ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ওয়াজে সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গীবাদে উস্কানি ১৫ বক্তা চিহ্নিত

প্রকাশিত: ১০:২৯, ৭ এপ্রিল ২০১৯

 ওয়াজে সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গীবাদে উস্কানি ১৫ বক্তা চিহ্নিত

বিভাষ বাড়ৈ ॥ ওয়াজ মাহফিলে কথিত অনেক বক্তার বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানো, জঙ্গীবাদে উস্কানি, নারীবিদ্বেষ, গণতন্ত্র ও দেশী সংস্কৃতিবিরোধী কর্মকান্ডের প্রমাণ মিলেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিশেষ রিপোর্টে। ধর্মের অপব্যাবহার করে ওয়াজ মাহফিলের নামে তারা ভিন্ন ধর্ম ও ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন মতাদর্শের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেন, অভিনেতা অভিনেত্রীদের নিয়ে উস্কানিমূলক বক্তব্য দিচ্ছেন এবং নারীদের পর্দা করা নিয়ে উগ্রবাদী বক্তব্য ছড়াচ্ছেন বলে তথ্য মিলেছে অন্তত ১৫ জনের বিরুদ্ধে। এদিকে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পেলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ দিয়ে বিশিষ্ট আলেম ওলামাসহ ইসলামী চিন্তাবিদরা বলেছেন, প্রমাণ পেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হোক। তবে ঢালাও কোন পদক্ষেপ যেন নেয়া না হয়। জানা গেছে, বিভিন্ন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ইতোমধ্যেই ব্যবস্থা গ্রহণে ছয়টি সুপারিশ করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ (ইফাবা), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও সকল বিভাগীয় কমিশনারের কাছে সুপারিশ পাঠানো হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুপারিশের মধ্যে মাহফিলে বক্তাদের মধ্যে কেউ চুক্তিভিত্তিক অর্থগ্রহণ করেন আয়কর দিচ্ছেন কিনা তা দেখা ও দেশবিরোধী বক্তব্য দিলে আইনের আওতায় আনার কথা রলা হয়েছে। একইসঙ্গে উচ্চশিক্ষিত বক্তাদের নিবন্ধনের আওতায় আনতে ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে ইতোমধ্যে সুপারিশ বাস্তবায়নের কাজ শুরু করেছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ওয়াজ মাহফিলে কী ধরনের বক্তৃতা হয় তা সবসময় আমাদের কাছে প্রতিবেদন আকারে আসে। আমরা সেই অনুযায়ী কাজ করি। আর বক্তারা কীভাবে করের আওতায় আসবেন তা দেখবে আয়কর বিভাগ। প্রতিবেদনে ওয়াজ মাহফিলের ১৫ বক্তার নাম উল্লেখ করে জানানো হয়েছে, এসব বক্তা সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মবিদ্বেষ, নারীবিদ্বেষ, জঙ্গীবাদ, গণতন্ত্রবিরোধী ও দেশী সংস্কৃতিবিরোধী বয়ান দেন বলে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে দেশের ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা রেডিক্যালাইজড হয়ে উগ্রবাদের দিকে ধাবিত হচ্ছে। প্রতিবেদনে বক্তাদের আলোচ্য বিষয় নিয়ে পর্যালোচনা করা হয়েছে। এতে নারী সম্পর্কিত বয়ানে কী কী আলোচনা করা হয়, মঙ্গল শোভাযাত্রাসহ পহেলা বৈশাখে নববর্ষ পালন নিয়ে বক্তাদের মন্তব্যের সারাংশ ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ নিয়ে বক্তাদের কিছু বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। এছাড়া ‘গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ধর্মনিরেপক্ষতাবাদ মুশরিকদের কাজ’, ‘শহীদ মিনারে ফুল দেয়া, প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে নীরবতা পালন করা শিরক’, ‘গণতন্ত্র ইসলামে নাই, ইহা হারাম’ এবং ‘জাতীয় সঙ্গীত কওমি মাদ্রাসায় চাপিয়ে দেয়া যাবে না’ এমন বক্তব্য। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘ওয়াজে বক্তারা প্রযুক্তির নানাবিধ ব্যবহারের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিশেষ করে ইউটিউবে বিভিন্ন নামে চ্যানেল খুলে তাদের বিদ্বেষপূর্ণ ও উগ্রবাদী ওয়াজ প্রচার চালিয়ে আসছে। এ ধরনের ওয়াজ লাখ লাখ দর্শক এবং শেয়ারকারীদের অধিকাংশই সরলমনা ধর্মপ্রাণ তরুণ মুসলমান। সেজন্য ওয়াজকারীদের উগ্রবাদী কথাবার্তা ও মনোভাব দেশের তরুণ মুসলিম সমাজে সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করছে। তারা দেশী সংস্কৃতি পালনে বিভ্রান্ত হচ্ছে। ফলে কিছুসংখ্যক লোক প্রতিশোধপরায়ণ ও জঙ্গীবাদের দিকে ধাবিত হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুপারিশের মধ্যে আছে- ওয়াজি হুজুররা যেন বাস্তবধর্মী ও ইসলামের মূল স্পিরিটের সঙ্গে সংহতিপূর্ণ বক্তব্য প্রদান করেন, সেজন্য তাদের প্রশিক্ষণ ও উদ্বুদ্ধকরণের ব্যবস্থা করা। এক্ষেত্রে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে স্থানীয় প্রশাসন ও কমিউনিটি পুলিশের ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ। যারা ওয়াজের নামে হাস্যকর ও বিতর্কিত বক্তব্য প্রদানের মাধ্যমে ধর্মের ভাবগাম্ভীর্য নষ্টের চেষ্টা চালান তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণসহ প্রো-এ্যাকটিভ উদ্বুদ্ধকরণ করা। অনেক আলেমের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। দাওরায়ে হাদিস ডিগ্রীর মতো উচ্চশিক্ষা ছাড়া যারা ওয়াজ করেন তারাই জঙ্গীবাদ ও বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। তাই মাদ্রাসায় উচ্চশিক্ষিত ওয়াজকারীদের নিবন্ধনের আওতায় নিয়ে আসা। বলা হয়েছে, অনেকেই আছেন যারা হেলিকপ্টারযোগে ওয়াজ মাহফিলে যোগ দেন এবং ঘণ্টাচুক্তিতে বক্তব্য দিয়ে বিশাল অঙ্কের অর্থ গ্রহণ করেন। তারা নিয়মিত ও সঠিকভাবে আয়কর প্রদান করেন কিনা তা নজরদারির জন্য আয়কর বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট সব বিভাগে কর্মতৎপরতা বৃদ্ধি করা। ওয়াজি হুজুরদের বক্তব্য স্থানীয় প্রশাসন কর্তৃক সংরক্ষণ ও পর্যালোচনার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া এবং উস্কানিমূলক ও বিদ্বেষ ছড়ানোর বক্তব্য দিলে তাদের সতর্ক করা। প্রয়োজনে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে ও রাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্য প্রদানকারীদের আইনের আওতায় আনা। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ॥ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক শাখা থেকে এই ১৫ বক্তাকে চিহ্নিত করে ছয়টি নির্দেশনা সংবলিত একটি চিঠি ইসলামিক ফাউন্ডেশন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও বিভাগীয় কমিশনারদের কাছে পাঠানো হয়েছে। নির্দেশে ওয়াজে উস্কানি ঠেকাতে ওয়াজকারীদের আইনের আওতায় আনার জন্য বলা হয়েছে। একই সঙ্গে ওয়াজ মাহফিলের বক্তাদের আয়কর দেয়ার বিষয়টি নজরদারিরও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে চিঠিতে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (রাজনৈতিক ও আইসিটি) আবু বকর ছিদ্দিক বলেন, আমাদের এখানে ওয়াজ মাহফিল সবসময় মনিটরিং হয়। ওয়াজ মাহফিলে কে কোথায় কী বলেন, তা আমরা সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা দফতর থেকে পেয়ে আবার বিভিন্ন জায়গায় পাঠিয়ে থাকি। আমরা গোয়েন্দা রিপোর্ট যেভাবে পাই সেভাবে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য বিভিন্ন দফতরে পাঠাই। এসব প্রতিবেদনের