ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

নামেই জিবে জল, বিক্রি হচ্ছে গ্রামের পথে পথে

প্রকাশিত: ০৯:৫১, ১০ মার্চ ২০১৯

নামেই জিবে জল, বিক্রি হচ্ছে  গ্রামের পথে পথে

সমুদ্র হক ॥ রসের সাগরে ডুবে থাকা গোল মিষ্টি। রসগোল্লা। নামই জিবে জল এনে দেয়। বাঙালীর প্রতিটি আনন্দে রসের রসনায় রসগোল্লা যেন না হলেই নয়। ঐতিহ্যের এমন মিষ্টি সংস্কৃতি আর কোথাও নেই। রসগোল্লা মিষ্টি সমাজের হিমালয়চূড়া। ইতিহাসের সাক্ষ্য, এই রসগোল্লা সৃষ্টি করেন একজন বাঙালী। দূর অতীতে ময়রা রসগোল্লা বানিয়ে মাটির হাঁড়িতে করে গ্রামের পথে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করতেন। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তিতে রসগোল্লা ফের বিক্রি হচ্ছে বগুড়ার গ্রামের পথে ফেরি করেন। বগুড়া নগরী থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে শেরপুর উপজেলার মীর্জাপুরে দেখা গেল, তিন চাকার রিক্সা ভ্যানে প্লাস্টিকের বড় ড্রামে রসগোল্লা ভাসিয়ে ছুটে চলেছেন ময়রা (মিষ্টির কারিগর) বাদল সাহা (৫৮)। তার বাড়ি শেরপুরের কালিয়াকৈর গ্রামে। স্ত্রী, ১ মেয়ে, ১ ছেলে নিয়ে সংসার। বংশপরম্পরায় তারা মিষ্টির কারিগর। বাদল সাহার বাবা দ্বিজেন্দ্র নাথ সাহা ছিলেন রসগোল্লার জাদুকর। তার পথ ধরে এই পথে এসেছেন ছেলে বাদল সাহা এবং নাতি সুমন সাহা। তারা রসগোল্লা বিক্রি করেন ফেরি করে। বাদল সাহা বললেন, দিনমান ঘুরে গ্রামের মানুষের কাছে মিষ্টি বিক্রি করেই তিনি আনন্দ পান। এভাবে গ্রামের মানুষের আনন্দের সঙ্গী হন তিনি। এমনও দেখা গেছে গ্রামের মানুষের কোন আনন্দের কোন ঘটনা ঘটল, কোন অতিথির আগমন ঘটল অথচ মিষ্টি আনতে হবে দূরে থেকে। তখন বাদল সাহার রসগোল্লা তাদের আনন্দে রস ঢেলে দেয়। তার মিষ্টির দাম কম। প্রতি কেজি বিক্রি করেন ৭০ থেকে ৯০ টাকা। স্বল্প আয়ের মানুষের কাছ থেকে দাম কিছুটা কম রাখেন। মৃদু হেসে বললেন ‘আমিও ডিসকাউন্ট দেই।’ ছোট্ট শিশুদের বায়না মেটাতে শিশুর বাবা আধা কেজি কিনলে দুটি মিষ্টি ফ্রি দেন। শেরপুর, চান্দাইকোনা, সীমাবাড়ি, কালিয়াকৈর, বেটখৈর, নিশিন্দার, শিমলা, সাতালপাড়া, কাসিয়াহাটা, সুঘাট, ফুলজোড়, ধনকুণ্ঠি, বেতগাড়ি, ঘাসুরিয়া, নলুয়াসহ অন্তত ৫০টি গ্রামের মানুষ বাদল সাহার মিষ্টির ভক্ত। তিনি ৪০ বছর ধরে মিষ্টি বানিয়ে বিক্রি করছেন। তার স্ত্রী সন্ধ্যা রানী সাহা, ছেলে সুমন সাহা মিষ্টি বানান। বাজার থেকে দুধ কিনে ছানা বানিয়ে প্রতিদিন গড়ে দুই মণ করে রসগোল্লা বানিয়ে বিক্রি করেন। অনেক হোটেলের মালিক ও পাইকাররা তার বাড়িতে এসে মিষ্টি কিনে নিয়ে যান। মিষ্টির উৎপত্তি ইতিহাস থেকে জানা যায়, অষ্টাদশ শতকে চিনির সিরায় ছানা গোল করে চুবিয়ে তৈরি হয় রসগোল্লা। পুরনো নাম গোপাল গোল্লা। গোপালকে সিরায় ডুবিয়ে হয়েছে রসগোল্লা। ভারতবর্ষের প্রথম দিকের গবর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিংয়ের স্ত্রীর নামেও ময়রা একটি বিশেষ রসগোল্লা বানিয়েছিলেন। নাম দেয়া হয় লেডিক্যানি। এই রসগোল্লা মিষ্টির বাজারে রাজার সিংহাসনে বসে। রসগোল্লার আবিষ্কারক একজন বাঙালী। ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতের কলকাতার বাগবাজারের চিনি ব্যবসায়ী ও ময়রা নবীন চন্দ্র দাস রসে ভেজানো রসগোল্লা বানিয়ে তাক লাগিয়ে দেন। ছড়ায় ছন্দ হয় ‘বাগবাজারের নবীন চন্দ্র দাস রসগোল্লার কলম্বাস।’ ওই সময়ে বনেদি পরিবার সন্দেশের বিকল্প খুঁজছিলেন। একদিন নবীন দাসের দোকানের সামনে এক ধনাঢ্য ব্যক্তি এসে জল পান করতে চাইলে তিনি আগে একটি রসগোল্লা দেন। যারপরনাই খুশি হয়ে ধনাঢ্য ব্যক্তি দুই হাঁড়ি রসগোল্লা কিনে নিয়ে যান। রসগোল্লা স্থিতি পেল। আর ফিরে তাকাতে হয়নি। রসগোল্লার অন্যতম উপাদান ছানা। বৈদিক যুগে দুধ থেকে তৈরি খাবার ছিল পৌরণিক ধারার অংশ। বাঙালী এই ছানা থেকে একের পর এক দুগ্ধজাতীয় খাবার বানাতে থাকে। ইতিহাসবিদদের মতে, ঢাকার বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনীর হাটের দুগ্ধজাত মিষ্টির খ্যাতি আজও আছে। ঢাকায় চার প্রজন্মের মিষ্টি ব্যবসায়ী মরণচাঁদের রসগোল্লার সুনাম দেশ ছাড়িয়ে বিদেশ বিভূঁইয়ে পৌঁছেছে। বাঙালীর মিষ্টি প্রেমের কথা ফুরোবে না। জীবনের সকল আনন্দ শেয়ার করার আপ্যায়নে মিষ্টি আপন গতিতে চলে আসে। আত্মীয়র বাড়িতে বেড়াতে গেলে মিষ্টি নেয়া হয়। উৎসবে পার্বনে আনন্দে মিষ্টি মুখ না করালে বাঙালীর আতিথ্যের ষোলোকলা পূর্ণ হয় না।
×