ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

এটি হবে ট্রাইব্যুনালের ৩৮তম রায়

আরপি সাহা ও ছেলে ভবানী সাহাসহ ৭ হত্যা মামলার রায় শীঘ্রই ॥ যুদ্ধাপরাধী বিচার

প্রকাশিত: ০৯:৩৭, ১২ মে ২০১৯

 আরপি সাহা ও ছেলে ভবানী সাহাসহ ৭ হত্যা মামলার রায় শীঘ্রই ॥ যুদ্ধাপরাধী বিচার

বিকাশ দত্ত ॥ মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত দানবীর রণদা প্রসাদ (আরপি) সাহা ও তার ছেলে ভবানী প্রসাদ সাহাসহ ৭ জনকে হত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধে টাঙ্গাইলের মোঃ মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলার রায় ঘোষণার অপেক্ষায়। এটি হবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ৩৮তম রায়। ২০১০ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারে ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর এ পর্যন্ত আরও ৩৭টি মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে। প্রসিকিউশন পক্ষ আশা করছেন শীঘ্রই এ মামলার রায় ঘোষণা করা হতে পারে। অন্যদিকে আপীল বিভাগে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় নিষ্পত্তিতে যে জট ছিল তা দূর হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলাম এবং জাতীয় পার্টির সাবেক প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের আপীল শুনানি জন্য দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। আগামী ১৮ জুন এই দুটি মামলার আপীল শুনানির জন্য দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেয়া দন্ডের বিরুদ্ধে ২৯টি মামলা আপীল শুনানি নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বল আশাবাদ ব্যক্ত করে জনকণ্ঠকে বলেন, দানবীর রণদা প্রসাদ (আরপি) সাহা ও তার ছেলে ভবানী প্রসাদ সাহা হত্যা মামলায় উভয় পক্ষের শুনানি শেষে গত ২৪ এপ্রিল চেয়ারম্যান বিচারপতি মোঃ শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ রায় ঘোষণার জন্য সিএভি রাখা হয়েছে। আমরা আশা করছি এ মামলার রায় শীঘ্রই ঘোষণা করা হবে। গত বছর ১২ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে প্রসিকিউশন পক্ষ। ১১ ফেব্রুয়ারি অভিযোগ আমলে নেয়ার পর ২৮ মার্চ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে তার বিচার শুরুর আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল। ২০১৬ সালের ১৮ এপ্রিল মামলাটির তদন্ত শুরুর পর ট্রাইব্যুনাল থেকে পরোয়ানা জারি হলে ওই বছরের নবেম্বরে মাহবুবকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি এখন গাজীপুরের কাশিমপুরের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আছে। ২০১৭ সালের ২ নবেম্বর এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা মোঃ আতাউর রহমান। অভিযোগের মধ্যে রয়েছে, মাহবুবুর রহমান একাত্তরের ৭ মে স্বাধীনতাবিরোধীদের নিয়ে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর গ্রামে যায়। সেখানে গিয়ে তারা রণদা প্রসাদ সাহা (আরপি সাহা) এবং তার ছেলে ভবানী প্রসাদ সাহার খোঁজ করে। তাদের না পেয়ে তারা ৩৩ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। পরবর্তীতে একই তারিখে রাত ১১টার দিকে নারায়ণগঞ্জ থেকে আরপি সাহা ও ভবানী প্রসাদ সাহাসহ ৫ জনকে অপহরণ ও হত্যা করে। অন্যদিকে আসামিসহ রাজাকাররা ২৪ জন নিরীহ মানুষকে আটক করে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। তার মধ্যে ২২ জনকে হত্যা করা হয়। প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭১ সালের ৭ মে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাক হানাদার বাহিনী মির্জাপুরের সাধারণ মানুষের ওপর আকস্মিক হামলা চালিয়ে ব্যাপক গণহত্যা চালায় এবং গ্রামবাসীর বাড়িঘর লুটপাট করে। এদিন রাতে আরপি সাহাকে ও নারায়ণগঞ্জের কুমুদিনী কমপ্লেক্স থেকে তার একমাত্র ছেলে ভবানী প্রসাদ সাহা রবিকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর আর তাদের কোন