ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

৩ মে, ১৯৭১

‘আমরা ক্ষমা করব না, ভুলেও যাব না’

প্রকাশিত: ০৯:০৬, ৩ মে ২০১৯

 ‘আমরা ক্ষমা করব না, ভুলেও যাব না’

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ ॥ ১৯৭১ সালের ৩ মে দিনটি ছিল সোমবার। বাংলাদেশের মুক্তিপাগল মানুষ দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত পাক ফৌজের বিরুদ্ধে চলছে মুক্তিবাহিনীর প্রচন্ড লড়াই। অস্ত্র বলে বলীয়ান পাকসেনাদের নায়ক টিক্কা খান ভেবেছিল মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ভেঙ্গে দেয়া যাবে বাঙালীর প্রতিরোধ। কিন্তু তাদের সে আশা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। প্রতিদিন বাড়ছে মুক্তিবাহিনীর শক্তি। বাংলাদেশের হাজার হাজার মানুষ যোগ দিচ্ছে মুক্তি বাহিনীতে। স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী পাক সেনাদের খতম করার চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিচ্ছে। শত্রুর কামান চিরতরে স্তব্ধ না করা পর্যন্ত থামবে না এ যুদ্ধ। কিন্তু এ ছাড়া কি অন্য কোন পথ খোলা ছিল সাড়ে সাত কোটি বাঙালী ও তাদের নেতাদের জন্য? এই দিন ঝালকাঠির কীর্তিপাশায় মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটির ওপর পাকহানাদার বাহিনী হামলা চালায়। এ আক্রমণে সিরাজ তাঁর বাহিনীকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করে মাদ্রা, শতদল কাঠি, আতা ও ভিমরুলী গ্রামে পৃথক পৃথক ক্যাম্প স্থাপন করেন। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক আবদুস সালাম মুক্তাঞ্চল থেকে এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতিদানের জন্য প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক সরকারগুলোর প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন ও সম্ভাব্য সব ধরনের সহযোগিতা দানের জন্য বিশ্বের গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের প্রতি আবেদন জানান। হেলসিংকিতে অনুষ্ঠিত সোস্যালিস্ট ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিলের সম্মেলনে গৃহীত বাংলাদেশ সম্পর্কিত এক প্রস্তাবে বিলম্বে যুদ্ধবিরতি ও একটি মীমাংসার জন্য আলোচনা শুরু করার অনুরোধ জানানো হয়। প্রস্তাবে শেখ মুজিবুর রহমানসহ রাজনৈতিক বন্দীদের অবস্থা সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশের জনগণের সাহায্যের লক্ষ্যে সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়ার জন্য জাতিসংঘের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়। সিনেটর এ্যাডওয়ার্ড কেনেডি যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে বাংলাদেশের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য জাতিসংঘের প্রতি আবেদন জানান। তিনি বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্যের জন্য ভারত সরকার যে আবেদন জানিয়েছেন, তার প্রতি সাড়া দেয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। খ-অঞ্চলের (বাংলাদেশ) সামরিক আইন প্রশাসক সাতজন ছাত্র নেতাকে ১০ মে সকাল ৮ টার মধ্যে ঢাকার উপ-সামরিক আইন প্রশাসকের সামনে হাজির হবার নির্দেশ দেয়। ছাত্র নেতারা হচ্ছে, ১. ডাকসুর সহ-সভাপতি আ.স.ম আবদুর রব, ২. ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুস মাখন, ৩. ছাত্রলীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী, ৪. ছাত্র লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ, ৫. খায়রুল আনাম খসরু, ৬. মোস্তফা মহসিন মন্টু, ৭. সেলিম মহসিন। পাকসেনারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি সভার বৈদেশিক সাহায্য বিষয়ক কমিটির এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকা সংক্রান্ত সাব কমিটির চেয়ারম্যান কর্নেলিয়াস গ্যালাঘর কলকাতায় বলেন, খোলা মন নিয়ে আমি এখানে এসেছিলাম। কিন্তু কয়েকজন শরণার্থীর সঙ্গে কথা বলার পর আমি এখন নিশ্চিত যে, পূর্ব বাংলায় অতি সাংঘাতিক মাত্রায় ত্রাস, বর্বরতা ও গণহত্যা চলেছে। জাতিসংঘে যেখানে আমার দেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে, তাদের উচিত পাকিস্তানের ওপর যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করে তাকে পরিষ্কার বুঝিয়ে দেয়া যে, এ ধরনের পরিস্থিতি বরদাস্ত করা যায় না। কোনরূপ কারণ দর্শানো ছাড়া সামরিক কর্তৃপক্ষ এক ঘোষণায় মহাখালী রেলওয়ে লেবেল ক্রসিং থেকে পুরনো ঢাকা, ক্যান্টনমেন্ট রেলওয়ে স্টেশন এবং ঢাকা-ময়মনসিংহ ডিআইটি রোডের আশপাশের বসবাসকারী সবাইকে ৫ মে’র মধ্যে উঠে যেতে নির্দেশ দেয়। পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো লাহোরে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, দেশের একাংশে সামরিক আইন বলবৎ রেখে অপরাংশে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যেতে পারে। পশ্চিম পাকিস্তানে ক্ষমতা হস্তান্তর হলে তা দেখে পূর্ব পাকিস্তানিরা সেখানে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য উন্মুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির গভীর প্রেরণা অনুভব করবে। এদিন বরিশাল থেকে এসে পাকসেনারা পিরোজপুর দখল করে নেয়। জেলা শহরের পশ্চিম প্রান্তে বলেশ্বর নদের খেয়াঘাটের কংক্রিটের সিঁড়ির ওপর দাঁড় করিয়ে বহু মুক্তিকামী মানুষকে হত্যা করেছে। পিরোজপুরের হুলারহাট বন্দরে প্রথম পাক-বাহিনীর গানবোট ভিড়ে। ধলা গ্রামবাসীর মিশনে অবস্থানের খবর পেয়ে বিকাল প্রায় ৩ টায় হঠাৎ পাক হানাদার বাহিনী নাটোরের মিশন ক্যাম্পাস ঘিরে ফেলে। তার কিছুক্ষণ পূর্বে বনপাড়া এলাকা থেকে কয়েকজন খ্রীস্টান যুবককে আটক করে নিয়ে আসে। ফাদার পিনোস ও অন্য ফাদারদের অনুরোধে হানাদার বাহিনী খ্রীস্টান বলে ছেড়ে দেয় কিন্তু মিশনের ভেতরের হিন্দুদের অবস্থান জেনে মিশনের অফিস, হোস্টেলসহ সর্বত্র তল্লাশি করে ধলা গ্রামের ২২ জনসহ অন্যান্য স্থানের আশ্রিত পরিবারের ৮৬ জন যুবক ও মধ্যবয়সী পুরুষকে আটক করে এবং সেই সঙ্গে কয়েকজন নারীকে ট্রাকে তুলে নেয়। তাদের সবাইকে রক্ষার জন্য ফাদার পিনোস-এর বার বার অনুরোধ উপেক্ষিত হয়। সেই মুহূর্তে সিস্টার কারমেলা মেজর শেরওয়ানীর পা চেপে ধরেন এবং অনেক কাকুতি-মিনতি করার পর শেষ পর্যন্ত শুধু নারীদের ছেড়ে দেয়। পাক বাহিনী ঐ দিন সন্ধ্যায় আটক ৮৬ জনকে নাটোর দত্তপাড়া সংলগ্ন ফতেঙ্গাপাড়ায় নারদ নদের সংযুক্ত খালের পার্শ্বে নিয়ে গুলি চালিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এদিকে পাক সেনাদের হুমকি ও চাপের কারণে ফাদার পিনোস আশ্রিতদের রাখার জন্য অপারগতা প্রকাশ করেন। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে রাত প্রায় ১০টায় সহায় সম্বলহীন স্বামী হারা হতভাগীরা তাদের অপ্রাপ্ত শিশু ও বৃদ্ধসহ নিরুপায় হয়ে পুনরায় মানিকপুরে ফিরে যায়। ধলাবাসীকে আশ্রয় ও সহযোগিতা করার কারণে কতিপয় পাক দোসররা মানিকপুরবাসীকে চাপ সৃষ্টি করে এবং ফিরে আসা হিন্দুদের ওপর পুনরায় ভয়ভীতি প্রদর্শন করে। গোপালগঞ্জ জেলাধীন ভাটিয়াপাড়া নামক স্থানে পাক হানাদার বাহিনীর অন্যতম ঘাঁটি ছিল। পাক হানাদার বাহিনীর এ ঘাঁটি ছিল মধুমতি ও বারাশিয়া নদীর সংগম স্থলে। সংগম স্থলের উত্তর পাড়ে আলফাডাঙ্গা উপজেলার কৃষ্ণপুর গ্রামটি অবস্থিত। পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য