ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মমতাজ লতিফ

ডাকসু ॥ অপকৌশলহীন প্রকৃত গণতন্ত্র চর্চা করতে হবে

প্রকাশিত: ০৯:০৭, ২ এপ্রিল ২০১৯

ডাকসু ॥ অপকৌশলহীন প্রকৃত গণতন্ত্র চর্চা করতে হবে

জাতি পর্যবেক্ষণ করছে দীর্ঘ আটাশ বছর পর সংঘটিত হওয়া ডাকসু নির্বাচন ও নির্বাচনে বিজয়ী নেতা-নেত্রীদের। দেখা যাচ্ছে এদের নির্বাচিত ভিপির ক্ষণে ক্ষণে মত পরিবর্তন করার দৃষ্টিকটু আচরণ। একে, এর পাশে আরও দু’চেয়ারম্যানকে কোটা সংস্কার আন্দোলনে সামনের সারিতে জাতি দেখেছিল। এদের রাজনৈতিক আদর্শের বিষয়ে সে সময় অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছিল। এরই মধ্যে মধ্যরাতে ভিসির বাড়িতে একদল জঙ্গী দুর্বৃত্ত স্মরণকালের এক ভয়াবহ তা-ব চালায়, ’৭১-এর রাজাকারদের মতোই লুটপাট, ভাংচুর, কয়েকটি গাড়িতে অগ্নিসংযোগ, ভিসির পরিবারের সদস্যদের নিজস্ব গয়না, অর্থ, মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে, বাড়ির বাথরুমের স্যানিটারি জিনিসপত্র পর্যন্ত ভাংচুর করে পুরো জাতিকে স্তম্ভিত করে দেয়! কিন্তু এ তরুণরা সে সময় ওইসব অপকর্মের নিন্দা করেনি! আমার মনে হয় না এসব হামলা, ভিসির প্রাণ সংশয় করা অপকর্ম যারাই করুক কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা-নেত্রীরা তাদের কাউকে চেনে নাÑ এটি যেমন হতে পারে না, তেমনি এই নেতা-নেত্রীরা পরদিন এ ঘটনার জন্য ভিসির কাছে, জাতির কাছে, দুঃখ প্রকাশ এবং তাদের আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করছে একটি মহল যারা চিহ্নিত মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বিরোধী, সে কারণে জাতির কাছে ক্ষমা চেয়েছে বলেও মনে পড়ে না! দীর্ঘদিন যাবত রোকেয়া হল, যেটি ছাত্রী জীবনে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আগের সময়টিতে গৌরবজনক ছাত্র আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল, সে হলে শুনতে পাই মুক্তিযুদ্ধবিরোধী একটি ছাত্রী সংঘের অবস্থান রয়েছে, যারা কোটা সংস্কার আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিল। কোটা অথবা দুর্ঘটনাহীন রাজপথ, পরিবহন ব্যবস্থার জন্য আন্দোলন ছাত্রছাত্রীদের জন্য স্বাভাবিক ও ন্যায্য আন্দোলন অবশ্যই। কিন্তু বর্তমানের ছাত্রছাত্রীদের সতর্কতার সঙ্গে আন্দোলন করতে হবে, যেন কোন অবস্থাতেই আন্দোলনের ভেতর মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি, সমর্থক অনুপ্রবেশ করে আন্দোলনকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বর্তমান সরকার বিরোধী, সরকার পতন আন্দোলনে রূপ দিতে না পারে। ছাত্রছাত্রীদের বলব, বাঙালী জাতির সবচেয়ে বড় শত্রু হচ্ছে- মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শ বিরোধী শক্তি এবং তাদের দীর্ঘকালীন মিত্র, তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান। এদের চেনার