ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

উন্নয়ন ও এসডিজি অর্জনে ঋণ চায় বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ১১:১৪, ১২ এপ্রিল ২০১৯

উন্নয়ন ও এসডিজি অর্জনে ঋণ চায় বাংলাদেশ

এম শাহজাহান, ওয়াশিংটন ডিসি থেকে ॥ তীব্র শীতের পর বাংলাদেশের মতো আমেরিকায়ও এখন বসন্তকাল চলছে। কোনদিক তাকালে চোখে পড়ছে দেশটির চিরচেনা ও ভালবাসার প্রতীক টিউলিপ ও চেরিফুল। ঝরা পাতা গাছ ভরে উঠছে নতুন কুঁড়িতে। শীত কমে যাওয়ায় আমেরিকাবাসীরা এখন ফুরফুরে মেজাজে আনন্দ উৎসবে মেতে উঠছেন কখনো-সখনো। ঠিক এই সময়টাতে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের বসন্তকালীন সভা শুরু হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে। সদস্যরাষ্ট্র হিসেবে এই সভায় বাংলাদেশের চাওয়া অনেক। দেশের ধারাবাহিক উন্নয়ন ও এসডিজি অর্জনে ঋণ সহায়তা চাইবে বাংলাদেশ। এছাড়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়টিও আন্তর্জাতিক এই সভায় তুলে ধরার প্রস্তুতি নিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এছাড়া সাইভার ঝুঁকি, জলবায়ু পরিবর্তন ও মাইগ্রেশন মোকাবেলায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজের কৌশল নির্ধারণ করতে শুরু হয়েছে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের বসন্তকালীন বৈঠক। সভায় বাংলাদেশ বিশ্ব নীতিনির্ধারকদের কাছে বাংলাদেশের উন্নয়ন তুলে ধরবে। এছাড়া বাংলাদেশসহ সকল দেশের প্রবৃদ্ধিকে আরও টেকসই করা, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধে উদ্বেগ কমিয়ে আনার কৌশলও খুঁজে বের করা হবে ওই বৈঠক থেকে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্য দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর আস্থা ও বিশ্বাসকে শক্তিশালীভাবে গড়ে তোলার বিষয়টি প্রাধান্য পাচ্ছে। ওয়াশিংটন ডিসিতে এই বৈঠকে অংশ নিয়েছেন বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালসহ ১৮৯টি দেশের অর্থমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গবর্নর। এছাড়া অংশ নিচ্ছেন ২৮০০ অতিথি, ৩৫০টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি এবং ৮০০ সাংবাদিক ও ৫৫০ জন সিভিল সোসাইটির প্রতিনিধি। এসব অতিথিদের বরণ করতে নতুন রূপে সাজানো হয়েছে ১৭৭ কিলোমিটার আয়তনের যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিকে। বৈঠক প্রসঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব মনোয়ার আহমেদ জানিয়েছেন রোহিঙ্গা ইস্যু তুলে ধরা হবে শুক্রবারের বৈঠকে। আগামী বর্ষায় অনেক রোহিঙ্গার ঘর নষ্ট হবে। বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে তাদের ঘর তৈরি করে দিয়েছে। নতুন করে ঘর বাড়ি নষ্ট হলে তা তৈরি করতে অর্থের প্রয়োজন। এ বিষয়টি দাতা সংস্থার কাছে তুলে ধরা হবে। এদিকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) বাস্তবায়নে বেসরকারী বিনিয়োগ খোঁজা হবে এ বৈঠকে। বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের যৌথ উদ্যোগে একটি বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছে। সেখানে বাংলাদেশসহ এ ধরনের দেশগুলো কিভাবে এসডিজি বাস্তবায়ন করবে, সেখানে বেসরকারী বিনিয়োগের পরিমাণ, কারা বিনিয়োগ করবে এ নিয়ে তুলে ধরা হবে বিশ্বের বড় বড় কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সিইউ ও উদ্যোক্তাদের কাছে। সে বৈঠকে বাংলাদেশ থেকে একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হবে। জানা গেছে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের বৈঠকে বিশ্ব অর্থনীতি পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। কারণ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সম্প্রতি তাদের পূর্ভাবাসে বলেছে ২০১৯ এবং ২০২০ সালে কমপক্ষে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি কমবে বিগত বছরগুলোর তুলনায়। সংস্থাটি বলেছে গত দুবছর আগেও বিশ্ব অর্থনীতি ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। কিন্তু চলতি বছর আশা করা হচ্ছে ৭৫ শতাংশ থেকে ৭০ শতাংশে নেমে আসবে। এই মুহূর্তে বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি নিচের দিকে যাচ্ছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক খাতের নেতারা একমত হয়েছেন ২০১৮ সালের পর যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে যে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হয়েছে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বিশ্ব অর্থনীতিতে। এই