ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

থ্যালাসেমিয়া জিন বহন করছে ১ কোটি ১০ লাখ মানুষ

প্রকাশিত: ১১:১১, ৮ মে ২০১৯

থ্যালাসেমিয়া জিন বহন করছে ১ কোটি ১০ লাখ মানুষ

নিখিল মানখিন ॥ থ্যালাসেমিয়া রোগীর সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি এবং এই রোগের উচ্চ চিকিৎসা ব্যয় নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। তারা বলছেন, থ্যালাসেমিয়ার জিন বহন করছে, দেশে এমন মানুষের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ। বংশগত এই রোগ নিয়ে প্রতি বছর দেশে সাত হাজার শিশু জন্ম নিচ্ছে। থ্যালাসেমিয়ার বাহকদের মধ্যে বিয়ে হলে এ রোগের বিস্তার ঘটে। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তশূন্যতা দেখা দেবে, পেটের প্লীহা বড় হয়ে যাবে, তাকে ফ্যাকাশে দেখাবে। দেশে রক্তশূন্যতাজনিত রোগ থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে। এ রোগের চিকিৎসা খুবই ব্যয়বহুল। কোন পরিবারে একজন থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হলে তার চিকিৎসা করাতে সে পরিবারটি অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হয়ে যায়। আর দরিদ্র পরিবারের পক্ষে এমন রোগীর চিকিৎসা করানো সম্ভব হয়ে ওঠে না। হাজার হাজার থ্যালাসেমিয়া রোগী ব্যয়বহুল চিকিৎসা করাতে না পেরে ধীরে ধীরে নিশ্চিত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। বাংলাদেশে সীমিত পরিসরে থ্যালাসেমিয়া রোগের চূড়ান্ত চিকিৎসা ‘বোনম্যারো প্রতিস্থাপন’ চলছে। এ পর্যন্ত প্রায় সাইত্রিশজনের বোনম্যারো প্রতিস্থাপন করানো হয়েছে। বোনম্যারো প্রতিস্থাপন চালু হলেও তা দেশের রোগীর তুলনায় একেবারে অপ্রতুল। এমন অবস্থার মধ্য দিয়ে আজ বৃহস্পতিবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের রক্তরোগবিদ্যা (হেমাটোলজি) বিভাগের প্রধান ও হাসপাতালটির বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশন ইউনিটের প্রধান এম এ খান জানান, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন ইউনিটের মাধ্যমে ব্লাড ক্যানসার, লিউকোমিয়া, থ্যালাসেমিয়া, লিম্ফোমা, সিভিয়ার এ্যাপ্লাস্টি এ্যানিমিয়াসহ জটিল রোগের চিকিৎসা করা সম্ভব হবে। সফলভাবে কর্মসূচীটি অব্যাহত রাখা গেলে রোগীরা অল্প খরচে উন্নতমানের চিকিৎসা পাবেন। তাদের আর অন্য কোথাও যেতে হবে না। ব্যয়বহুল হওয়ায় দেশের অনেক রোগী অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন করানো ছাড়াই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। ঢাকা মেডিক্যালে স্থাপিত বোনম্যারো প্রতিস্থাপন ইউনিটেরর মাধ্যমে বর্তমানে সীমিত সংখ্যক রোগীকে সেবা দেয়া সম্ভব বলে জানান অধ্যাপক এম এ খান। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, থ্যালাসেমিয়ার জিন বহন করছে দেশে এমন মানুষের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি। এ রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা সাড়ে তিন লাখ। বংশগত এই রোগ নিয়ে প্রতি বছর দেশে সাত হাজার শিশু জন্ম নিচ্ছে। থ্যালাসেমিয়ার বাহকদের মধ্যে বিয়ে হলে এ রোগের বিস্তার ঘটে। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তশূন্যতা দেখা দেবে, পেটের প্লীহা বড় হয়ে যাবে, তাকে ফ্যাকাশে দেখাবে। থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশনের মহাসচিব মোঃ আবদুর রহিম বলেন, দেশে রক্তশূন্যতাজনিত রোগ থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে। এ রোগের চিকিৎসা খুবই ব্যয়বহুল। কোন পরিবারে একজন থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হলে তার চিকিৎসা করাতে সে পরিবারটি অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হয়ে যায়। তাই বিয়ের আগে ছেলেমেয়ের রক্ত পরীক্ষা, আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে বিয়ে না করা এবং ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমেই এর প্রতিরোধ করা সম্ভব। তিনি আরও বলেন, থ্যালাসেমিয়ার বাহকদের মধ্যে বিয়ে হলে এ রোগের বিস্তার ঘটে। তাছাড়া জনসংখ্যা বৃদ্ধি, সচেনততার অভাব, অপ্রতুল চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং এ রোগ প্রতিরোধে বাস্তবমুখী কার্যক্রমের অভাবে থ্যালাসেমিয়া দেশের স্বাস্থ্যসেবার হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে। তিনি বলেন, থ্যালাসেমিয়া কোন সংক্রামক রোগ নয়। আক্রান্ত শিশুদের প্রতি দুই থেকে চার সপ্তাহ পর পর নতুন রক্ত গ্রহণ করে বেঁচে থাকতে হয়। সঠিক ও নিয়মিত চিকিৎসা পেলে থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত রোগীরা স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে পারেন। থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক ও থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত রোগী- দুটি এক জিনিস নয়। থ্যালাসেমিয়ার বাহকেরা এ রোগে আক্রান্ত নন। থ্যালাসেমিয়ার দু’জন বাহকের মধ্যে বিয়ে হলে কিংবা তাদের মধ্যে মিলনের ফলে জন্ম নেয়া সন্তানের থ্যালাসেমিয়া রোগী হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। থ্যালাসেমিয়া রোগীর বাহ্যিক কোন লক্ষণ নেই। থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তশূন্যতা দেখা দেবে, পেটের প্লীহা বড় হয়ে যাবে, তাকে ফ্যাকাশে দেখাবে। এই রোগের চিকিৎসা হচ্ছে যতদিন বাঁচবেন, ততদিন নিয়মিত নতুন রক্ত গ্রহণ করতে হবে কিংবা বোনম্যারো প্রতিস্থাপন করতে হবে। তাই সবারই উচিত, রক্তে থ্যালাসেমিয়া আছে কি না, তা পরীক্ষা করা। রোগ প্রতিরোধে থ্যালাসেমিয়ার বাহকদের মধ্যে বিয়ে বন্ধ করা দরকার। থ্যালাসেমিয়া বিশেষজ্ঞরা জানান, দেশে এখনও থ্যালাসেমিয়া রোগের চূড়ান্ত চিকিৎসা চলছে সীমিত পরিসরে। অথচ ডিএনএ এ্যানালাইসিস পদ্ধতির মাধ্যমে খুব সহজেই থ্যালাসেমিয়া রোগ নিরূপণ করা যায়। ডিএনএ শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় রক্ত উৎপাদন করে। এই ডিএনএ সুস্থ কিনা তা পরীক্ষার জন্যই এ্যানালাইসিস পদ্ধতি। এ পদ্ধতির দুটি কাজ। একটি হলো রক্ত পরীক্ষা করে থ্যালাসেমিয়া রোগ চিহ্নিত করা। এর জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির শরীর থেকে মাত্র দু’ সিসি রক্ত দরকার হয়। অন্যটি হলো গর্ভধারণনের ১০ থেকে ১৪ সপ্তাহের মধ্যে গর্ভে বেড়ে ওঠা শিশুর ভ্রƒণ থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত কিনা তা নিশ্চিত হওয়া। ভ্রƒণ থেকে কোরিয়োনিক ভিলাস নামে এক ধরনের পদার্থ নিয়ে তা আল্ট্রাসনোগ্রাম যন্ত্রের মাধ্যমে পরীক্ষা করা হয়। রোগাক্রান্ত হলে মেডিক্যাল টারমিনেশন অব প্রেগন্যান্সি (এমটিপি) করে আক্রান্ত শিশুটির জন্ম প্রতিরোধ করা সম্ভব। এ্যানালাইসিস পদ্ধতিতে মাত্র একদিনে দুটি পরীক্ষার ফলই পাওয়া সম্ভব। চিকিৎসকরা জানান, থ্যালাসেমিয়া রোগ একবার হয়ে গেলে তা আর সরানো যায় না। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর মধ্যে কেবল ভারতের দু’একটি হাসপাতালে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন করে থ্যালাসেমিয়া রোগীদের সুস্থ করে তোলা যায়। তবে এক্ষেত্রে অর্ধেক রোগীরই সুস্থ হওয়ার কোন সম্ভাবনা থাকে না। তা ছাড়া এতে ব্যয় হয় ৩০ লাখ থেকে এক কোটি টাকা। এছাড়া আক্রান্ত শিশুকে প্রতি মাসে নিয়মিত রক্ত পরিসঞ্চালন করে এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক চিকিৎসার মাধ্যমে মাত্র ১৫ থেকে ২০ বছর বাঁচিয়ে রাখা যায়। এ জন্য ওই শিশুর পেছনে বছরে ব্যয় হয় প্রায় দেড় লাখ টাকা। থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে দেশেব্যাপী সচেতনতা সৃষ্টি করার আহ্বান জানিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এমপি বলেন, এটি একটি জটিল রোগ এবং এই রোগের চিকিৎসা খুবই ব্যয়বহুল। প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা গেলে রোগীকে তাড়াতাড়ি সুস্থ করে তোলা সম্ভব। তাই এই বিষয়ে দেশব্যাপী সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালাতে হবে। থ্যালাসেমিয়া রোগীর জাতীয় রেজিস্ট্রি কার্যক্রম গ্রহণ করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। আর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থাপন করা হয়েছে বোনম্যারো প্রতিস্থাপন কেন্দ্র। বিবাহপূর্ব স্ক্রিনিং-এর মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়া রোগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ দম্পতি নির্ণয় করে বিয়ে করা থেকে বিরত থাকা উচিত। যেহেতু এই রোগের স্থায়ী প্রতিষেধক নেই তাই একটি রূপরেখা প্রণয়ন করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। সরকারের গৃহীত কর্মসূচী সঠিকভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমরা থ্যালাসেমিয়া রোগের নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ করতে পারব বলে আশা প্রকাশ করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। স্বাস্থ্য অধিদফতরেরর মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাঃ আবুল কালাম আজাদ বলেন, জরিপ করে জানা গেছে থ্যালাসেমিয়া বাংলাদেশে একটি বড় স্বাস্থ্য সমস্যা। দেশে এক কোটি ১০ লাখ মানুষ অজ্ঞাতসারে থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক। প্রতিবছর ৭ হাজার শিশু থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্ম নেয়। এই রোগে আক্রান্তের লোহিত কনিকার আয়ুষ্কাল কমে যাওয়ায় ঘন ঘন রক্ত পরিসঞ্চালনের ওপর নির্ভর করতে হয়। এটি একটি বংশগত রোগ। পরিবারের কারও এই রোগের ইতিহাস থাকলে অবশ্যই চিকিৎসকদের পরামর্শ নিতে হবে। এই রোগের প্রতিরোধের জন্য রক্ত পরীক্ষা ও সচেতনতা জরুরী।
×