ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সিডনির মেলব্যাগ ॥ ক্রাইস্টচার্চের নারকীয়তা ॥ কোথায় পরিত্রাণ, কোথায় উদ্ধার?

প্রকাশিত: ০৮:৪৪, ২০ মার্চ ২০১৯

সিডনির মেলব্যাগ ॥ ক্রাইস্টচার্চের নারকীয়তা ॥ কোথায় পরিত্রাণ, কোথায় উদ্ধার?

নিউজিল্যান্ডের ঘটনায় মানুষ আজ স্তব্ধ। যেন জানের বদলা জান নিতে নিতে সভ্যতা উজাড় করে দেয়া। মনীষীরা বলেছিলেন, চোখের বদলা চোখ নিতে নিতে মানুষ একদিন অন্ধ হয়ে যাবে। যেন তার প্রতিচ্ছবি দেখলাম ক্রাইস্টচার্চে। কিউইদের দেশ সাধারণত শান্তিপূর্ণ বলে পরিচিত। এর কারণও আমাদের জানা। যখন থেকে বুশ, ব্লেয়ার, সাদ্দাম হোসেন, গাদ্দাফির রাজনীতি শুরু তখন থেকে দুনিয়া অশান্ত। মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ বা যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা নিয়ে বুশ যখন ঘোষণা দিলেন আমার সঙ্গে না থাকলে তুমি দুশমনের দলে তখনও এই দেশ কারও দিকে যায়নি। আমেরিকা, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া এমনকি নেপথ্যে ইউরোপ যখন এক কাতারে তখন পাশ্চাত্যমুখী সমাজ ও উন্নত দেশ নিউজিল্যান্ড ঘোষণা দিয়েছিল তারা কোন দলে নেই। সে সময়কার প্রধানমন্ত্রী হেলেন ক্লার্ক তার অবস্থান নিয়েছিলেন শান্তির শর্তে। তখন থেকে ধারণা করা হয়েছিল, এই দেশ আর যাই হোক সন্ত্রাসের শিকার হবে না। ইসলামী জঙ্গী নামের কেউ সে দেশে হামলা করেনি বা করবে এমন কোন পরিকল্পনাও শোনা যায়নি। তাহলে সে দেশে কেন এই নির্মম হত্যাকা-? তাও মসজিদে। হত্যাকারী অবশ্য তার লিখিত ইশতেহারে বলে দিয়েছে কেন এই দেশকে বেছে নেয়া হয়েছে। তার মতে এ কাহিনী মধ্যপ্রাচ্যে হলে মিডিয়া ফোকাস পাবে না। সেখানে মানুষ মারা পাখি হত্যা সমান বিষয়। এ ঘটনাই প্রমাণ করে মানুষের জীবন কত তুচ্ছ সেখানে। আর একটা বিষয় এইÑ মানুষের জীবন দুনিয়ার কোন দেশে কোন সমাজে আর নিরাপদে নেই। ধর্মের নামে দেশে দেশে তার জানমাল অনিরাপদ আর আক্রমণের মুখে। এমন একটা অল্প জনসংখ্যার দেশে এ জাতীয় বর্বর হত্যাকা- বলে দেয় দুনিয়ায় শান্তি বলে কিছু অবশিষ্ট নেই। এবার আমরা অর্থাৎ বাংলাদেশীরাও আক্রান্ত হয়েছি। জান গেছে, আমাদের দেশের মানুষের। যারা ছিলেন নিরপরাধ আর ধার্মিক। ধার্মিক হওয়াটা দোষের না। ধর্ম এক সময় মানুষকে পথ দেখিয়েছিল সমাজ বিশ্লেষক আর ধর্ম নিয়ে গবেষণাকারীরা বলছেনÑ ষোড়শ শতাব্দিতে মানুষ যখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে তেমন জানত না তখন ধর্ম তাদের পথ দেখিয়েছিল। তাদের মতে সপ্তদশ শতাব্দী থেকে ধর্ম ও মানুষের মূল্যবোধ একদিকে যেমন একাত্ম হতে শুরু করেছিল আরেকদিকে প্রশ্ন মাথা চাড়া দিয়ে উঠছিল মনে। সে প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারা মানুষের সঙ্গে ধর্মের ব্যবধান বাড়তে লাগল অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে। এখন এ দুই সত্তা যে মুখোমুখি তা আর বুঝিয়ে বলার দরকার পড়ে না। সে যাই হোক, এবারের ঘটনাটি একদিকে যেমন ক্রোধের আরেক দিকে চরম বেদনার। ক্রোধের কারণ মানুষের বিশ্বাস আর আচরণের ওপর আঘাত। এ কথা বলছি না দেশে দেশে উপাসনালয়ে আগে কোন আক্রমণ হয়নি। এই যে ইমরান খান আগ বাড়িয়ে টুইট করলেন আর তা নিয়ে আমরা মাতামাতি করছি তার দেশে কি এমন ঘটনা বিরল? সেখানেও মসজিদে হামলা হয়। মানুষের জান যায়। এখন যা মানতে মানতে মানুষ বধির ও স্তব্ধ হয়ে গেছে। এটাই ভয়ের। মানুষের সঙ্গে আর যে কোন প্রাণীর এটাই মৌল তফাৎ। মানুষ ভাবতে জানে। তার বিবেক আছে। সে বিবেক এখন বন্দুকের নলের ওপর ভর করে চলে। আর কারও বিবেক খসে পড়ে ঝরে যায় গুলির মুখে। খেয়াল করবেন এই ঘটনাগুলো যারা ঘটায় তারা কোনভাবেই স্বাভাবিক মানুষ না। তাদের