বাণিজ্য উদ্বেগ কিভাবে কমানো যায় সেটি ওঠে আগামী দিনগুলোর চলমান বৈঠকে তুলে ধরা হবে। বসন্তকালীন বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিনিয়োগ, পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ, উন্নয়নের জন্য অর্থায়ন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জনে বাংলাদেশের অবস্থান, বেসরকারী অর্থায়নে বিনিয়োগের ইস্যুগুলো তুলে ধরা হবে। বৈঠক চলাকালীন বাংলাদেশের সঙ্গে একাধিক বৈঠক হবে। এসডিজি অর্জনে বাংলাদেশের প্রয়োজন হবে প্রায় ৭৭ লাখ হাজার কোটি টাকা। প্রতিবছর ধারাবাহিকভাবে ৭ শতাংশের উপরে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। সর্বশেষ ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে যা বিশ্বেও শীর্ষ ৫টি প্রবৃদ্ধি অর্জনের একটি দেশ। এই বৈঠকে অংশ নিতে ইতোমধ্যে অর্থমন্ত্রীসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ফজলে কবির, অর্থসচিব আবদুর রউফ তালুকদার ও আইআরডি সচিবসহ ১৫ সদস্যের প্রতিনিধি দল ওয়াসিংটনে পৌঁছেছেন। এবারের সভায় গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দিবেন সদ্য নিয়োগ পাওয়া বিশ্বব্যাংকের নতুন প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাস যিনি মার্কিন প্রেডিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত। এছাড়া আইএমএফের এমডি ক্রিস্টিয়ান লাগাদে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখবেন। জানা গেছে, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা সমস্যাসহ পাঁচ ইস্যু তুলে ধরা হবে এবারের বৈঠকে। কারণ রোহিঙ্গা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় সমস্যা। তাদের ফেরতের বিষয়টি জাতিসংঘসহ অন্য সংস্থার সঙ্গে আলোচনা করা হবে। সমর্থন আদায় করা হবে অন্য দেশের। এ জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে নেয়া হয়েছে ব্যাপক প্রস্তুতি। এর আগে গত অক্টোবর অনুষ্ঠিত বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের বার্ষিক বৈঠকে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা ইস্যু তুলে ধরেছিল। ওই সময় বিশ্বব্যাপী সহায়তার আশ্বাসও পাওয়া গেছে। এবার বসন্তকালীন বৈঠকে সমস্যাগুলো তুলে ধরা হবে যাতে বিশ্বের অন্য দেশগুলোর সমর্থন পাওয়া যায়। এ জন্য রোহিঙ্গাদের বর্তমান অবস্থার ওপর বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। যা অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যে থাকবে। এছাড়া রোহিঙ্গাদের মোট সংখ্যা, পূর্বের সংখ্যা, বর্তমানে দফায় দফায় আগত রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা, পুরুষ-মহিলা ও শিশুর তথ্য, প্রয়োজনীয় মৌলিক চাহিদা (খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ প্রয়োজনীয় তথ্য) এবং রোহিঙ্গাদের আগমনের ফলে স্থানীয় জনগণ ও অবকাঠামোর ওপর বিরূপ প্রভাব ব্যাখা করা হবে। এসব তথ্য তুলে ধরার পাশাপাশি তাদের প্রতিপালনের জন্য চাওয়া হবে প্রয়েজনীয় সহায়তাও। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে টেকসই উন্নয়নের ঝুঁকি, দক্ষ মানব সম্পদ উন্নয়ন, সার্বিক স্বাস্থ্য সেবা এবং গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডের অর্থায়ন। বৈঠক প্রসঙ্গে অর্থসচিব আবদুর রউফ তালুকদার জনকণ্ঠকে বলেন, অর্থমন্ত্রীর সার্বিক তত্ত্বাবধানে প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। বসন্তকালীন বৈঠকে সংস্থা দুটির উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় এসব বিষয় তুলে ধরা হবে। এদিকে বসন্তকালীন বৈঠকে বিশ্বব্যাপী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে সন্ত্রাসী অর্থায়নে প্রতিরোধ, সাইবার ঝুঁকি, জলবায়ু পরিবর্তন ও ভৌগোলিক মাইগ্রেশন। এখন বিভিন্ন দেশে সাইবার অপরাধ হচ্ছে। হ্যাকিং হচ্ছে। এক থেকে এসে অন্য দেশে প্রবেশ করে সারভার হ্যাকিং করছে। বাংলাদেশও এমন ঘটনার শিকার হয়েছে। বিশেষ বাংলাদেশ ব্যাংকের রির্জাভ ৮ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। বিভিন্ন দেশ মনে করছে এসব ঝুঁকি মোকাবেলায় একটি দেশের একা কাজ করা সম্ভব নয়। সম্মিলিতভাবে এসব ঝুঁকি মোকাবেলায় সকলকে এক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। কারণ আর্থিক খাতে এসব ঝুঁকি ভবিষতে আরও বাড়বে। জানা গেছে, প্রতিবছর বিশ্বে অবৈধভবে দেড় লাখ কোটি ডলার পাচার বা ব্যয় করা হচ্ছে। এটি বিশ্ব জিডিপির ২ শতাংশ। পাশাপাশি দুর্নীতিও ক্ষতি করছে অর্থনীতিকে। এছাড়া প্রতিটি দেশের জন্য তিনটি নীতির প্রয়োজনীয়তা আলোচনায় আনা হবে।
×