ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধ ’ ৭১

বাবা তোমার বুকের কোন্দিকটায় বিঁধেছিল ওই তিন বুলেট

প্রকাশিত: ০৯:০০, ১ এপ্রিল ২০১৯

  বাবা তোমার বুকের কোন্দিকটায় বিঁধেছিল ওই তিন বুলেট

ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান ॥ বাঙালীর মহান স্বাধীনতার মাস মার্চ। এ মাসেই আমার জন্মদাতা প্রিয় বাবা জীবন বিলিয়ে দিয়েছিলেন এ জাতির স্বাধীনতা অর্জনের জন্য। আমি গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি নাম জানা-অজানা শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের। আরও শ্রদ্ধা জানাই সম্ভ্রম হারানো অসংখ্য মা-বোনের প্রতি। সে সঙ্গে প্রিয় মাতৃভূমিকে পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত করার দীপ্ত শপথে বলীয়ান হয়ে জীবনবাজি রেখে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ দেশমাতৃকার সূর্যসন্তান তথা মুক্তিযোদ্ধাদের যথার্থ মূল্যায়ন ও তাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য সশ্রদ্ধ কৃতজ্ঞতা জানাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। স্বাধীনতা-পরবর্তী দীর্ঘ সময়ে দেশের বাইরে অবস্থানের কারণে মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিতে সক্ষম না হলেও একাত্তরের রণাঙ্গনের একজন যোদ্ধা হিসেবে আজও আমি গর্বিত এবং নিজেকে সার্থক বলে মনে করি। আর সেই উপলব্ধি থেকেই আজ আমার স্মৃতিচারণ। গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে; যার সঠিক নির্দেশনা ও সফল নেতৃত্বে এ দেশের আপামর জনগণ হানাদারদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র সংগ্রামের বিনিময়ে প্রিয় মাতৃভূমিকে বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। সেই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ নিয়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর গুলিতে আমার বাবার বিরোচিত আত্মদানের মাধ্যমে শহীদ হওয়ার গৌরবের স্বীকৃতিস্বরূপ স্বাধীনতা পরবর্তীকালে আমার বিধবা মা ইয়ারজান বিবিকে বঙ্গবন্ধুর সমবেদনা জ্ঞাপনসহ স্বীকৃতিস্বরূপ ও আর্থিক অনুদান প্রদানের ঘটনা আমাদের পরিবারকে চিরকৃজ্ঞতার বাধনে আবদ্ধ ও গৌরবান্বিত করেছে। বঙ্গবন্ধু স্বাক্ষরিত আমার পিতার শহীদী স্বীকৃতিও সমবেদনাপত্র আমি ও আমার মাসহ আমাদের পরিবারের এ যাবতকালের সবচেয়ে বড় অর্জন বলে আমরা মনে করি। মহামূল্যবান সেই প্রাপ্তিটুকু ১৯৭২ সাল থেকে অদ্যাবধি সযত্নে লালন করে চলেছি এবং সেই প্রাপ্তির বদৌলতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী দু’বার আমার সরকারী চাকরির মেয়াদ বাড়িয়ে শহীদ পরিবারের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। এজন্য বঙ্গকন্যা শেখ হাসিনার কাছেও আমার পরিবার চিরকৃতজ্ঞ। আমার বাবা শহীদ আবদুস সামাদ বিগত ২ এপ্রিল ১৯৭১ পাক হানাদার বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শহীদ হন। ২৭ মার্চ পাক হানাদার বাহিনী চট্টগ্রাম শহরে বিভিন্ন লোকালয়ে ঢুকে পড়ে এবং তখন আমার পিতা নিজ উদ্যোগেই শহরের ঝাউতলা, সেগুন বাগান, সরদার নগর ও টিকেট প্রিন্টিং প্রেস এলাকায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে উনারই নেতৃত্বেই শুরু হয় অসম এক যুদ্ধ। ৭ মার্চ ১৯৭১ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর চট্টগ্রামের রেলওয়ে এলাকায় বসবাসরত বাঙালী ও অবাঙালী কর্র্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে এক যুদ্ধংদেহী মনোভাব সৃষ্টি হতে থাকে। আমাদের পরিবারের অজান্তেই আমার বাবা পাক হানাদারদের প্রতিহত করতে সংগঠিত হচ্ছিলেন এবং এটার