কনটেন্টগুলো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তৈরি করে না। আমরা নিয়মিতই গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে রিপোর্ট পাই, আগাম ব্যবস্থা হিসেবে সেগুলোর বিষয়ে রিলেডেট জায়গাগুলোতে কমিউনিকেট করতে হয়, সেটাই আমরা করেছি। চিঠিতে ওয়াজ মাহফিল করা ১৫ বক্তার নাম উল্লেখ করে বলা হয়, এসব বক্তা সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মবিদ্বেষ, নারীবিদ্বেষ, জঙ্গীবাদ, গণতন্ত্রবিরোধী ও দেশীয় সংস্কৃতিবিরোধী বয়ান দেন বলে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা রেডিক্যালাইজড (মৌলবাদী) হয়ে উগ্রবাদের দিকে ধাবিত হচ্ছে। ১৫ বক্তার মধ্যে রয়েছেন- আবদুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ (সালাফি), মাওলানা মুফতি মাহমুদুল হাসান (মোহাম্মদপুর জামিয়াতুল উলুমিল ইসলামিয়া মাদ্রাসার মুহতামিম), আল্লামা মামুনুল হক (বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব), মুফতি ইলিয়াছুর রহমান জিহাদী (ক্যান্টনমেন্টের বাইতুল রসুল ক্যাডেট মাদ্রাসা ও এতিমখানার প্রিন্সিপাল), মুফতি ফয়জুল করিম (ইসলামী আন্দোলনের সিনিয়র নায়েব আমির), মুজাফফর বিন মুহসিন, মুফতি সাখাওয়াত হোসাইন (ইসলামী ঐক্যজোটের যুগ্ম মহাসচিব), মতিউর রহমান মাদানী, মাওলানা আমির হামজা, মাওলানা সিফাত হাসান, দেওয়ানবাগী পীর, মাওলানা আরিফ বিল্লাহ, হাফেজ মাওলানা ফয়সাল আহমদ হেলাল ও মোহাম্মদ রাক্বিব ইবনে সিরাজ। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ দাবি ॥ সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পেলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগার গ্র্যান্ড ইমাম ফরিদ উদ্দিন মাসউদ। তিনি বলেন, বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। তবে আমার বক্তব্য হচ্ছে যদি সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় তাহলে কেবল তাদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়া হোক। তবে ঢালাও যেন কোন কাজ করা না হয়। তাহলে বরং ক্ষতি হবে। বাংলাদেশ সম্মিলিত ইসলামী জোটের প্রধান হাফেজ মাওলানা জিয়াউল হাসান বলেছেন, কষ্ট লাগে মাঠেঘাটে ওয়াজের নামে চিহ্নিত কিছু ব্যক্তি সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, জঙ্গীবাদে উস্কানি, নারীবিদ্বেষ, গণতন্ত্র ও দেশী সংস্কৃতিবিরোধী কর্মকান্ড চালাচ্ছেন। অবশ্য সবাই এসব করছে না। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে কিছু বক্তা যখন এসব কথা বলছে তখন সেখানে থাকছেন স্থানীয় পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতারাই। এরা আসলে হাইব্রিড আওয়ামী লীগ। নিজেদের স্বার্থ হাসিল আওয়ামী লীগকে বেকায়দায় ফেলতে এরা আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশ করেছে। মাঠ পর্যায়ে ওয়াজ মাহফিলের সামনে এরাই থাকছে। এটা সরকারের জরুরী ভিত্তিতে দেখা দরকার। ওয়াজে যারা এসব করছেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোরভাবে এসব দেখতে হবে। ওয়াজ মাহফিল নিয়ন্ত্রণ না করে পরিশীলিত করার পক্ষেও মত আলেমদের। তারা ওয়াজ মাহফিলের বক্তাদের মধ্যেও সমন্বয় চান। ওয়াজ মাহফিলের বিশৃঙ্খলা বন্ধ করাতে আলেমদের সমন্বয়ে বোর্ড গঠনের কথা বলেছেন চরমোনাই পীর ও ইসলামী আন্দোলনের আমির মাওলানা সৈয়দ রেজাউল করীম। তিনি বলেন, আলেমদের সমন্বয়ে একটি বোর্ড গঠন করে ওয়াজ মাহফিলে বিশৃঙ্খলা বন্ধ করা প্রয়োজন। তবে আলেমদের অংশগ্রহণ ছাড়া শুধু সরকারের তত্ত্বাবধানে করলে এটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হওয়ার শঙ্কা আছে ।
×