জন্য আমি বহু কলাম লিখেছি, আরও কেউ কেউ লিখেছে। এরা দু’জন এবং নিহত জিয়াউর রহমান শুধু যে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের আশ্রয়-প্রশ্রয়, পুরস্কার দিয়েছে তা নয়, কয়েকটি অপরাধ- হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুট ও ধর্মান্তরকরণের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যারা জড়িত ছিল না, তাদের ’৭৩ সালে ক্ষমা ঘোষণার পর বাকি এগারো হাজার প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীর বিচার চালিয়ে যাচ্ছিলেন বঙ্গবন্ধু। অথচ জিয়া ক্ষমতা গ্রহণ করেই প্রথমে এদের বিচারের জন্য ব্যবহৃত ‘দালাল আইনটি’ নিষিদ্ধ করে ওই এগারো হাজার যুদ্ধাপরাধীকে জেল থেকে মুক্তি দেয়! পলাতক যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযম, নিজামী, সাঈদী, মুজাহিদকে দেশে আসতে দিয়ে নিষিদ্ধ হওয়া ধর্মভিত্তিক রাজনীতি চর্চা করার সব রকম সুযোগ করে দেয়। তারা দ্রুত নাগরিকত্ব ফিরে পেয়ে লুটপাটের সম্পদ দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য, হাসপাতাল, শিল্প, ব্যাংক, বীমা ইত্যাদি করে বিপুল সম্পদের মালিক হয়। এরাই ছাত্র-শিবিরকে নতুন প্রজন্মের আলবদর হিসেবে গঠন করে পরবর্তীতে তারেকের নিজস্ব উদ্যোগে গঠিত জেএমবি, হরকত-উল-জিহাদ, হিযবুত তাহ্রীর, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ইত্যাদি প্রায় পঞ্চাশের বেশি মৌলবাদী জঙ্গী দল তৈরি করে বাঙালী সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানা শুরু করে। ছাত্রছাত্রীদের স্মরণ রাখতে হবে, এরাই ছায়ানটের পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান বন্ধ করার জন্য শুধু বোমা মেরে তরুণ, তরুণী হত্যা নয়, এই কয়েক বছর আগে পর্যন্ত তরুণীদের শ্লীলতাহানির মতো বিশাল অপরাধ করেছিল, যার এখনও বিচার সম্পন্ন হয়নি। এরপর এই জঙ্গীরা একে একে যাত্রা পালা, গায়ক, শিল্পী, লালন সাধক ও সঙ্গীতশিল্পী, বাংলার মেলা, নারী মেলা, সিনেমা হলের ওপরও বোমা হামলা করে বাঙালী সংস্কৃতির চর্চা বন্ধ করতে চেষ্টা করে। এরপর এরা টার্গেটেড হামলা চালিয়ে হত্যা করে হুমায়ুন আজাদের মতো প্রগতিশীল কবি, গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক তরুণদের, বিজ্ঞান মনস্ক, মুক্তচিন্তার ধারক-বাহক অভিজিৎ, দীপন, অনন্ত, দীপ, তনয়সহ প্রায় বিশ তরুণকে! এখন ছাত্রছাত্রীদের বুঝতে হবে বাঙালী জাতির মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা বাঙালী জাতীয়তাবাদ, বাঙালীর সমৃদ্ধ ভাষা, সঙ্গীত, সাহিত্য, যাত্রা, পুুঁথি-সাহিত্য, অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্মনিরক্ষেতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের পক্ষের শক্তিই হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তি। এদের বিপক্ষের শক্তি হচ্ছে যুদ্ধাপরাধী ও তাদের মিত্র