ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

গ্রামের মানুষকে যাতে আর বাস্তুচ্যুত হতে না হয় সেজন্য চাঙ্গা করা হচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতি

ঢাকায় বস্তি নামের কলঙ্কমুক্তির চেষ্টায় নানামুখী উদ্যোগ

প্রকাশিত: ০৯:৪১, ২৯ এপ্রিল ২০১৯

 ঢাকায় বস্তি নামের কলঙ্কমুক্তির চেষ্টায় নানামুখী উদ্যোগ

গাফফার খান চৌধুরী ॥ গৃহহীন ও বস্তিবাসীদের পুনর্বাসনে সরকার নানা উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। উদ্যোগ বাস্তবায়ন করে ’৪১ সাল নাগাদ দেশকে বস্তি নামের কলঙ্ক মুক্তির চেষ্টা চলছে। সেই মোতাবেক বস্তিবাসী পুনর্বাসনের পরিকল্পনা রয়েছে। ঢাকায় কোন বস্তি থাকছে না। গ্রাম থেকে শহরে এসে মানুষকে যাতে বস্তিতে বসবাস করতে না হয়, এজন্য গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা করা হচ্ছে। পরিকল্পনা মোতাবেক সরকার গ্রামে শহরের সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছে। নদী ভাঙ্গন প্রবণ এলাকায় নদী শাসন ও বেড়িবাঁধ নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। যাতে নদী ভাঙ্গাদের শহরে এসে বস্তিতে থাকতে না হয়। আর ঢাকার বস্তির জায়গা, আশপাশে বা সুবিধাজনক স্থানে বহুতল আবাসিক কাম বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাসহ বস্তিবাসীদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বস্তিবাসীদের শিক্ষিত করতে শিক্ষামূলক নানা কর্মকা-ের পাশাপাশি স্কুল নির্মাণ ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে বাড়ানো হয়েছে কমিউনিটি ক্লিনিকের কার্যক্রম। বস্তিবাসী পুনর্বাসন করতে থমকে থাকা ভাষানটেক বস্তি উন্নয়ন প্রকল্পটি আবার চালুর চেষ্টা চলছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্র মোতাবেক, দেশজুড়ে বস্তির সার্বিক উন্নয়নের জন্য আরবান পার্টনারশিপস ফর পোভার্টি রিডাক্সন প্রজেক্ট (ইউপিপিআর) নামে একটি প্রকল্প চালু আছে। প্রকল্পটির জরিপ মোতাবেক দেশে ছোট-বড় মোট বস্তি ৪৫ হাজার। এসব বস্তিতে দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ২১ ভাগ অর্থাৎ ৩ কোটি ৩৬ লাখ গরিব মানুষের বসবাস। আর এই দরিদ্র মানুষের মধ্যে ৮ শতাংশ হতদরিদ্র। সেই হিসাব মোতাবেক ২৭ লাখ হতদরিদ্র মানুষ বস্তিতে বাস করেন। বস্তিগুলো ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট, রাজশাহী, টঙ্গী, ময়মনসিংহ, রংপুর, বরিশাল, নারায়ণগঞ্জ, যশোর, কুমিল্লা, দিনাজপুর, নবাবগঞ্জ, বগুড়া, টাঙ্গাইল, সাভার. গাজীপুর, নওগাঁ, গোপালগঞ্জ, কুষ্টিয়া, সিরাজগঞ্জ, হবিগঞ্জ, পাবনা, চাঁদপুর, ফেনী, নীলফামারীর সৈয়দপুর, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ ও ফরিদপুরে অবস্থিত। বস্তিগুলো প্রায় ১৫ হাজার একর জায়গা নিয়ে গড়ে উঠেছে। যার অধিকাংশই সরকারী জায়গা। এর মধ্যে রেলওয়েরই ৪ হাজার একরের বেশি জমিতে গড়ে উঠেছে বস্তি। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হিসেব মোতাবেক, ঢাকায় বস্তির সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। গত তিন বছরে ঢাকার ১১০ বস্তির মধ্যে ৯৫টি টিকে আছে। আগুন লাগা ও ধসে পড়ায় ১৫ বস্তি পুরো বিলীন হয়ে গেছে। গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা, নদী শাসনে অনেকেই বস্তি ছেড়ে গ্রামে ফিরে গেছে। ঢাকার বস্তিতে দুই লাখ হতদরিদ্র মানুষ বসবাসের কথা বলা হলেও বাস্তবে এ সংখ্যা আরও বেশি। বস্তিবাসীদের অধিকাংশই রিক্সাচালক, ভ্যান চালক, দোকান কর্মচারী, গার্মেন্টম কর্মীসহ নানা ধরনের নিম্ন আয়ের মানুষ। ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের বস্তি উন্নয়ন বিভাগের তথ্য মোতাবেক ঢাকায় দিন দিন বস্তি কমে যাচ্ছে। ’৩০ সাল নাগাদ অন্তত ৫০ হাজার বস্তিবাসী অন্যত্র বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করার মতো সামর্থ্য হবে। ইতোমধ্যেই পাঠাও বা উবারের মতো রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অনেক রিক্সাচালক তাদের পেশা বদল করেছেন। তারা রিক্সা ছেড়ে ঋণ করে মোটরবাইক বা প্রাইভেটকার নিয়ে চালাচ্ছেন। এদের অনেকেই এক সময় বস্তিতে থাকলেও এখন আর থাকেন না। এছাড়া অনেকেই টাকা রোজগার করে নিজেই ব্যবসার জন্য গ্রামে চলে গেছেন। অনেকে আবার বস্তিতে পাওয়া সরকারী ফ্ল্যাট বিক্রি করে গ্রামে চলে গেছেন। ফ্ল্যাট বিক্রি করে গ্রামে গিয়ে বসবাসকারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভাসানটেক বস্তির মানুষ। ’৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা লাভের পর বস্তি উন্নয়নে নানা পদক্ষেপ নেয়। পদক্ষেপের মধ্যে পুনর্বাসন ছাড়াও গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা, নদী শাসন প্রকল্প ও বেড়িবাঁধ নির্মাণ, ক্ষুদ্র ঋণ, একটি বাড়ি একটি খামারসহ বহু ছোট ছোট পদক্ষেপ নেয়া হয়। ’৯৭ সালে বস্তিবাসীদের সুখদুঃখ দেখতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভাষানটেক বস্তিতে যান। পরে বস্তিবাসীদের পুনর্বাসনে ভাষানটেকে প্রায় ৪৮ একর জমির ওপর হতদরিদ্র, ও নিম্ন আয়ের মানুষদের বসবাসের জন্য আবাসন গড়ে তোলার নির্দেশ দেন তিনি। এটি ভাষানটেক পুনর্বাসন প্রকল্প নামে পরিচিত। সেখানে প্রায় ১৫ হাজার গরিব পরিবারের পুনর্বাসনের কথা ছিল। কিন্তু মসজিদ, স্কুল ও কলেজ নির্মাণ, খেলার মাঠ, কমিউনিটি সেন্টারসহ বসবাসরতদের নানা সুবিধার জন্য আরও কিছু অবকাঠামো নির্মাণের পরিকল্পনা হয়। এজন্য ১৫ হাজারের পরিবর্তে ১৩ হাজার ৬শ’ পরিবারকে পুনর্বাসনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়, যা রাউজক (রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) কর্তৃক অনুমোদিত। সে মোতাবেক ১৮ বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়। ভবনগুলোর মধ্যে এ টাইপের এক রুমের ফ্ল্যাটগুলো মাত্র দুই লাখ টাকায়, তাও আবার কিস্তির মাধ্যমে পরিশোধের সুযোগ দিয়ে হতদরিদ্রদের নামে বরাদ্দ দেয়া হয়। আর বি টাইপের দুই রুমের ফ্ল্যাটগুলো তিন লাখ টাকায় কিস্তির মাধ্যমে নিম্ন আয়ের মানুষের নামে বরাদ্দ দেয়া হয়। সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রতিটি ভবনে একশ’ করে মোট ১৮শ’ পরিবার পুনর্বাসন হয়েছে। বসবাসরত পরিবারগুলোর সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য ’১৪ সালে চালু করা হয়েছে একটি সরকারী প্রাথমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও মহাবিদ্যালয়। পাশাপাশি মসজিদও গড়ে তোলা হয়েছে। কথা রয়েছে একটি হাসপাতাল গড়ে তোলার। থাকছে একটি ফায়ার স্টেশন। বসবাসরত পরিবার যাতে তাদের ছেলে মেয়েদের স্বল্প ব্যয়ে বিয়ের আয়োজন করতে পারে, এজন্য একটি কমিউনিটি সেন্টার গড়ে তোলা হয়েছে। বর্তমানে কমিউনিটি সেন্টারের কিছু অংশে ভাষানটেক থানার কার্যক্রম চলছে। যে কোন সময় থানা অন্যত্র সরে যাবে বলে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা ভূমি মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে। আরও বারোটি ভবনের বেজমেন্টসহ আনুষঙ্গিক কাঠামো তৈরির কাজ শেষ হয়েছে। প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী সাইফুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, নানা কারণেই প্রকল্পের কাজ পিছিয়েছে। ভূমি মন্ত্রণালয় দায়িত্ব নেয়ার পর পরিকল্পনা মাফিক প্রকল্পের কাজ এগিয়ে যাচ্ছিল। বেজমেন্ট হওয়া ভবনগুলো নির্মাণের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। আরও ১২ ভবন নির্মাণ করা হলে সেখানে আরও ১২শ’ হতদরিদ্র পরিবার পুনর্বাসিত হবে। দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে চালু প্রকল্পটি বিএনপি সরকারের