ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

তৃতীয় ওয়ানডেতে নিউজিল্যান্ডের জয় ৮৮ রানে

হোয়াইটওয়াশ- ব্যর্থতার বৃত্ত পূরণ টাইগারদের

প্রকাশিত: ১১:২৮, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

হোয়াইটওয়াশ- ব্যর্থতার বৃত্ত পূরণ টাইগারদের

মিথুন আশরাফ ॥ একটি করে ফুলের গাঁথুনিতে গড়ে ওঠে ফুলের মালা। ঠিক একইভাবে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে নিউজিল্যান্ডের মাটিতে একটি করে হারের গাঁথুনিতে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের হারের মালা। এবারও নিউজিল্যান্ড সফরের ওয়ানডে সিরিজে সেই মালাই পরতে হয়েছে বাংলাদেশকে। হারের গোলকধাঁধার কাদাতেই পড়ে থাকে। দুঃস্মৃতির অতল তলেই পড়ে আছে বাংলাদেশ। বুধবার নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডেতেও বড় হারই হয়েছে নিয়তি। ৮৮ রানে হেরেছে বাংলাদেশ। তাতে এবারও হোয়াইটওয়াশই কপালে জুটেছে। ডানেডিনের ইউনিভার্সিটি ওভালে প্রচুর রান হয়। আবার অল্প রানে আটকে যাওয়ার স্মৃতিও আছে। কিন্তু নিউজিল্যান্ড আগে ব্যাটিং করা মানেই স্কোর আকাশচুম্বী হওয়া। তা এই স্টেডিয়ামের ইতিহাসই বলছে। কিন্তু বাংলাদেশ দল কি করল, টস জিতে নিউজিল্যান্ডকেই আগে ব্যাটিংয়ে পাঠাল। এমন সুযোগ কী আর নিউজিল্যান্ড ব্যাটসম্যানরা ছাড়বেন? ছাড়েনওনি। ৬ উইকেট হারিয়ে ৫০ ওভারে ৩৩০ রান করে বসল স্বাগতিকরা। ওপেনার কলিন মুনরো ছাড়া আর সবাই রান পেলেন। রস টেইলর (৬৯), হেনরি নিকোলস (৬৪) ও টম লাথাম (৫৯) হাফ সেঞ্চুরি করলেন। বাংলাদেশের মুস্তাফিজুর রহমান ২ উইকেট নিলেন। তবে ১০ ওভার বোলিং করে রান দিলেন ৯৩। যা মুস্তাফিজের জন্য একটি দুঃখগাথা দিনই হয়ে থাকল। বোলিংয়ে এমন দুর্দশাগ্রস্ত দিন যে আর দেখার মিলেনি। মুস্তাফিজের মতো এমন ‘কাটার’ বোলারকেই যখন ধুয়ে দিয়েছেন কিউই ব্যাটসম্যানরা, তখন বোঝাই যাচ্ছে ব্যাটিং স্বর্গই ছিল ডানেডিনের উইকেট। এমন উইকেটে সাব্বির রহমান রুম্মন ঠিকই নিজেকে মেলে ধরলেন। কত বিতর্কের মধ্য দিয়ে দলে যুক্ত হয়েছেন। শেষ পর্যন্ত এবার নিউজিল্যান্ড সফরের ওয়ানডে সিরিজে তিনিই আসল কাজের কাজটি করেছেন। ১১০ বলে ১২ চার ও ২ ছক্কায় ১০২ রানের ইনিংস উপহার দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে প্রথম সেঞ্চুরি তুলে নিয়েছেন। তাতেও দল জিততে পারেনি। মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন (৪৪) ও মেহেদী হাসান মিরাজ (৩৭) ছাড়া যে আর কোন ব্যাটসম্যানই ব্যাট হাতে উজ্জ্বলতা ছড়াতে পারেননি। ব্যর্থতার ঘোরেই পড়ে ছিলেন। তাইতো ৪৭.