শক্তি, যারা হত্যা লুট-ধর্ষণ-জঙ্গীবাদী কর্মকা- দ্বারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীদের ‘মুরতাদ’ ‘কাফের’ বলে ধ্বংস করতে ’৭১ থেকে আজ পর্যন্ত বার বার চেষ্টা করে চলেছে এবং বার বার নিজেদের অপরাধ, অপরাজনীতি দ্বারা তারা যে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশবিরোধী সেটি প্রমাণ করে চলেছে। সুতরাং ভিসির বাড়িতে আক্রমণ তারাই করেছে যারা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের শত্রুপক্ষ, যারা পেট্রোলবোমা চালিয়ে নিজ জাতির নিরীহ বাস-ট্রাক-চালক, এসবের যাত্রী, যানবাহন, রাজপথ, হাজার হাজার বৃক্ষ কর্তন করে দেশকে চরম অস্থিতিশীল করে স্বাধীন বাংলাদেশের উন্নয়নকে বার বার বাধাগ্রস্ত করেছে, এখনও করার চেষ্টা করছেÑ এ কথা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের বুঝতে হবে। এখন প্রশ্ন উঠেছে- বাংলাদেশের উন্নয়ন পেছানোর লক্ষ্যে তারেক রহমান দেশী-বিদেশী শত্রু গোষ্ঠীর সহায়তা নিয়ে নানা রকম দেশ ও জাতি বিরোধী অপতৎপরতা চালাচ্ছে, যার একটি প্রধান লক্ষ্য ছিল ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনকে বিতর্কিত করে সরকারকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ও বহির্বিশ্বে সমালোচিত করে এর গ্রহণযোগ্যতা তলানিতে এনে এর উন্নয়ন সহযোগী দেশগুলোকে বাংলাদেশের প্রতি বিমুখ করে তোলা। অথচ জাতি দেখেছে নির্বাচনের আগে দেশের সব রকম উচ্চ শিক্ষিত পেশাজীবীর দল, তরুণ প্রজন্ম প্রধানমন্ত্রীকে সমর্থন দিয়ে তার পাশে থাকার মত ব্যক্ত করেছে যা প্রমাণ করে যে, আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পক্ষে বিপুল জনসমর্থন রয়েছে। এরা ছাড়াও পুরো তরুণ প্রজন্ম যারা ডিজিটাল বাংলাদেশের সংগঠক তারা আওয়ামী লীগ ও প্রযুক্তি, সংস্কৃতি, ক্রীড়াবান্ধব বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ছাড়া তারা ভোট দেবার জন্য অন্য আর কাউকে দেখছে না, এটাই বাস্তবতা। আওয়ামী লীগের জালভোট, ব্যালট দিয়ে বাক্স ভরার কি কোন দরকার আছে? এ নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত, বিতর্কিত করতে তারেক রহমানের কৌশলটি ছাত্রছাত্রীদের জানা দরকার- ১) বিএনপি-জামায়াতপন্থী কোন নির্বাচন কর্মকর্তাকে দিয়ে আগের রাতে কোন কোন কেন্দ্রে ব্যালট বাক্স ভরানোর কাজটি করানো তারপর সেটি ভোট গণনার আগে বের করা যেটি আগের রাতে সংঘটিত হয়েছিল বলে প্রচার করা হবে। এ রকম ঘটনা একটি কেন্দ্রে সত্যই ঘটেছিল এবং যারা করেছিল, সে সব নির্বাচনী কর্মকর্তা গ্রেফতার হয়েছে এং নির্বাচনটি বাতিল হয়েছে। ২) কিছু ক্যাডার তরুণকে দিয়ে ভোটারদের ভোট দিতে বাধা দেয়া, বলা যে, আপনার ভোট দেয়া হয়ে গেছে ৩) বিদেশ থেকে আসার কথা ছিল একদল বিদেশী পর্যবেক্ষক, তাদের সঙ্গে প্ল্যান ছিল তাদের দিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বলানো হবে, অবশ্যই