ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১

সৃজনশীল সাংস্কৃতিক চর্চা বাড়ানো জরুরী

প্রকাশিত: ০৯:০৯, ১৩ মার্চ ২০১৯

সৃজনশীল সাংস্কৃতিক চর্চা বাড়ানো জরুরী

পলিটিক্যাল থিয়েটার বা রাজনৈতিক নাটকের উদ্ভব হয়েছিল বিশ্ব রাজনীতির সঙ্কটময় এক সময়ে। জার্মান নাট্যকার এরভিন পিসকাটর নাটকের জগতে নতুন এক ধারা সৃষ্টি করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হওয়ার ক্ষতিপূরণ দিতে গিয়ে জার্মানির তখন দেউলে হওয়ার দশা। সমাজ ও রাষ্ট্রের নানা সঙ্কট যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর জনজীবনকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল। পরাজিত রাষ্ট্র হিসেবে ক্ষতিপূরণের টাকা গুনতে গুনতে নিঃস্ব জার্মানি। জনগণের দুঃসহ অবস্থা পিসকাটরকে প্রতিবাদী নাট্যকারে পরিণত করেছিল। তার সময়ে আরেক নাট্যকারও রাজনৈতিক বক্তব্যপ্রধান নাটকের জন্য বিশ্বখ্যাত হয়ে আছেন। তিনি বের্ট্রোল্ট ব্রেশট। নাটকের মধ্য দিয়ে জনগণের কথা বলেছেন তারা। চলচ্চিত্রের মাধ্যমে শিল্প সৃষ্টির পথিকৃৎ আমেরিকান চলচ্চিত্রকার ডি ডব্লিউ গ্রিফিথ। রাষ্ট্র ও সমাজের আরেক সঙ্কটকালকে ধরেছেন বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘বার্থ অব এ নেশন’ চলচ্চিত্রে। আমেরিকার গৃহযুদ্ধের পটভূমিতে দু’জোড়া প্রেমিক-প্রেমিকার এ্যাডভেঞ্চারকে কেন্দ্র করে কাহিনী আবর্তিত হলেও চলচ্চিত্রকারের দৃষ্টিতে ওই সময়ের সামাজিক, রাজনৈতিক সঙ্কটই আসলে এ চলচ্চিত্রের মূল উপজীব্য। চলচ্চিত্র বিস্তৃত ক্যানভাসে জীবনের বহুমাত্রিকতাকে ধরতে পারে। যদি পেছনে থাকে সৃজনশীল চলচ্চিত্রকার। সৃজনশীল চলচ্চিত্রকারের বিশাল ভরদ্বাজ দু’হাজার চৌদ্দ সালে নির্মাণ করেন ‘হায়দার’ ছবিটি। ভারতের কাশ্মীরের রাজনৈতিক সমস্যার পটভূমিতে নির্মিত এ চলচ্চিত্রে ভারতীয় সেনাবাহিনী, জঙ্গী রাজনীতি এবং এ দুয়ের সমন্বয় সাধারণ মানুষের জীবনের বিপর্যস্ততা যেভাবে শৈল্পিক নৈপুণ্যে উঠে এসেছে তা সত্যিই অভিনব। কাহিনী বিন্যাসে শেক্সপিয়ারের ‘হ্যামলেট’কে অবলম্বন করেছেন পরিচালক। কাশ্মীরের মতো দ্বন্দ্ব-ক্ষুব্ধ রাজনৈতিক প্রতিবেশকে হ্যামলেটের ট্র্যাজিক আবহের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়ে একই সঙ্গে রাজনৈতিক বক্তব্যনির্ভর ও শিল্পোত্তীর্ণ চলচ্চিত্রের স্বাদ দিয়েছেন। নির্মাণশৈলীও অসাধারণ। রাজনীতি, সমাজ ও জীবনকে সূক্ষ্মভাবে দেখার, বোঝার ও উপলব্ধি করার ক্ষমতা থেকেই এ ধরনের সৎ ও সাহসী শিল্পকর্ম নির্মাণ সম্ভব। আদর্শের নামে স্বার্থের রাজনীতির কাছে মাথা বিক্রি করে সৃজনশীল কাজ করা