ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বহুতল ভবনের অগ্নিনির্বাপণে স্বয়ংক্রিয় স্প্রিংক্লার প্রয়োজন

প্রকাশিত: ০৯:০৯, ২ এপ্রিল ২০১৯

বহুতল ভবনের অগ্নিনির্বাপণে স্বয়ংক্রিয় স্প্রিংক্লার প্রয়োজন

মাত্র কিছুদিন আগে পুরাণ ঢাকার চকবাজারের চুরিহাট্টার ভয়াবহ অগ্নিকা-ে নিহত অর্ধ-শতাধিক মানুষের করুণ মৃত্যুর শোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আধুনিক ঢাকার বনানীতে ঘটে গেল আরেক ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ঘটনা, যেখানে ২৬ জনের করুণ মৃত্যু হয়েছে এবং প্রায় অর্ধ-শতাধিক আহত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে। দেশে অগ্নিকা- বলা যায় নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। প্রতিনিয়তই দেশের কোথাও না কোথাও অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটছে। তবে সেসব ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি বা হতাহতের ঘটনা তেমন হয় না বলে সেগুলো নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য হয় না। যেসব অগ্নিকা-ের ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি এবং হতাহতের ঘটনা বেশি হয় সেগুলো নিয়েই চলে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা। তাজরিন গার্মেন্টস, নিমতলির ভবন, চকবাজারের চুরিহাট্টার ভবন এবং সর্বশেষ বনানীর এফআর ভবনের অগ্নিকা-ের ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি এবং হতাহতের পরিমাণ এতটাই ব্যাপক যে এসব দুর্ঘটনা দেশের মানুষকে তো বটেই, বিদেশীদেরও ব্যথিত করেছে। এভাবে মানুষের অবহেলার কারণে সংগঠিত দুর্ঘটনায় অসংখ্য মানুষের অসহায় মৃত্যু কখনই কাম্য হতে পারে না এবং এটি মেনেও নেয়া যায় না। আগে ধারণা করা হতো যে পুরাণ ঢাকার ঘিঞ্জি পরিবেশের কারণেই হয়ত সেই এলাকায় অগ্নিকা-ের ঝুঁকি আছে। কিন্তু আধুনিক নতুন ঢাকার অভিজাত এলাকায় অবস্থিত বহুতল ভবনের অগ্নিকা-ে এত ব্যাপক হতাহতের ঘটনা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল যে নতুন পুরাণ সমগ্র ঢাকাই অগ্নিকা-ের ঝুঁকিতে রয়েছে। যে কোন ধরনের ভূমিকম্পের কথা তো কল্পনা করতেই গা শিউরে উঠে। একটি দেশের রাজধানী শহর যেভাবে গড়ে উঠা উচিত ছিল সেটি তো হয়ইনি, উল্টো ঢাকা দেশের উন্নয়নের একমাত্র কেন্দ্রবিন্দু হওয়ায় এটি এমন জনবহুল শহরে পরিণত হয়েছে যে পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। কোন দুর্ঘটনা ঘটলে তা নিয়ন্ত্রণ করা দুরহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়, তা সে যত উন্নত ব্যবস্থাই প্রয়োগ করা হোক না কেন। ফায়ার সার্ভিসসহ অন্যান্য সংস্থার দক্ষতা এবং সক্ষমতা দেখে আমরা যারা উন্নত দেশে বাস করি তারাও হতবাক হয়ে যাই। প্রজাতন্ত্রের অন্যান্য কর্মচারী-কর্মকর্তাদের তুলনায় অনেক কম বেতন-ভাতা পেয়েও যে দক্ষতা ও সাহসিকতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলা করে অগ্নিনির্বাপণ থাকে এবং উদ্ধারকাজ পরিচালনা করে থাকে তা সত্যি প্রশংসনীয়। বছর দুয়েক আগে টরনটো শহরে আমার অফিসের সামনের একতলা একটি ভবনে আগুন লেগেছিল। উন্নত দেশের সর্বাধুনিক ফায়ার কোডের সকল বিধান মেনে নির্মিত সেই ভবনের আগুন নির্বাপণ করতে এখানকার প্রায় অর্ধশত ফায়ার কর্মীর পুরো একদিন সময় লেগেছিল। উল্লেখ্য, এসব উন্নত দেশের ফায়ার কর্মীদের সর্বোচ্চ বেতন-ভাতা প্রদান করা হয়, কারণ এ কাজে তাদের জীবনের ঝুঁকি থাকে। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠে ঢাকা শহর বর্তমানে যে অবস্থানে এসেছে তাতে করে এই শহরের ভবন ঝুঁকিমুক্ত করা দুরূহ এক কাজ। এখানে ভবনের সঙ্গে ভবন সংলগ্ন করে নির্মিত হয়েছে হাজার হাজার বহুতল ভবন। অথচ তার নিরাপত্তার ন্যূনতম মানও রক্ষা করা হয়নি। গত বছর ঢাকায় বেড়াতে গিয়ে মোহাম্মদপুরের জাপান গার্ডেন সিটির বহুতল ভবনের একটি এপার্টমেন্টে আমার ভাইয়ের বাসায় থাকতে হয়েছিল। ওই এপার্টমেন্টে থাকার সময় একটি আতঙ্কই কাজ করছিল যে। অগ্নিকা- তো দূরের কথা, যেনতেন দুর্ঘটনা ঘটলেও এখান থেকে উদ্ধার পাবার কোন সম্ভাবনা নেই এবং অসায়াহের মতো মৃত্যুবরণ করতে হবে, যেমনটা করতে হয়েছে পুরাণ ঢাকার চুরিহাট্টায় এবং বনানীর এফআর ভবনের বাসিন্দাদের। প্রতিটা দুর্ঘটনা ঘটার পর অনেক হৈচৈ পড়ে যায়, আলোচনা-সমালোচনাও হয় অনেক এবং কিছু উদ্যোগ গ্রহণের কথাও শোনা যায়, কিন্তু বাস্তবে কিছুই হয় না। কেননা ঢাকা শহর বর্তমানে যে অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে তাতে ইচ্ছে করলেও অনেক প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা বাস্তবে সম্ভব হয়ে ওঠে না। যেমন কর্তৃপক্ষ চাইলেও অনেক ভবন ভেঙ্গে সম্পূর্ণ নিয়ম মেনে নতুন ভবন নির্মাণের ঘোষণা দিতে পারলেও বাস্তবে কার্যকর করা সম্ভব হয়ে উঠবে না। তারপরও কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করে এই ধরনের দুর্ঘটনার সম্ভাবনা এবং দুর্ঘটনার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ যথেষ্ট পরিমাণে কমিয়ে আনা সম্ভব। তেমন একটি উদ্যোগ হলো দেশের বহুতল ভবনগুলোতে স্বয়ংক্রিয় স্প্রিংক্লার স্থাপন করা। আমাদের দেশে বহুতল ভবনে এই ধরনের অত্যাধুনিক অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থার প্রচলন একেবারেই নেই। সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জরুরী ভিত্তিতে দেশের প্রতিটা বহুতল ভবনে স্বয়ংক্রিয় স্প্রিংক্লার স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। অগ্নিকা-ের ঘটনা রোধে এবং অগ্নিকা-ের কারণে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ লাঘবে এই ব্যবস্থা দারুণ কাজ করে থাকে। এই ব্যবস্থার অধীনে বহুতল ভবনের প্রতিটা তলা বা ফ্লোরের সিলিং-এ সরাসরি পানির লাইনের মাধ্যমে কিছু স্প্রিংক্লার পয়েন্ট স্থাপন করা হয়। স্প্রিংক্লারের পাইপটি সেই ভবনের স্বতন্ত্র একটি পানি সরবরাহ পাইপের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে, যেখান থেকে সার্বক্ষণিক পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়। প্রতিটা তলা বা ফ্লোরের আয়তন অনুযায়ী নির্দিষ্ট সংখ্যার স্বয়ংক্রিয় স্প্রিংক্লার সিলিংয়ের ওপর স্থাপন করা হয়। আর স্প্রিংক্লারের মুখ এক বিশেষ ধরনের ধাতব পদার্থ দ্বারা তৈরি ভাল্ব দিয়ে বন্ধ করে রাখা হয়। এই ধাতব পদার্থ নির্দিষ্ট একটি তাপমাত্রায় গলে যায়। ফলে কোন ভবনে আগুন লাগলে সেই আগুনের তাপে ধাতব পদার্থের তৈরি ভাল্ব গলে যাওয়ায় স্প্রিংক্লারের মুখ খুলে যায় এবং সঙ্গে সঙ্গে সেই স্প্রিংক্লার দিয়ে তীব্র গতিতে পানি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে, যা আপনাআপনি ভবনের আগুন নেভাতে সহযোগিতা করে। এর ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আগুন