ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১

সংস্কৃতি ও রাজনীতি ॥ বিহাইন্ড দ্যা মিডিয়া

প্রকাশিত: ০৯:২৩, ১ মে ২০১৯

সংস্কৃতি ও রাজনীতি ॥ বিহাইন্ড দ্যা মিডিয়া

মিসরীয় তাত্ত্বিক সামীর আমিন বিশ্বে একচেটিয়া আধিপত্যের পরস্পর সম্পর্কিত পাঁচটি কারণ চিহ্নিত করেছেন। এক. প্রযুক্তিগত আধিপত্য। দুই. বিশ্বের ফিন্যান্স বাজারের নিয়ন্ত্রণ। তিন. পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ। চার. মিডিয়া ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর আধিপত্য। পাঁচ. গণবিধ্বংসী অস্ত্রের ওপর আধিপত্য। পুঁজিবাদী কেন্দ্রের অন্যতম শক্তিধর দেশটি বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে এ পাঁচ বলয়ের মাধ্যমে প্রায় একচেটিয়া আধিপত্য বজায় রাখছে। প্রথম তিনটি বাদ দিয়ে চার নম্বরে আসা যাক। গত দু’দশকের বেশি সময় ধরে রূপার্ট মারডক সিলভিয়া বার্লুসকোনি এবং দুই ওয়ারনারসহ হেনরি লুচে পৃথিবীময় দুর্দমনীয় গতিতে তাদের মিডিয়া সাম্রাজ্য বিস্তার করে চলেছেন। স্যাটেলাইট ও ক্যাবল নেটওয়ার্কগুলোও তাদের নিয়ন্ত্রণে। মুদ্রণ শিল্প, বেতার শিল্প, চলচ্চিত্র শিল্প ইত্যাদির ওপর নিয়ন্ত্রণ তো আছেই। সামীর আমিন উল্লিখিত পাঁচ বলয়ের চারটি মোটামুটি দৃশ্যমান হলেও মিডিয়ার প্রভাব চট করে চোখে পড়ে না। এটি কেবল রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক বিষয় নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে সাংস্কৃতিক আধিপত্যের বিষয়টিও। মূল উদ্দেশ্য শুধু ব্যবসার মধ্য দিয়ে মুনাফা অর্জন নয়, একই সঙ্গে আধিপত্যবাদী সংস্কৃতি ও মতাদর্শ ছড়িয়ে দেয়া। একে বলা যায় মিডিয়া সাম্রাজ্যবাদ। সংস্কৃতির উৎপাদন-বিনিময়- ভোগ-বণ্টনে এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ব্যবসার পাশাপাশি এবং ব্যবসাকে গতিশীল রাখতেই মিডিয়া সংস্থাগুলো পৃথিবীময় বাজারী মতাদর্শ ও মূল্যবোধ ছড়ায়। এর পৌনঃপুনিক প্রচার মানুষের মনন ও মগজেও প্রভাব বিস্তার করে। চিন্তা ও মূল্যবোধকে নিয়ন্ত্রণ করে মনোজগত গঠন করে। দেশী এবং ভারতীয় মিডিয়াগুলো বিশেষ করে টেলিভিশন মিডিয়া মানুষের মনোজগত গঠনে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। বিষয়টির ভয়াবহতা সাধারণ মানুষের চোখে হয়ত কমই পড়েছে। অনেক অনুষ্ঠান সেøা পয়জনিংয়ের মতো দর্শকের হৃদয়ে বাজারী সংস্কৃতি ঢোকাচ্ছে। ওই বিষ সাদা চোখে ধরা পড়ে না। শুধু বাজারী সংস্কৃতি নয় সামন্ত মানসিকতাও মগজের কোষে কোষে ঢুকিয়ে দিচ্ছে বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও সিরিয়ালগুলো। যা থেকে তৈরি হচ্ছে পশ্চাৎপদ মানসিকতা। যাতে ভীষণভাবে আসক্ত আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত দর্শক। এসবের মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে একটু একটু করে মানুষের মন তৈরি হয়। সেখানে নিজের ভাবমূর্তি এঁকে দেয়ার কাজ দুরভিসন্ধি পুষে রাখা রাজনীতি বিদদের পক্ষে অনেক সহজ হয়। অনেকে মনে করেন ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে ধর্মভিত্তিক দলের জয়জয়কারের পেছনে মানুষের মনোজগতের পরিবর্তন অন্যতম ভূমিকা রেখেছে। চিন্তাকে প্রভাবিত করার কাজটি মিডিয়া খুব কৌশলের সঙ্গে করে। নোয়াম চমস্কি তাঁর এক লেখায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উঁচু পর্যায়ের