাসহ দেশের প্রায় সব জেলাতেই পাঠানো হয়। সকল এলাকায় এর চাহিদাও রয়েছে। সব চেয়ে আশার কথা হলো, ঈশ্বরদীতে উৎপাদিত কিছু পরিমাণ লিচু যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ক্যানাডা, মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নানাভাবে নিয়ে যাওয়া হয়। লোকমুখে শোনা যায়, সেসব দেশেও ঈশ্বরদীতে উৎপাদিত লিচুর সুনাম রয়েছে। জয়নগরের লিচু চাষী রবিউল ইসলাম জানান, আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় লিচুর ফলন ভাল। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত পরিবেশ ভাল থাকলে এবার ১২/১৩ লাখ টাকার লিচু বিক্রির আশা করছেন। একই গ্রামের লিচু চাষী কেএম পান্না জানান, আমার তিনটি বাগানেই এবার ভাল ফলন হয়েছে। তবে প্রচ- তাপমাত্রায় কিছু আঁটি লিচুর ক্ষতি হচ্ছে। তারপরও এবার অন্তত ১৫ লাখ টাকার লিচু বিক্রির আশা করছি। ঈশ্বরদীর অতিরিক্ত কৃষি কর্মকর্তা রোকসানা কামরুন্নাহারের মতে, গত মওসুমে ঈশ্বরদীতে বিক্ষিপ্তভাবে ৪ হাজার হেক্টর জমিতে লিচু আবাদ হয়েছিল। অতিবৃষ্টির কারণে আগাম কুশি বের হয়ে ফলনেরও ক্ষতি হয়েছিল। ফলে গত মৌসুমে প্রায় ৩শ’ কোটির স্থলে ১৬৫ কোটি টাকার লিচুর আবাদ কম হয়েছিল। এবার চাষীরা সেসব প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে কাটিয়ে ফলন বৃদ্ধিরও চেষ্টা করেছেন। সে কারণেই এবার এখানে কয়েক মৌসুমের চেয়ে অতিরিক্ত পরিমাণ লিচু উৎপাদন হবে বলে চাষীরা আশা করছেন। ঈশ্বরদীতে আবাদকৃত লিচুর মধ্যে আঁটি লিচু, চায়না-তিন চার, বেদানা, বোম্বাই লিচু উল্লেখযোগ্য। ঈশ্বরদীর সাহাপুর, ছলিমপুর, দাশুড়িয়া, মিরকামারী, ছিলিমপুর, জয়নগরসহ প্রায় সকল এলাকাতেই মাটির উর্বরতার কারণে লিচু সুস্বাদু ও উন্নতমানের হয়ে থাকে। অন্যান্য এলাকার চেয়ে এখানকার লিচু দেশী-বিদেশী সকল ধরনের ক্রেতার কাছে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। মৌসুমের শুরুতেই ব্যবসায়ীরা দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এসে আগাম বাগান কিনে নিজের সন্তানের মতো পরিচর্যা করায় প্রতিটি বাগানেই বাম্পার ফলনের অবস্থা এখন পর্যন্ত বিরাজ করছে। পৌর এলাকাসহ ঈশ্বরদীর বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, সুস্বাদু ফল ও বেশি দামের কারণে প্রায় বাড়ির আঙ্গিনায় লিচু গাছ লাগিয়ে সবুজের গ্রামও সৃষ্টি করা হয়েছে। লিচু যাতে ঝড়ে না পড়ে সেজন্য গাছের গোড়ায় নিয়মিত পানি,সার ও গাছে স্প্রে করা হচ্ছে। ঈশ্বরদী কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আব্দুল লতিফ বলেন, এবারও বিক্ষিপ্তভাবে ৪ হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে লিচুর আবাদ হয়েছে। লিচুর দাম বেশি হওয়ায় প্রত্যেক বছরই এখানে পেশাদার লিচু চাষীর বাইরেও কিছু কিছু মানুষকে লিচু চাষ করতে দেখা যাচ্ছে। এবার ঈশ্বরদীতে ২০ হেক্টর বেশি জমিতে লিচুর আবাদ করা হয়েছে। অভিজ্ঞ লিচু চাষী ও ব্যবসায়ীদের মতে, চলতি মৌসুমে অন্তত সোয়া তিন শ’ কোটি টাকার লিচু উৎপাদন হবে ঈশ্বরদীতে। ঈশ্বরদীতে এ মৌসুমে মোট প্রায় সাড়ে ৩ লাখ গাছের মধ্যে শতকরা ৯০ ভাগ গাছে লিচুর উৎপাদন ভাল হয়েছে। এতে ঈশ্বরদী এলাকায় এবার ৯৬শ’ কৃষক চার হাজারের অধিক হেক্টর জমিতে লিচুর আবাদ করে প্রায় সাড়ে ৩শ’ কোটি টাকার লিচু উৎপাদনের আশা করছেন। কৃষি বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, সাড়ে ৩ লাখ গাছে গড়ে ৮ হাজার করে মোট ২শ’ ৮০ কোটি লিচু উৎপাদনের আশা করা হচ্ছে। এবার লিচু চাষী, লিচু বাজারজাতকরণের সঙ্গে জড়িত ব্যাপারী, লেবার,পরিবহন মালিক, টুকরি, ডালি প্রস্তুতকারী ও আড়ৎদারদের আর্থিক লাভের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এবার কাউকেই কর্মবিমুখ হয়ে পড়তে হবে না। ছাব্বিশ বছরের রেকর্ড ভঙ্গ করে গত মৌসুমের বৈশাখ জ্যৈষ্ঠে অনাকক্সিক্ষত অতিরিক্ত বৃষ্টি হওয়ায় সৃষ্ট প্রকৃতির বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় লিচু উৎপাদনে ধস নেমে লিচু চাষী, বাজারজাতকরণের সঙ্গে জড়িত ব্যাপারী, লেবার, পরিবহন মালিক ও আড়ৎদাররাও আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছেন। এ মৌসুমে ঈশ্বরদী এলাকায় প্রাকৃতিক পরিবেশ ঠিক থাকলে,সার, কীটনাশকের দাম সহজলভ্য এবং কৃষি বিভাগের সহযোগিতা পেলে বেশি লিচু উৎপাদন ও বাম্পার ফলনের মাধ্যমে লিচু চাষী, ব্যাপারী, লেবার ও আড়ৎদারদের অবস্থার পরিবর্তন হবে বলে আশা করেন স্থানীয় লিচু চাষী। লিচু উৎপাদন বেশি হওয়ায় শিমুলতলাসহ লিচুর হাটগুলোর সঙ্গে জড়িতরাও আর্থিকভাবে লাভবান হবেন।
×