খবর পাওয়া যায়নি। ১৯৭১ সালের ৭ মে ছিল শুক্রবার। মির্জাপুরে সাপ্তাহিক হাটবার। এদিন জুমার নামাজের পর স্থানীয় দালাল মওলানা ওয়াদুদের নির্দেশে ও তার দুই ছেলে মান্নান ও মাহবুবের নেতৃত্বে কিছু ধর্মান্ধ ব্যক্তি মির্জাপুর বাজারে ব্যাপক লুটপাট চালায়। একই সঙ্গে পাক হানাদার বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে মির্জাপুরের সাহাপাড়ায় হামলা চালিয়ে নিরপরাধ গ্রামবাসীকে নির্মমভাবে হত্যা করে পাশের বংশাই নদীতে ভাসিয়ে দেয়। আসামি মাহাবুর রহমানকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। প্রসিকিউটর তাপস কান্তি বল জানিয়েছেন , অপহরণ, আটকে রেখে নির্যাতন, হত্যা- গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের তিনটি ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে মাহবুবের বিরুদ্ধে। আসামির বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের তিনটি অভিযোগ এনেছিল প্রসিকিউশন। আমরা মনে করি তিনটি অভিযোগই আমরা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি। তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ এ মামলায় ১৩ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। যেসব সাক্ষ্য-প্রমাণ আমরা উপস্থাপন করেছি তাতে আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড চেয়েছি। আশা করছি শীঘ্রই এ মামলার রায় ঘোষণা হতে পারে। আজাহার ও কায়সারের আপীল শুনানি ॥ দীর্ঘদিন পরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলাম এবং জাতীয় পার্টির সাবেক প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের আপীল শুনানির জন্য প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির আপীল বেঞ্চ ১৮ জুন নির্ধারণ করেছে। আদালত এ দিন নির্ধারণ করে বলেছে , ওই দিন আজহারের আপীল মামলাটি শুনানির জন্য কার্যতালিকায় ১ নম্বরে ও কায়সারের আপীল মামলাটি কার্যতালিকায় ২ নম্বরে থাকবে। আপীল বিভাগে সর্বশেষ ২০১৬ সালের ৩০ আগস্ট মীর কাশেম আলীর মামলার রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেয়ার পর নতুন মামলার শুনানি হয়নি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেয়া দ-ের বিরুদ্ধে ২৯টি মামলা আপীল শুনানি নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ রংপুর জেলা আলবদর বাহিনীর কমান্ডার এ টি এম আজহারুল ইসলামকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করে। তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের ৬টি অভিযোগের মধ্যে হত্যা-গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, আটক, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠনের ৫টি অভিযোগই প্রমাণ হয়। এর মধ্যে ৩টি অভিযোগে ফাঁসি, ২টিতে ৩০ বছরের কারাদন্ড ও একটিতে অভিযোগ প্রমান না হওয়ায় খালাস দেয়া হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদন্ডের রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালের ২৮ জানুয়ারি আপীল করেন আজহারুল ইসলাম। সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় তার আইনজীবীরা এ আপীল করেন। আপীলে খালাস চান তিনি। মোট ৯০ পৃষ্ঠার আপীলে খালাসের পক্ষে ১১৩টি যুক্তি তুলে ধরা হয়। অন্যদিকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারকে ২০১৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর মৃত্যুদন্ড প্রদান করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৬টি অভিযোগের মধ্যে হত্যা-গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, আটক, মুক্তিপণ আদায়, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠন এবং ষড়যন্ত্রের ১৪টি প্রমাণ হয়েছে। এর মধ্যে ৭টি অভিযোগে ফাঁসি, ৪টিতে আমৃত্যু কারাদন্ড, ৩টিতে ২২ বছরের কারাদন্ড ও দুটি অভিযোগ প্রমাণ না হওয়ায় খালাস দেয়া হয়। ২০১৫ সালের ১৯ জানিুয়ারি সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় এই আপীল করা হয়।
×