আমলে মুখথুবড়ে পড়ে। বিএনপি সরকার প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পুরো দায়িত্ব দেয় এনএসপিডিএল (নর্থ সাউথ প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড) নামে একটি কোম্পানিকে। কোম্পানিটি বিএনপি সরকারের শেষ দিকে প্রকল্পের সবকিছু বুঝে নেয়। ২০০৭ থেকে ’১০ সাল পর্যন্ত প্রকল্প চালু রাখে। এ সময় কোম্পানিটি হতদরিদ্র পরিবারের কাছে ফ্ল্যাট বিক্রি না করে নানা শ্রেণী-পেশার মানুষের কাছে ফ্ল্যাট বিক্রি করে দেয়। বিক্রির টাকাও নয়ছয় হয়। এ নিয়ে ঝামেলার সূত্র ধরে প্রকল্পের কাজ বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। এ বিষয়ে ভাষানটেক বাস্তুহারা উন্নয়ন কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান হাজী মমিন খান জানান, বিদেশে বসবাসকারীদের কাছেও ফ্ল্যাট বিক্রির রেকর্ড রয়েছে কোম্পানিটির। প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগে শেষ পর্যন্ত কোম্পানির মালিক আব্দুর রহিম গ্রেফতার হয়ে কারাগারে গেছেন। জেলও খাটেন চারমাস। এরপর বর্তমান সরকার ক্ষমতা লাভের পর এ কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে প্রকল্পটি সরকারের ভূমি মন্ত্রণালয়ের কাছে হস্তান্তরিত হয়। বর্তমানে ভূমি মন্ত্রণালয় প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। সরকারী সূত্রগুলো বলছে, ’৪১ সাল নাগাদ বস্তিবাসীদের জীবনের আমূল পরিবর্তনের লক্ষ্য নিয়ে কাজ চলছে। সরকার বস্তির জায়গায় বা সরকারের সুবিধাজনক জায়গায় বহুতল ভবন নির্মাণ করে বস্তিবাসী পুনর্বাসনের পরিকল্পনা আছে। ভবনগুলোতে ছোট ছোট ফ্ল্যাট নির্মাণ করে নামমাত্র মূল্যে হতদরিদ্র বস্তিবাসীদের নামে বরাদ্দ দেয়ার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে সরকার। পাশাপাশি দখলমুক্ত হওয়া বস্তির জায়গায় সরকারের ভারি শিল্প স্থাপনসহ উন্নয়নমূলক কর্মকা- চালানোর পরিকল্পনা রয়েছে। যুক্তরাজ্যের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন শাখা দেশের ৪৫ হাজার বস্তির উন্নয়নের জন্য ৬০ লাখ পাউন্ড (বাংলাদেশী টাকায়) ৭২০ কোটি বরাদ্দ দিয়েছে। এসব অর্থ ব্যয় হচ্ছে স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল বিভাগের তদারকিতে। প্রকল্পের কৌশলগত সহায়তা দিচ্ছে ইউএনডিপি (জাতিসংঘ উন্নয়ন সংস্থা)। পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা ছাড়াও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যুক্ত ও অধীন ৩০ সংস্থা, সুশীল সমাজ, হাজারখানেক এনজিও ও বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়ন সংস্থা জড়িত। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. তোফায়েল আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, মানুষ যাতে শহর ছেড়ে গ্রামে গিয়ে কিছু উপার্জন করতে পারে, এজন্য সরকার গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। এতে শহরের ওপর মানুষের চাপ কমবে। পাশাপাশি দেশের অর্থনীতির চাকা আরও গতিশীল হবে। নদীভাঙ্গন প্রবণ এলাকায় লোকদের বসবাস বস্তিতে বেশি। কারণ আচমকা ভাঙ্গনে বাড়িঘর জমিজমা হঠাৎ নদীতে বিলীন হয়ে যায়। তারা নিরুপায় হয়ে বস্তিতে আশ্রয় নেয়। এজন্য নদীভাঙ্গন ঠেকাতে বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও নদীশাসন প্রকল্পের ওপর জোর দিয়েছে সরকার। সরকার বস্তিবাসীর পুনর্বাসন ছাড়া কাউকে যাতে বস্তিতে বসবাস না করতে হয় এজন্য গ্রামে শহরের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে। পাশাপাশি বস্তিবাসীদের মধ্যে শিক্ষার আলো আরও ছড়িয়ে দিতে শিক্ষিত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, যাতে তারা নিজেরাই অন্যত্র গিয়ে উন্নত জীবনযাপন করে। সবচেয়ে বেশি জরুরী বস্তিবাসীদের নানা বিষয়ে প্রশিক্ষিত করে তোলা।
×