এ গ্রামে মুক্তিবাহিনী সদস্যগণ সংগঠিত হয় পাক বাহিনীর ঘাঁটিতে হামলা চালায়। দিনব্যাপী এ সম্মুখযুদ্ধে নূর মিয়া ও আঃ সালাম নামে ২ জন মুক্তিযোদ্ধা শাহাদৎবরণ করেন। এইদিন দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকা বাঙালী জাতির কাল রাত্রিটিকে পাকিস্তানীদের মুক্তি দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের কন্যা রইসী বেগম পাকিস্তান সামরিক জান্তার পক্ষে একটি বিবৃতি দেন। বিবৃতিটি এই দিন দৈনিক সংগ্রামের প্রথম পাতায় গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করে। ২৬ মার্চ পাকিস্তানীদের জন্য মুক্তি দিবস শিরোনাম দিয়ে রইসী বেগমের বিবৃতির উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়-১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ আমাদের সাত কোটি পাকিস্তানীদের জন্য মুক্তি দিবস শেখ মুজিবুর রহমান ও তার অনুচরেরা চিরদিনের জন্য মঞ্চ থেকে অপসারিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ’দ্য টাইম’ পত্রিকা ’মৃতের শহর ঢাকা’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করেন, ঢাকা ও অন্যান্য পূর্বপাকিস্থানী শহরে ট্যাংকবাহিনী আক্রমণ চালানোর কয়েক ঘণ্টার ভেতরে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী পূর্বপাকিস্তান থেকে সকল বিদেশী সাংবাদিক বহিষ্কার করে সেখানে চলমান গৃহযুদ্ধ ধামাচাপা দিতে দৃশ্যত সফল হয়। টাইম পত্রিকার সাংবাদিক ড্যান কগিন ও সেই সময় পূর্বপাকিস্তান থেকে বহিষ্কৃৃত হন, তবে তিনিই প্রথম আমেরিকান সাংবাদিক যিনি সম্প্রতি ভারত থেকে হোন্ডা, ট্রাক, বাস এবং সাইকেলে করে আবার যুদ্ধ শুরু হবার পর আবার পূর্বপাকিস্তানে প্রবেশ করেছেন। তিনি জানান, বর্তমানে এই শহর মৃতের শহরে পরিণত হয়েছে। সেনাবাহিনীর ট্যাংক ও স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রবহর নিয়ে নিরস্ত্র মানুষের ওপর চালানো বর্বর আক্রমণের এক মাস পর, ঢাকা শহর এখনো স্তম্ভিত, এর বাকি অধিবাসীগণ সেনাবাহিনীর কঠিন নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আতঙ্কের ভেতর শহরে আছেন। মৃতের সঠিক সংখ্যা কোনদিনও জানা সম্ভব হবে না, তবে সম্ভবত শুধু ঢাকা শহরেই প্রায় ১০০০০ নিহত হয়েছেন এবং শহরের প্রায় অর্ধেক মানুষ পার্শবর্তী গ্রামগুলোতে আশ্রয় নিয়েছেন। জনপথ ও ফেরিঘাটের ওপর থেকে সেনা অবরোধ তুলে নেবার সঙ্গে সঙ্গেই শহর থেকে জনস্রোত বাইরে বইছে। একজন বাঙালী মন্তব্য করেন, ‘আমরা সবাই জানি যে পাকিস্তান শেষ’, ‘কিন্তু পতাকা ঝুলিয়ে রেখেছি সৈন্যদের এড়ানোর আশায়।’ তবে সত্য এই যে, পূর্বপাকিস্তানের মানুষ সেনা দখলদারিত্বকে নিজেদের স্বাধীনতার পথে শুধু একটি বাধা মনে করছেন, আত্মসমর্পণ হিসেবে নয়। ‘আমরা ক্ষমা করব না, ভুলেও যাব না’, একজন বাঙালী বলেন। সবচেয়ে পাশবিক আঘাত হানা হয় পুরান ঢাকায়, সেখানে অনেক অংশই পুড়িয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হয়। সেনাবাহিনী শহরের কিছু অংশের চারদিকে পেট্রোল ঢেলে, আগুন দিয়ে ও আগুন থেকে পালানো মানুষদের পিষে ফেলে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। এক তরুণ যার বাসায় তল্লাশি হচ্ছিল, সৈন্যদের অনুরোধ করেন তারা যেন তার ১৭ বছর বয়স্ক বোনকে ছেড়ে দেয়; সৈন্যরা মেয়েটিকে বেয়োনেট খুঁচিয়ে মারে ও ছেলেটিকে তা দেখতে বাধ্য করে। আক্রমণ শুরুর দিনেই, রাত প্রায় ১:৩০টার দিকে দুই গাড়ি বোঝাই সৈন্য বাঙালী জাতির স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা, শেখ মুজিবুর রহমানের বাসায় পৌঁছে। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×