এই অস্বাভাবিকতা আর আক্রোশ কোনদিনও বাস্তবায়িত হতে পারত না যদি সমাজ দেশ বা আরও মানুষের ইন্ধন না থাকত। একজন মানুষ চাইলেই বন্দুক নিয়ে ঢুকে আক্রমণ করে কিছু নিরীহ মানুষকে হত্যা করতে পারে না, যদি তার পেছনে কোন অপশক্তি না থাকে। সাধারণ মনের প্রশ্ন একটাই কোথা থেকে আসে এত আগ্নেয়াস্ত্র? কোথায় পাওয়া যায় এগুলো চালানোর ট্রেনিং? তলে তলে যে হিংসা আর প্রতিশোধ জমা হয় এ তো তারই প্রতিফলন। যা আমাদের সবাইকে বিপদে ফেলেছে। নিউজিল্যান্ডের হত্যাকা-ে জড়িত খুনীর পরিচয় রাষ্ট্রীয়ভাবে সে অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক। আমরা থাকি সিডনিতে। যা এদেশের সবচেয়ে জনবহুল বড় শহর। এখন প্রতিশোধ যদি এদিকে হাত বাড়ায় তো কে আছে নিরাপদে? হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ-খ্রীস্টান জুুইস কারও নিরাপত্তা আছে আসলে? এই হানাহানি দুনিয়াকে এমন এক জায়গায় নিয়ে এসেছে যেখানে সরকার কোন ছাড় বন্দুকধারী নিরাপত্তা কর্মী কোন ছাড় স্বয়ং ঈশ্বরও বাঁচাতে পারবেন না। সভ্যতার চূড়ান্ত বিকাশের এই স্তরে ধর্মের প্রয়োজনীয়তা আর ব্যবহার আজ আসলেই প্রশ্নের সম্মুখীন। এ নিয়ে কথা বলাও অনিরাপদ। বিশ্বাসী নামের মানুষরা এসব নিতে পারেন না। তাই এর সমাধান দিতে হবে তাদের যারা ধর্ম নিয়ে কাজ করেন। কিভাবে তারা তা পারবেন বলা মুশকিল। কিন্তু সবাই যখন মানেন মানুষের জীবনই মুখ্য তখন তাদের হাতেই সমাধান। অন্তত চেষ্টা করতে পারেন তারা। নিরাপত্তা কর্মী বা নিরাপত্তা বলয় নামের কোন কিছু এই দায় নিতে অসমর্থ। সেগুলো ভেঙে পড়েছে। শুভবোধ বা মানুষের জাগরণ ছাড়া এই বিপদ থেকে দুনিয়া বের হতে পারবে না। নিউজিল্যান্ডের দুর্ঘটনায় আমাদের জাতীয় ক্রিকেট দলের খেলোয়াড়রা ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছেন। ধারণা করা যায় গুগল দেখে বা ইন্টারনেট দেখে সময় ঠিক করাতেই এই বাঁচা। খুনী যদি আর একটু পরে ঢুকত আরও কয়েক শ’ মানুষ মারা যেতে পারতেন। আজ বাংলাদেশ হতে পারত ক্রিকেট তারকাশূন্য এক দেশ। এটা কত ভয়াবহ আর জঘন্য ভাবলেও শরীর খারাপ হয়। আমাদের দেশের মিডিয়ায় দেখলাম মৃত নিহত বাংলাদেশীদের চাইতে ক্রিকেটারদের জান বাঁচার ঘটনাই পাচ্ছে প্রচার। এটা ঠিক মানতে পারছি না। যে কোন মানুষের জীবনই মূল্যবান। বিশেষত একজন অধ্যাপকও নিহত হয়েছেন। সার্থক অধ্যাপক হওয়া বা জ্ঞান দিয়ে মানুষকে বড় করে তোলার কাজ অনেক বড়। তিনি তাই করেছেন সারাজীবন। তাঁর এই আত্মাহুতিকে বড় করে তোলা মিডিয়ার দায়িত্ব। তবেই ছোটরা সাবধান হবে। জানবে মানুষের জীবন কেন এবং কতটা মূল্যবান। হঠাৎ করে একজন ঘাতকের কারণে নাই হয়ে যাওয়া অর্ধশত মানুষের জীবন কি কেবলই মুসলমান কারও জীবন? না এর সঙ্গে আছে অমানবিকতা ও কাপুরুষতার পরিচয়? ক্রমে সভ্য হয়ে ওঠা মানুষকে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসা মানুষদের জীবন আবার আমাদের আলোকিত করুক। সবার চেয়ে বড় কথা ধর্ম ও সম্প্রদায়ের নামে এই হত্যা এই বিভেদ আর নারকীয়তার অবসান হোক। মুসলমান হোক আর যে ধর্মেরই হোক জীবনের চাইতে বড় কিছু নেই। সকল আগ্রাসনের পেছনে এখন যে অন্ধ বিশ্বাস আর পৈশাচিকতা তার কবল থেকে মুক্তির জন্য মানুষ জাগানোর কাজটি কবে শুরু হবে? রাজনীতি তা করবে না। গণতন্ত্র মানবিকতার ধ্বজাধারী দেশগুলো এখন আর এসবের পরোয়া করে না। আরেকদিকে উগ্রবাদীরা নেয় জঙ্গী প্রতিশোধ। বাঁচার জন্য যে সুন্দর ধরণী তার শেষটুকুও কি হারিয়ে যাবে এদের জন্য? না মানুষই রুখে দাঁড়াবে? নিউজিল্যান্ডের সকল নিহত ও আহত মানুষদের জন্য শ্রদ্ধা ভালবাসা আর শুভ কামনা জানিয়ে বলি, মানুষ আজ কাঁদছে। তার প্রয়োজন অভিভাবক। তার দরকার শান্তির কোন নতুন দূত। কোথায় সেই ভরসা?
×