বহির্প্রকাশ দেখলাম ২৬ মার্চ ১৯৭১ বিশাল এক লাঠিয়াল বাহিনী নিয়ে উনি প্রতিহত করলেন সেগুন বাগান কলোনি থেকে আসা অবাঙালী গুন্ডাদের। ঠিক তেমনিভাবে রেলওয়ে কলোনিতে অবস্থানরত অবাঙালীদেরও সুরক্ষা দিয়েছিলেন বাঙালী গুন্ডা বাহিনীর হাত থেকে। মুক্তিযুদ্ধের ঊষালগ্নে পিতার নেতৃত্বাধীন সেই যুুদ্ধে আমিও অংশ নিই এবং দেশকে শত্রুমুক্ত করার দীপ্ত শপথে বলীয়ান হয়ে উঠি। ২৭ মার্চ ১৯৭১ তাকে একপর্যায়ে বিমর্ষ অবস্থায় দেখালেও উনি একবারও বুঝতে দেননি অচিরেই উনি শহীদ হতে যাচ্ছেন। ১ এপ্রিল ১৯৭১ রাতের বেলা বাবার সঙ্গে এক বিছানায় ঘুমানোর সময়ও দেখেছি উনার প্রচন্ড অস্থিরতা। ২ এপ্রিল কিছু অবাঙালী বিশ্বাসঘাতকদের সহায়তায় পাক সেনাদের হাতে আমার বাবা শহীদ হন। বাবার অস্থির গতিবিধি উনাকে ইঙ্গিত দিয়েছিল কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে এবং শেষ মুহূর্তে তিনি আমাদের পরিবারের সব সদস্যদের তুলে দিয়েছিলেন এক সহকর্মীর হাতে। আমরা বেঁচে গেলাম বাবার আত্মোৎসর্গের মাধ্যমে। তারপরের ঘটনা অনেক লম্বা। দীর্ঘ ৫ দিন হেঁটে, ট্রেনে, রিক্সায় ও লঞ্চে করে আমাদের শরীয়তপুরের গ্রামের বাড়িতে আসা। পরবর্তী সময়ে নিজেও বিভিন্ন অপারেশনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশকে স্বাধীন করলাম। বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য বাংলাদেশ তখন বঙ্গবন্ধুর হাতে। আমি ও আমার পরিবার অত্যন্ত সৌভাগ্যবান এ জন্য যে, ১২ সেপ্টেম্বর’ ১৯৭২ আমরা বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে এসেছিলাম। শুধু সান্নিধ্য নয়, বঙ্গবন্ধু আমাকে ও মাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। সেই দুর্লভ মুহূর্তের সাক্ষী ছিলেন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান। সেদিনের ২০ মিনিটের দুর্লভ মুহূর্তের কিছু স্মৃতি এখনও অম্লান। রমনা পার্কের উল্টো দিকে গণভবনের নিচ তলায় আমি আর আমার মা একটি সোফায় বসে আছি। এক কোণে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান। বঙ্গবন্ধু দোতলা থেকে নেমে আসলেন। আমরা দাঁড়িয়ে গেলাম। কোন কথা না বাড়িয়ে আমার মাকে ‘মা’ সম্বোধন করে আমাদের দুজনকে জড়িয়ে ধরলেন। আমরা বসলাম। বঙ্গবন্ধু জিল্লুর রহমানকে বললেন সনদপত্র আর দুই হাজার টাকার চেকটা দিতে। সনদপত্র স্বাক্ষর করে তুলে দিলেন আমার মার হাতে। এ সময় উনি জানতে চাইলেন আমাদের পরিবারের সদস্য সংখ্যা ও কে কি করছে। একপর্যায়ে জিল্লুর রহমানকে বললেনÑ উনার ছোট মেয়ে (খালেদা স্বপ্না) বিবাহযোগ্য না হওয়া পর্যন্ত চট্টগ্রামের বাসভবন উনাদেরই থাকবে। মা তখন খুব আবেগআপ্লুত হয়ে বঙ্গবন্ধুকে বললেন, ‘বাবা চট্টগ্রামে আমার স্বামী শহীদ হয়েছে, পারলে অন্য কোথাও আমাকে একটা থাকার জায়গা দেন।’ সেই তখন থেকেই ৭/৪, আওরঙ্গজেব রোড়, মোহম্মদপুর, ঢাকা ছিল আমার মা’র বাসস্থান ও ঠিকানা। আজ মাও নেই, বাবা আমার মানসপটে প্রতিদিন আসে। দুই চোখে দেখছি স্বাধীনতার আনন্দ। কিন্তু তার মাঝে যে শূন্যতা, তা পূরণ করব কি দিয়ে? কোথায় পাব বাবার লাশ কোথায় গেলে দেখতে পাব তার বুলেটবিদ্ধ বুক? দীর্ঘ ৪৮ বছর ধরে খুঁজছি বাবাকে। কিন্তু বুকের শূন্যতা পূরণ করতে পারছে না কিছুই। জীবনের শেষপ্রান্তে এসে বাবাকে হারানোর বেদনা কেন জানি আরও তীব্র হচ্ছে আমার মনে। প্রতিবছরে এপ্রিল এলে বাবার শাহাদাতবার্ষিকী পালন করি। কিন্তু কোথাও মিলে না তার দেখা। আমার ভালবাসার এ মানুষটিকে হয়ত দেখব মৃত্যুর পর। তখন কি আমি বলতে পারব, ‘বাবা তোমার বুকের কোন্দিকটায় বিঁধেছিল ওই তিন বুলেট।’ লেখক : প্রাক্তন প্রিন্সিপাল অফিসার, নৌ বাণিজ্য অধিদফতর, চট্টগ্রাম
×