ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জনবল সঙ্কটে বিআরটিএ ;###;নিয়মিত তদারকির অভাবে পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা ফিরছে না ;###;একই নম্বর প্লেটে সারাদেশে একাধিক গাড়ি ;###;যাত্রী কল্যাণ সমিতির ৩৭ দফা সুপারিশ

অনিবন্ধিত যানবাহনই সমস্যা ॥ নিরাপদ সড়কের আশা সুদূরপরাহত

প্রকাশিত: ১০:৫১, ৬ এপ্রিল ২০১৯

 অনিবন্ধিত যানবাহনই সমস্যা ॥ নিরাপদ সড়কের আশা সুদূরপরাহত

রাজন ভট্টাচার্য ॥ সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলা হচ্ছে বার বার। তবুও সড়কে থামছে না মৃত্যুর মিছিল। এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা-সমালোচনা আছে। সরকারী হিসেবে দেশে বর্তমানে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ৩৯লাখ। দুর্ঘটনার পেছনে অনিবন্ধিত যানবাহনকেই অনেকাংশে দায়ী করা হয়। কিন্তু দেশে নিবন্ধনহীন যানবাহনের প্রকৃত পরিসংখ্যান কারও হাতেই নেই। খোদ বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ বলছে, ১০ বছরের বেশি সময় ধরে ৭০ হাজারের বেশি যানবাহন ফিটনেস সার্টিফিকেট ছাড়াই চলাচল করছে। নিবন্ধনহীন বিশাল যানবাহনের বহর রেখে দেশে কোনভাবেই নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করা সম্ভব নয় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করার আগে পরিবহন নিয়ন্ত্রক সংস্থা (বিআরটিএ) কর্তৃপক্ষকে স্বনির্ভর করার বিকল্প নেই। সারাদেশে সংস্থাটির মাত্র সাড়ে ৮০০ জনবল দিয়ে পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা ফিরবে না। এদিকে পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা ফেরানো ও সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সুপারিশ প্রণয়নে সরকারী কমিটিকে ৩৭ দফা প্রস্তাব দিয়েছে সড়ক নিরাপত্তায় কাজ করা বেসরকারী সংগঠন ‘যাত্রী কল্যাণ সমিতি’। সুপ্রভাত পরিবহনের ৯০ ভাগ বাসের রুট পারমিট ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকার প্রমাণ মিলেছে বিআরটিএ তদন্তে। সম্প্রতি উচ্চ আদালতে এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের নির্দেশে বিআরটিএ (বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি) বিভিন্ন সড়কে চলাচলকারী যানবাহনের ওপর এক জরিপ চালিয়েছে। জরিপে দেখা যাচ্ছে, ৩৩ শতাংশ যাত্রীবাহী বাসের ফিটনেস সার্টিফিকেট এবং ৫৬ শতাংশের গতিনিয়ন্ত্রক সিল ঠিক নেই। জরিপের ফল সংক্রান্ত প্রতিবেদনটি উচ্চ আদালতে দাখিল করা হয়েছে। প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি প্রতিরোধে এবং সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে আনফিট বা ত্রুটিপূর্ণ যানবাহনের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা জরুরী। এতে আরও বলা হয়েছে, সমস্যার ব্যাপকতা ও মাত্রা বোঝার জন্য যানবাহনের, বিশেষ করে গণপরিবহনের ওপর বিজ্ঞানভিত্তিক জরিপ পরিচালনা খুবই জরুরী। পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বিআরটিএ কর্মকর্তারা বলছেন, নিয়মিত তদারকির অভাবে পরিবহন সেক্টরে অরাজকতা নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না। দেখা যায়, একই নম্বরপ্লেটে সারাদেশে একাধিক গাড়ি চলাচল করে। আবার ভুয়া নম্বরপ্লেট দিয়ে গাড়ি চলাচল করার সময় মোবাইল কোর্টের কাছে ধরা পড়েছে। সারাদেশে যেসব লেগুনা বা অটোরিক্সা চলছে এর বেশিরভাগেরই অনুমোদন নেই। একটি শহরে স্বাভাবিক চলাচলের জন্য কমপক্ষে ২৫ ভাগ সড়ক থাকা প্রয়োজন। কিন্তু ঢাকা শহরে রয়েছে মাত্র আট ভাগ। এরমধ্যে প্রায় অর্ধেক দখলে। ফলে দিন দিন সড়কে যানজট বাড়ছে। পরিবহনের গতি নেমেছে ঘণ্টায় ৫কিলোমিটারের কম। তাই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে চালকরা বেপরোয়া গাড়ি চালান। এতে প্রতিদিনই ঘটছে সড়ক দুর্ঘটনা। একই চিত্র সারাদেশের ক্ষেত্রে। আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুযায়ী পরিবহন চলাচলে ২৫ ভাগ সড়কের মধ্যে সারাদেশে ১০ ভাগের কম রয়েছে। কিন্তু পাল্লা দিয়ে বাড়ছে গাড়ি। দক্ষ চালক তৈরি হচ্ছে না। বাড়ছে না পেশার মান। তাই সড়ক দুর্ঘটনা এখন জাতীয় দুর্যোগ হয়ে সামনে এসেছে। বর্তমানে দেশে যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম সড়ক যোগাযোগ সেক্টরে বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা ও দুর্ঘটনা জাতীয় সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিষয়টি উপলব্ধি করে সরকার তার নির্বাচনী ইশতেহারে নিরাপদ সড়কের অঙ্গীকার করে। এরই ধারাবাহিকতায় জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের ২৬তম সভায় সড়ক পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা জোরদার ও দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে সুপারিশ প্রণয়নে একটি কমিটি গঠন করা হয়। সাবেক মন্ত্রী ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি শাজাহান খানকে প্রধান করে ২১ সদস্যের কমিটি হয়েছে। কমিটি ইতোমধ্যে ১১১টি সুপারিশ তৈরি করেছে। চলতি সপ্তাহের মধ্যে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়ার কথা রয়েছে। এই সুপারিশ বাস্তবায়ন করবে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে গঠিত একাধিক টাস্কফোর্স। জানতে চাইলে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সড়ক দুর্ঘটনারোধে গঠিত কমিটির ১১১টি সুপারিশ পর্যালোচনা করে দেখা যায় অর্ধেকের বেশি সুপারিশ বাস্তবায়নকারী অথবা সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠান বিআরটিএ। অথচ এই প্রতিষ্ঠানের জনবল মাত্র ৮। বর্তমানে দেশে নিবন্ধিত যানবাহন ৩৯ লাখ। প্রতিষ্ঠানটি দৈনন্দিন যানবাহন নিবন্ধন, যানবাহনে মালিকানা পরিবর্তন, রুট পারমিট ইস্যু, যানবাহনের ফিটনেস প্রদান, প্রতিবছর প্রায় ৩ লাখ নতুন লাইসেন্স ইস্যু এবং ৩/৪ লাখ লাইসেন্স নবায়ন, মোবাইল কোর্ট পরিচালনার পাশাপাশি দেশী-বিদেশী প্রশিক্ষণ গ্রহণ, চালকদের প্রশিক্ষণ প্রদান, সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন উন্নয়নমূলক সভায় অংশগ্রহণ করতে গিয়ে জনবল সঙ্কটে হিমশিম খাচ্ছে। সেখানে এই ধরনের সুপারিশ বাস্তবায়নে তাদের সক্ষমতা প্রশ্নবিদ্ধ। কেননা, একেকটি সুপারিশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এসব সুপারিশ বাস্তবায়নে যথেষ্ট অর্থ ও অভিজ্ঞ জনবল প্রয়োজন। যাত্রী কল্যাণের সুপারিশ ॥ সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো ও দুর্ঘটনা রোধে বুধবার যাত্রী কল্যাণ সমিতির পক্ষ থেকে সরকারী কমিটির কাছে ৩৭ দফা সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে, ১. সারাদেশে বাস নেটওয়ার্ক ভেঙ্গে পড়েছে, মোটরসাইকেল ও অটোরিক্সা, ইজিবাইক, নসিমন-করিমন দেশে এখন প্রধান বাহন হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এতে দুর্ঘটনা, যানজট ও যাতায়াত ব্যয়, জ্বালানি ব্যয় বেড়েছে। ছোট ছোট এসব যানবাহনের পাশাপাশি মেয়াদোত্তীর্ণ ঝুঁকিপূর্ণ লক্কড়ঝক্কড় যানবাহন অপসারণ করে পর্যাপ্ত সংখ্যক মানসম্মত বাস-মিনিবাস নামানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা। ২. ভাড়া নৈরাজ্য নিয়ন্ত্রণে প্রতিটি গাড়ির দৃশ্যমান স্থানে যাত্রীসাধারণ যাতে সহজে বুঝে সেই ধরনের ভাড়ার তালিকা ঝুলিয়ে রাখা এবং তালিকা অনুযায়ী ভাড়া আদায় হচ্ছে কিনা তা সময়ে সময়ে মনিটরিং করা। অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ও যাত্রী হয়রানি বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ। ঈদ-পূজা, পার্বণ, বৃহস্পতিবার বা সরকারী ছুটির আগেরদিন অথবা যাত্রীসাধারণের চাহিদা বুঝে সকাল-বিকেল হঠাৎ ভাড়া বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে দেশব্যাপী কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ। ৩. যাত্রী অভিযোগ কেন্দ্র স্থাপন করে একটি হটলাইন নম্বর চালু করা। যাত্রীসাধারণের অভিযোগ আমলে নেয়ার ব্যবস্থা করা। গাড়িতে, বাসস্টান্ডে, বাস টার্মিনালে যাত্রী অভিযোগ কেন্দ্রের হটলাইন নম্বর প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা। বাসের ভেতরে অভিযোগ কেন্দ্রের হটলাইন নম্বর, গাড়ির নম্বর, মালিকের মোবাইল নম্বর লিখে রাখার ব্যবস্থা করা। ৪. গণপরিবহন সেক্টরে রাস্তায় বা টার্মিনালে মালিক-শ্রমিক বা অন্য কোন পক্ষের যে কোন প্রকার চাঁদাবাজি অনতিবিলম্বে বন্ধ করা। ৫. মাদকাসক্ত চালক-শ্রমিকদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের পাশাপাশি এ খাতকে জরুরী ভিত্তিতে মাদক মুক্ত করা। ৬. ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানের পদ্ধতি আধুনিকায়ন করা। উদাহরণ হিসেবে বলতে চাই, মিরপুর ও দিয়াবাড়ি বিআরটিএ থেকে প্রতিদিন ৪০০/০ লাইসেন্স পরীক্ষার্থীর পরীক্ষা নেয়া হয় দুই অফিসের সামনে ছোট্ট পরিসরে। যেখানে একটি বাস ঘোরানো সম্ভব নয় সেখানে এত শিক্ষার্থীর টেস্ট নেয়ায় চালকের সঠিক যোগ্যতা যাচাই প্রশ্নবিদ্ধ রেখে লাইসেন্স প্রদান করা হচ্ছে বলে আমরা মনে করি। এখানে সঠিক নিয়মে পরীক্ষা নিলে প্রতিদিন বড়জোর জনের পরীক্ষা নেয়া সম্ভব। আমরা মনে করি, ঢাকায় ২০/২৫ বিঘা জমির ওপর একটি মিনি স্টেডিয়াম করে যেখানে উচুঁ-নিচু ও পাহাড়ী পরিবেশ সৃষ্টি করে পাকা রাস্তা, কাঁচা রাস্তা, কাদা রাস্তা, পিচ্ছিল রাস্তা এবং এসব রাস্তার রোড সাইন ইত্যাদি সমৃদ্ধ একটি ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষা কেন্দ্র তৈরি করে ঢাকা মহানগর ও আশপাশের জেলার লাইসেন্স প্রত্যাশীদের পরীক্ষা নেয়া যেতে পারে। বিভাগীয় পর্যায়েও অনুরূপ পদ্ধতি চালু করা প্রয়োজন। এছাড়া বহু জেলায় কিছু কর্মকর্তা কর্তৃক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যু করা হচ্ছে, তা জরুরী ভিত্তিতে বন্ধ করা। ৭. ডিজিটাল বাংলাদেশে গাড়ির ফিটনেস প্রদান পদ্ধতি আধুনিকায়ন এখন সময়ের দাবি। খালি চোখে দেখার পরিবর্তে ডিজিটাল মেশিনে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যানবাহনের ফিটনেস প্রদান করা। ৮. গাড়ির ফিটনেস ও ড্রাইভিং লাইসেন্সের সঙ্কট মোকাবেলায় আউটসোর্সিংয়ের ব্যবস্থা করা জরুরী। ৯. সারাদেশে ট্রাফিক অফিস কর্তৃক মোটরযান আইনের জরিমানার অর্থ গ্রাহক কর্তৃক সরাসরি ব্যাংকের মাধ্যমে আদায়ের ব্যবস্থা। ১০. সড়কে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির ৪২ শতাংশই পথচারীর কারণে ঘটে থাকে। এই প্রাণহানি কমাতে পারলে দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব। তাই ফুটপাথ ও রাস্তা বেষ্টনী দ্বারা আলাদা করা। দেশব্যাপী নগর ও জেলায় জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে ফুটপাথ নির্মাণ, পথচারী সেতু, জেব্রাক্রসিং, আন্ডারপাস নির্মাণ ও ব্যবহারে বাধ্য করা। ১১. দেশব্যাপী বহুমাত্রিক পরিবহন পরিকল্পনা প্রণয়ন। ১২. রাস্তাঘাটে ছোট ছোট নির্মাণ ত্রুটির কারণে এখনও বড় বড় দুর্ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলতে চাই, জাতীয় মহাসড়ক এবং আঞ্চলিক মহাসড়কে বিভিন্ন স্পটে রোড ডিভাইডারগুলো মার্কারি দিয়ে চিহ্নিত করা না থাকায় ঘনকুয়াশায় দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। কিন্ত এগুলো অপসারণ অথবা মার্কারি দিয়ে চিহ্নিত করা। ১৩. সকল শ্রেণীর