যেমন দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে না, তেমনি অনেক ক্ষেত্রে আগুন আপনাআপনি নিভেও যায়। ফলে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এসে তাদের পরিকল্পনা মোতাবেক অগ্নিনির্বাপণ এবং উদ্ধার কাজ পরিচালনা করতে পারে। উন্নত বিশের বহুতল ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে এই স্বয়ংক্রিয় স্প্রিংক্লার স্থাপন যে শুধুমাত্র জনপ্রিয় তাই নয়, রীতিমতো বাধ্যতামূলকও বটে। এখানে কোন বহুতল ভবনে স্বয়ংক্রিয় স্প্রিংক্লার ব্যবস্থাপনা না থাকলে সেই ভবন নির্মাণের অনুমতিই পাওয়া যাবে না এবং সে রকম ভবনে বসবাসের জন্য কোনরকম ছাড়পত্রও পাওয়া যাবে না। বনানীর এফআর ভবনের অগ্নিকা-ের ঘটনা নিয়ে আমার এখানকার স্থানীয় অনেক সহকর্মী এবং বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আলোচনা করার সময় তারা কোনভাবেই বিশ্বাস করতে পারছিল না যে, এ রকম বহুতল ভবনে কোন রকম স্বয়ংক্রিয় স্প্রিংক্লার স্থাপন করা হয়নি। আমি তাদের কোনভাবেই বোঝাতেও সক্ষম হইনি যে, আমাদের উন্নয়নশীল দেশে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে এই ধরনের ব্যবস্থার প্রচলন নেই। আমাদের দেশের বহুতল ভবনে এই ব্যবস্থা প্রবর্তনের ক্ষেত্রে অনেকেই যুক্তি দিয়ে থাকতে পারেন যে, এ রকম ব্যবস্থা উন্নয়নশীল দেশের, বিশেষ করে আমাদের প্রতিবেশী দেশের ভবন নির্মাণেও ব্যবহার করা হয় না। আমাদের দেশের সমস্যা আমাদেরই সমাধান করতে হবে। অন্যদেশ কি করেছে বা করেনি সেটির দিকে গুরুত্ব না দিয়ে আমাদের সমস্যা সমাধানে যা করা প্রয়োজন তাই করতে হবে। যদি সেটি উন্নত বিশ্বের কোন প্রযুক্তি হয় তা গ্রহণ করতেও কোনরকম দ্বিধা থাকার কথা নয়। তাছাড়া প্রযুক্তি গ্রহণে এবং আধুনিকতার দিক থেকে আমাদের দেশে পৃথিবীর বহু উন্নয়নশীল দেশের চেয়ে অনেক অগ্রসর। সেই বিবেচনায় অগ্নিনির্বাপণে এই ধরনের উন্নত প্রযুক্তি গ্রহণে কোন অসুবিধা থাকার কথা নয়। কেননা এর সঙ্গে দেশের জানমালের ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দেশের ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা উন্নত বিশ্বের ফায়ার সার্ভিস বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের কাছ থেকে এই প্রযুক্তি ব্যবহারের ব্যাপারে বিস্তারিত ধারণা নিতে পারেন এবং প্রয়োজনে তাদের সহযোগিতাও নিতে পারবেন। আমাদের দেশে অনেক প্রথিতযশা প্রকৌশলী আছেন, তারাও এ ব্যাপারেও সহযোগিতা করতে পারবেন বলেই আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। সেইসঙ্গে ওয়াসার মাধ্যমে একটি স্বতন্ত্র ফায়ার হাইড্রেন্ট লাইন স্থাপন করা প্রয়োজন জরুরী ভিত্তিতে। এই লাইন থেকে ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের সুপারিশ অনুযায়ী নির্দিষ্ট স্থান অন্তর অন্তর ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন করে রাখতে হবে। এতে করে কোন ভবনে আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের আর পানির উৎস খোঁজার জন্য কোন বেগ পেতে হবে না এবং ভবনের ত্রুটিপূর্ণ পানি সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর নির্ভরও করতে হবে না। এই ব্যবস্থাগুলো আপাতদৃষ্টিতে ব্যয়বহুল মনে হতে পারে। তবে ব্যবস্থাটি এতটাই অত্যাবশ্যক এবং জরুরী যে মূল্য বা ব্যয় কোনভাবেই বিবেচ্য বিষয় হতে পারে না। লেখক : ব্যাংকার টরনটো, কানাডা
×