যায় না। কাহিনী নির্মাণের অসংখ্য উপাদান ছড়িয়ে আছে আমাদেরও চারপাশে। কিন্তু এ নিয়ে কাজ হচ্ছে না প্রায় কোন মাধ্যমেই। পুরোটাই কি সৃজনশীলতার অভাব? নিশ্চয়ই নয়। দেশের শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের বড় এক অংশ সুবিধাবাদী রাজনীতির ¯্রােতে এমন ভাবে গা ভাসিয়েছেন যে, তাদের পক্ষে দলীয় ধ্বজা তুলে ধরা ছাড়া আর কিছু করা সম্ভব নয়। তরুণদের অনেকের মধ্যেও এ প্রবণতা প্রকট। সুপ্রীম পাওয়ারকে খুশি রাখতেই তাদের প্রতিভা খরচ হয়। এতে অল্প পরিশ্রমে বেশি লাভ। নগদ অর্থসহ আরাম-আয়েশের জীবনযাপনের নিশ্চয়তা জোটে। কঠিন প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হয় না। আরাম-আয়েশের জীবন সহজেই অর্জন করা যায় বলে পরিশ্রমবিমুখ হওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ডকুমেন্টারি, ডকুফিকশন ইত্যাদি নির্মিত হতে পারে। কিছু মৌলিক প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে সমস্যার গভীরে যাওয়া এবং এর পেছনের কারণ অনুসন্ধান করার সৎ প্রচেষ্টা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে রাজনৈতিক ব্যাধির গভীরতম কারণ। এ নিয়ে দশ, বিশ বা পঁচিশ মিনিটের ডকুমেন্টারি তৈরি হতেই পারে। কিন্তু কোন টেলিভিশন চ্যানেলে এ রকম কোন উদ্যোগ দেখা যায় না। এর কারণও ওই পক্ষে-বিপক্ষের রাজনীতি। টিভি চ্যানেলের মালিক যে দলের সমর্থক বা সক্রিয় নেতা সে চ্যানেলের সব প্রোগ্রাম ওই রাজনৈতক দলের মতাদর্শের অনুগামী হতে হবে। শিল্প-সংস্কৃতির জগতে এই বিভাজন আশঙ্কাজনকভাবে স্থবির করে দিচ্ছে সৃজনশীলতাকে। এদেশের গণতন্ত্রেরও সীমাবদ্ধতা অনেক। ভারতের গণতন্ত্র কর্পোরেট পুঁজিনির্ভর হয়ে পড়লেও ওদেশে এখনও খোলামেলা বা স্বাধীন মত প্রকাশের পরিসর অনেক বড়। তাই হায়দারের মতো চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়। এ চলচ্চিত্রে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে আমাদের দেশে তা সম্ভব নয়। কোন সৃজনশীল নির্মাতার পক্ষে এ ঝুঁকি নেয়া কঠিন। বিভিন্ন বাহিনী বাংলাদেশে যেভাবে সাধারণ মানুষের প্রায় গায়ে গায়ে লেগে আছে তাতে অনেক ঘটনারই অন্তরালের আসল কারণ নিয়ে কাহিনী নির্মাণ করা বেশ কঠিন কাজ। এও এখানকার এক বড় বাস্তবতা। সৃজনশীলতা বিকাশে প্রতিবন্ধকতা। রাজনীতিবিদরা পথ হারালে শিল্প-সংস্কৃতির জগতের মানুষের দায় বেড়ে যায়। যদিও সুস্থ রাজনীতির বিকাশ ছাড়া সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশ সম্ভব নয়। তবুও গতানুগতিক রাজনৈতিক ধারার বাইরে দাঁড়িয়ে যতটা সম্ভব সাংস্কৃতিক কর্মকা- বাড়ানো প্রয়োজন।
×