গণপরিবহনে প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জামাদির বক্স রাখার ব্যবস্থা করা। ১৪. দেশে কি পরিমাণ সড়ক দুর্ঘটনা হয় তার কোন সঠিক পরিসংখ্যান কারও কাছে নেই। একেক সংস্থা ভিন্ন ভিন্ন দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান তুলে ধরে। আমরা মনে করি, দুর্ঘটনার সঠিক পরিসংখ্যান নিরূপণ করে প্রকৃত সংখ্যা বিবেচনায় নিয়ে দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে করণীয় নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন জরুরী। ১৫. ঢাকা মহানগরীসহ দেশের বিভিন্ন নগরীতে সিটিং সার্ভিসের নামে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য ও দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠানো নিষিদ্ধ করা। কম স্টপেজের নামে স্বল্প দূরত্বে যাতায়াতকারী যাত্রীদের সর্বশেষ গন্তব্যের ভাড়া আদায় করা যাবে না। ১৬. প্রতিটি গণপরিবহনে আসনে সিট কভারের ব্যবস্থা করা। ১৭. সকল শ্রেণীর পরিবহনে অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা রাখা। ১৮. গণপরিবহনে যাত্রীসাধারণের অনুকূলে যেকোন সিদ্ধান্ত গ্রহণকালে যাত্রী প্রতিনিধির মতামত প্রদানের সুযোগ দেয়া। ১৯. বাস স্টপেজ ও যাত্রী ছাউনি দখলমুক্ত রাখা এবং যাত্রীদের বসার উপযোগী রাখা। বাস স্টপেজ ও যাত্রী ছাউনি থেকে যাত্রী ওঠা-নামা নিশ্চিত করা। ২০. প্রতিটি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকের সমন্বয়ে সড়ক নিরাপত্তা কমিটি গঠন করা। এই কমিটি তাদের বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের নিরাপদ যাতায়াত বিষয়ক প্রশিক্ষণ, আলোচনা সভা, যাতায়াত ব্যবস্থা মনিটরিং করবে। যাতায়াতের সম্ভাব্য ঝুঁকিসমূহ ট্রাফিক পুলিশ, কমিউনিটি পুলিশ, থানা পুলিশ বা বিআরটিএ বা আরটিসির সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে তা নিরসন করবে। ২০. সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণে ট্রাস্টি বোর্ডে যাত্রীসাধারণের প্রতিনিধি রাখা। ২১. সকল শ্রেণীর গণপরিবহনে সিসি ক্যামেরা স্থাপন। ২২. পিকনিক, শিক্ষা সফর, জনসভা, উরস বা অন্য যেকোন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দেবার বাসে মাইকের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা। ফুটপাথে বা সড়কের পাশে মাইক বা সাউন্ড বক্স ব্যবহার করে হকারি করা বা প্রচার করা বা জনসভা নিষিদ্ধ করা। ২৩. সড়ক-মহাসড়কে চলাচলরত সকল শ্রেণীর গণপরিবহনের সকল আসনের যাত্রীদের সিটবেল্ট বাঁধার ব্যবস্থা করা। ২৪. ছোট যানবাহন বিশেষ করে মোটরসাইকেল, ইজিবাইক, অটোরিক্সা, ব্যাটারিচালিত রিক্সা আমদানি অনতিবিলম্বে বন্ধ করা। বাস-মিনিবাস আমদানি উৎসাহিত করা। ২৫. নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের সংরক্ষিত আসন ইঞ্জিনের ওপর রাখা নিষিদ্ধ করা। দরজার সঙ্গে লাগানো আসনগুলো নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধী যাত্রীর জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা। ২৬. ঢাকা মহানগরীতে চলাচলরত সিটিবাসসমূহের পেছনে দরজা রাখার ব্যবস্থা করা এবং প্রতিটি সিটি সার্ভিসের বড় বাসে অর্থাৎ ৩৬ আসনের উর্ধে সকল সিটি সার্ভিসের বাসে দুই দরজা রাখা নিশ্চিত করা। ২৭. গাড়ি আমদানির পূর্বে নিরাপত্তা, পরিবেশ সহায়ক ও বাংলাদেশের সড়কের উপযোগী কিনা সার্বিক বিষয় নিশ্চিত হয়ে ছাড়পত্র প্রদান করা প্রভৃতি। মোজাম্মেল বলেন, আমরা মনে করি, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় অথবা বিআরটিএ এই সড়ক দুর্ঘটনা রোধে আলাদা একটি ইউনিট গঠন করে জরুরী ভিত্তিতে কিছু দেশী-বিদেশী বিশেষজ্ঞ জনবল নিয়োগ প্রদান করা। এই ইউনিট গঠিত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নের পাশাপাশি প্রতিদিন সড়কে বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা, যানজট, দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কাজ করবে। এলাকাভিত্তিক সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধান করে নিরাপদ ও নির্বিঘœ যাতায়াত নিশ্চিত করবে। সুপ্রভাতের ৯০ ভাগ বাসের রুট পারমিট নেই ॥ গত ১৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর বসুন্ধরায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন বেসরকারী বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবরার আহমেদ চৌধুরী। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। পরিস্থিতি বিবেচনায় বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে শুরু করে সরকার। ইতোমধ্যে ঘটনা তদন্তে একাধিক কমিটি গঠন হয়েছে। বিআরটিএ তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজধানীর সুপ্রভাত পরিবহনের প্রায় ৯০ শতাংশ বাসে রুট পারমিট, ফিটনেস সার্টিফিকেট এবং ড্রাইভারের পেশাদার লাইসেন্সসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নেই। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই এতদিন এসব বাস রাস্তায় চলাচল করেছে। প্রায় একই অবস্থা জাবালে নূর পরিবহন লিমিটেডের বাসগুলোর। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) কর্তৃক গঠিত কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনে এমন চিত্র উঠে আসে। এর আগে ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই দুপুরে রাজধানীর র‌্যাডিসন ব্লুর উল্টোদিকের রাস্তায় জাবালে নূর পরিবহনের বাসচাপায় নিহত হন শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী আবদুল করিম রাজীব (১৭) ও দিয়া খানম মিম (১৬)। ওই ঘটনায় আহত হন আরও ৯ জন। ওই দিনই জাবালে নূর বাসের (ঢাকা মেট্রো বি-১১-৭৬৫৭) নিবন্ধন বাতিল করে বিআরটিএ। দেশব্যাপী শিক্ষার্থী আন্দোলন ও বিভিন্ন মহলের সমালোচনার মুখে গত ২০ মার্চ দুই কোম্পানির সব বাসের রুট পারমিট স্থগিত করে বিআরটিএ। পরদিন সংস্থাটি ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে। জানা গেছে, কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী- সুপ্রভাত কোম্পানির মোট ১৬৩ বাসের মধ্যে মাত্র ১৮টির বৈধ কাগজপত্র রয়েছে। জাবালে নূর পরিবহনের ২৯টি বাসের মধ্যে শুধু ১৩টির প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাওয়া গেছে। সুপ্রভাত পরিবহনের ১৬৩টি বাসের মধ্যে ২৯টি বাসের ফিটনেস সার্টিফিকেট মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, ১৪টির ট্যাক্স টোকেন এবং দুটি বাসের রুট পারমিট মেয়াদ শেষ। ১০৪ বাসের চালকের প্রয়োজনীয় ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। ২৭টি বাসের ড্রাইভিং লাইসেন্সের শ্রেণী সঠিক ছিল না। আইন অনুযায়ী, ড্রাইভারের লাইসেন্সের যোগ্য হতে অন্তত ছয় বছরের ড্রাইভিং অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। পাশাপাশি বাস কোম্পানির ৩২ ড্রাইভারের ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল না। অন্যদিকে, জাবালে নূর পরিবহন কর্তৃপক্ষের ২৯টি বাসের মধ্যে মাত্র সাতটি বাসের কাগজপত্র জমা দেয়। এদের মধ্যে সব প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাওয়া যায় মাত্র ৬টি বাসের। কমিটি বিআরটিএ সার্ভারে সংরক্ষিত ২১টি অন্যান্য বাসের নথি পরীক্ষা করে দেখেছে। এর মধ্যে ১০টি বাসের ফিটনেস সার্টিফিকেট, ট্যাক্স টোকেন এবং রুট পারমিট আপডেট পাওয়া গেছে। বাকি ১১ বাসের যথাযথ কাগজপত্র নেই। কমিটি এই ২১ বাসের ড্রাইভারের লাইসেন্স পরীক্ষা করতে পারেনি। কারণ, এসব কোম্পানি তাদের বাসের চালকদের কোন তথ্য দেয়নি।
×