তা অর্থের বিনিময়ে যে, এই নির্বাচনে ভোট কারসাজি হয়েছে, আগের রাতে ব্যালট বাক্স ব্যালট দিয়ে ভরা হয়েছে ইত্যাদি! এই দলটি ভিসা না পাওয়ায় বাংলাদেশে আসতে পারেনি বলে এই জাতীয় নির্বাচন এবং বাঙালী জাতি বিশাল এক বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছে। ঠিক একই কৌশল গ্রহণ করে ডাকসু নির্বাচনকে বানচাল করার পরিকল্পনা হয়। তার প্রমাণ হিসেবে রোকেয়া হল বা অন্য কোন এক হল থেকে ব্যালট ভরা যে বস্তা পাওয়া গেছে, দেখা গেছে সে ব্যালটগুলো ছিল ফটোকপি, ক্রসের চিহ্ন ছিল কলমের, যা হওয়ার কথা সিলের ক্রস চিহ্ন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপি-জামায়াতপন্থী শিক্ষকরা অননুমোদিতভাবে নির্বাচন পর্যবেক্ষক হিসেবে তারেকের শেখানো বুলি আওড়াচ্ছেনÑ ব্যালট বাক্স আগের রাতে ভরে রাখা হয়েছে, ভোটদানে বাধা দেয়া হয়েছে, তাই পুনর্নির্বাচন দিতে হবে ইত্যাদি। ঠিক এই মিথ্যা প্রচারগুলোই জাতীয় নির্বাচনকে অগ্রহণযোগ্য ও বিতর্কিত করতে ব্যবহার করা হয়েছে! এর সঙ্গে রয়েছে নির্বাচন বর্জন করা বা অর্ধেক দিনে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করার অপকৌশল। ছাত্রছাত্রীদের বুঝতে হবে জাতীয় রাজনীতিতে এদের অনুসরণ করে দেশ ও জাতির জন্য প্রকৃত সৎ রাজনীতির চর্চা করা এক কথায় অসম্ভব। তাদের এও বুঝতে হবে, নির্বাচন বর্জন করা, অর্ধেক দিনে প্রার্থিতা প্রত্যাতার করার ‘নাটক’ কখনই গণতন্ত্র চর্চার পন্থা নয়। তা হলে ডাকসু নির্বাচন যেটি আটাশ বছর পর সংঘটিত হলো, সেখানেও তারেকের অপকৌশল নির্বাচন বর্জন বা অর্ধেক দিন পর বর্জন করা, প্রার্থিতা প্রত্যাহার করা কেন দেখা গেল? আটাশ বছর পরে সংঘটিত হওয়া ডাকসু নির্বাচনে এ মন্দ কৌশল একেবারেই কাক্সিক্ষত ছিল না এবং এটি তারেকের অশুভ আর অপগণতন্ত্র চর্চার অনুসরণ, যা উচ্চ শিক্ষায় অগ্রসরমান ছাত্রছাত্রীর কাছে অনভিপ্রেত। তাদের বুঝতে হবে কারা এ ধরনের কৌশল অবলম্বন করে ‘আওয়ামী লীগ’ সরকারকে বিপদে ফেলে! তাদের সেই সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য- আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রাপ্ত বাংলাদেশকে, বাঙালীকে উন্নয়নের সব ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত করা এবং অনুন্নত দেশে পরিণত করা। আশ্চর্য ও দুঃখজনক যে, বাম ঘরানার বড় নেতা যেমন, তেমনি ছাত্র নেতারাও তারেকের সুরে সুর মিলিয়ে একই কথা বলছে- নির্বাচন হয়নি, পুনর্নির্বাচন দিতে হবে। এদের বলছি, আওয়ামী লীগকে ভোট না দিয়ে অন্য কাকে ভোট দিত জনগণ? দেশ ও জাতি চায় উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে দেশের ভবিষ্যত নেতা-নেত্রী বের হয়ে এসে দেশের গণতন্ত্র চর্চার ভিতকে সুদৃঢ় করুক এবং দেশকে বাধাহীনভাবে উন্নয়নের পথে নিয়ে যাবার যোগ্য নেতৃত্ব- গুণ অর্জন করে যোগ্য নেতা-নেত্রী দেশের হাল ধরুক। লেখক : শিক্ষাবিদ
×