চব্বিশটি বৃহৎ মিডিয়া সংস্থার আধিপত্যের কথা বলেছেন। যারা নিজেরাই অনেক বড় মুনাফাভিত্তিক কর্পোরেশন এবং স্বাভাবিকভাবেই এদের মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ এককভাবে শীর্ষ ধনীদের হাতে। এরাই বর্তমান বিশ্ব-সংস্কৃতিও রাজনীতিকে নেপথ্যে থেকে নিয়ন্ত্রণ করছে। ভারতের শীর্ষ ধনীদের অনেকেই মিডিয়া ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। বৃহত্তম কর্পোরেট গ্রুপ রিলায়েন্স ভারতীয় অর্থনীতিতে প্রভাব রাখার পাশাপাশি মিডিয়া জগতেও প্রবল প্রতাপে উপস্থিত। রিলায়েন্সের কর্ণধার মুকেশ আম্বানী গত কয়েক বছরে ভারতের মিডিয়া কোম্পানিগুলোর অনেক শেয়ার কিনে নিয়েছেন। নেটওয়ার্ক-১৮তে বিনিয়োগ করেছেন সতেরো শ’ কোটি রুপী। টিভিতে প্রচারিত বিষয়বস্তু নির্বাচনে অগ্রাধিকার পাওয়ার শর্তে এ বিনিয়োগ করা হয়। এ শর্তের গুরুত্ব অনেক। অনুষ্ঠান প্রচারে অগ্রাধিকার পাওয়ার অর্থ হচ্ছে নিজেদের উদ্দেশ্য পূরণের উপযোগী অনুষ্ঠান প্রচার। ফরচুন ম্যাগাজিনের জরিপে দু’হাজার তেরো সালে বিশ্বের বৃহত্তম পাঁচ শ’ কোম্পানির তালিকায় জায়গা পাওয়া মুকেশ আম্বানী মূলত এখন ভারতীয় মিডিয়া জগতের সম্রাট। মোদির নির্বাচনী প্রচারের ব্যয়ভারের বড় অঙ্কটি সম্ভবত আম্বানীর তহবিল থেকেই যায়। শুধু ভারত নয় পৃথিবীর নানা দেশে নতুনভাবে ধর্মের উত্থানের আসল উৎসে রয়েছে কর্পোরেট পুঁজির নানা ধরনের কৌশল। যা জনগণের মন বিষিয়ে তোলে। বিশ্ব কর্পোরেট পুঁজির কাছে দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের জন্য সম্ভবত মৌলবাদী রাজনৈতিক অর্থনীতির কদর বেড়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিড়লা চেয়েছিলেন ভারত হিন্দু রাষ্ট্র হোক। গত টার্মে মোদির উত্থানের মধ্য দিয়ে তা কিছুটা হলেও বাস্তবায়িত হয়েছে। এবারের নির্বাচনেও হয়ত তার আকাক্সক্ষা বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে। ভারত ভাগের টানটান উত্তেজনার শুরুর সময় থেকেই কংগ্রেস মুসলিম লীগ দু’দলেরই আতঙ্কের কারণ ছিলেন কমিউনিস্টরা। জাতীয়তাবাদীরা ছিলেন সমাজ বিপ্লবের বিরোধী। শ্যামাপ্রসাদের মতো কট্টরবাদীরা এমনকি মুসলমানদের সঙ্গে মন্ত্রিত্ব ভাগাভাগি করতে রাজি ছিলেন কিন্তু কমিউনিস্টদের সঙ্গে না। কংগ্রেস, লীগ দু’দলের জাতাীয়তাবাদী নেতাদের মধ্যে ডান বামের টানাপোড়েন থাকলেও কমিউনিস্ট বিরোধিতার প্রশ্নে তাদের মধ্যে অটুট ঐক্য ছিল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের চেয়েও কিমিউনিস্টরা তাদের কাছে বেশি ভীতিকর ছিলেন এ জন্য যে, ব্রিটিশদের কাছ থেকে তাদের ক্ষমতা পাওয়ার সুবর্ণ হাতছানি ছিল। কিন্তু সমাজ বিপ্লব শুধু যে ক্ষমতার স্বপ্ন চুরমার করবে তাই নয় তাদের শ্রেণী অবস্থানও ভেঙ্গে খানখান হবে। এই ভীতিই তাদের ব্রিটিশের সঙ্গে আপোসকামিতার পথে পা বাড়ানোকে দ্রুততর করেছিল। এতখানি কমিউনিস্ট বিদ্বেষের পরও পশ্চিমবঙ্গ ও কেরালায় দীর্ঘদিন কমিউনিস্ট শাসন টিকে ছিল। এমনকি সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরও। কিন্তু পুঁজিবাদী বিশ্বের প্রবল জোয়ারে পাল্টা হাল ধরার শক্তি কমিউনিস্টদের জন্য আন্তর্জাতিকভাবেই খুব দুর্বল। তার ওপর রয়েছে নানা ধরনের কূটকৌশল। এসব অতিক্রম করা সম্ভব হয়নি ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে। তাই পুঁজিরই জয়জয়কার। মিডিয়া তারই বাদ্য বাজায়।
×