২ ওভারে ২৪২ রান করতেই গুটিয়ে গেছে বাংলাদেশ। টিম সাউদি প্রথম দুই ওয়ানডে খেলেননি। এবার যখন বল হাতে নিলেন, ৬ উইকেট শিকার করে ফেললেন। তাতেই কাত হয় বাংলাদেশ। সিরিজে ৩-০ ব্যবধানে হারও হয়ে যায়। এবার নিউজিল্যান্ড সফরে ‘আট’-এর খপ্পরে পড়েছে বাংলাদেশ। প্রথম ও দ্বিতীয় ওয়ানডেতে ৮ উইকেটে হার হয়েছে। এবার তৃতীয় ওয়ানডেতে ডাবল ৮৮ কপালে জুটেছে। এবার রানে হেরেছে বাংলাদেশ। প্রথম ওয়ানডেতেই বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানদের কাহিল অবস্থা ধরা পড়েছিল। কি যে হাল হতে যাচ্ছে তা বোঝা গিয়েছিল। এরপরও আশা ছিল, সময় গড়ানোর সঙ্গে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু প্রথম ওয়ানডেতে ২৩২ রান করা বাংলাদেশ দল দ্বিতীয় ওয়ানডেতে ২২৬ রানেই খতম। আরও কঠিন অবস্থায় পড়তে হয়েছে। তৃতীয় ওয়ানডের আগে অন্তত একটি ওয়ানডে জেতার আশা ছিল। সেই আশা অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজাই দেখেছিলেন। তবে তারও জানা ছিল, তা এত সহজ নয়। তাই বলে এত কঠিন। বাংলাদেশ দল এখন অনেক উন্নত। দেশের মাটিতেতো অপ্রতিদ্বন্দ্বী দল হয়ে উঠেছে। বিদেশের মাটিতেও জিতছে। অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডে হওয়া ২০১৫ সালের বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে খেলেছে। ইংল্যান্ড এ্যান্ড ওয়েলসে অনুষ্ঠিত ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে সেমিফাইনালে খেলেছে। নিউজিল্যান্ডকে হারিয়েই সেরা চার দলের একটি হয়েছিল বাংলাদেশ। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির আগে আয়ারল্যান্ডে হওয়া তিনজাতি সিরিজের শেষ ম্যাচেও নিউজিল্যান্ডকে হারিয়েছিল বাংলাদেশ। বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের সর্বশেষ ওয়ানডে সিরিজটি হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজে। সেই সিরিজেও বাংলাদেশ জিতে। আর তাই এর আগে কখনই নিউজিল্যান্ডের মাটিতে নিউজিল্যান্ডকে হারাতে না পারলেও এবার দলকে নিয়ে বড় আশাই দেখা হয়। এবার হারের ধাঁধা থেকে মুক্ত হবে বাংলাদেশ, সেই প্রত্যাশা করা হয়। কিন্তু এবারতো আরও খারাপ অবস্থা হলো। ইংল্যান্ড এ্যান্ড ওয়েলসে এ বছর ৩০ মে থেকে ১৪ জুলাই পর্যন্ত অনুষ্ঠেয় বিশ্বকাপের আগে নিউজিল্যান্ড সফরটিতেই বিশেষ নজর ছিল। এই সফরে বাংলাদেশ কতটা ভাল করে সেদিকেই দৃষ্টি ছিল। কিন্তু চোখ দিয়ে সবাই যেন ঘোলা দেখতে থাকল। একেকটি করে ওয়ানডে গেল আর বাংলাদেশের বেহাল দশা সামনে চলে আসল। তবে পুরো ওয়ানডে সিরিজে এমন এক প্রাপ্তি মিলল যা স্বস্তি হয়ে ধরা দিতে পারে। সাব্বিরের সেঞ্চুরিই সেই স্বস্তি দিচ্ছে। এবার নিউজিল্যান্ড সফরে ওয়ানডে সিরিজে সাব্বিরের সেঞ্চুরিই বাংলাদেশের একমাত্র সেঞ্চুরি হয়ে থাকল। তামিম, লিটন, সৌম্য, মুশফিক, মাহমুদুল্লাহকে পেছনে ফেলে সাব্বির বড় ইনিংস খেলে দেখিয়ে দিলেন। মার্টিন গাপটিলকে কী টানা তিন সেঞ্চুরি করা থেকে আটকাতে পারবেন বাংলাদেশ বোলাররা? এমন প্রশ্নই তৃতীয় ওয়ানডের আগে ওঠে। টানা দুই ওয়ানডেতেই সেঞ্চুরি করে বাংলাদেশকে ডুবিয়ে দেয়া গাপটিল যে বিধ্বংসী ব্যাটিংয়েই বাংলাদেশের বারোটা বাজিয়ে দেন। কিন্তু এদিন গাপটিলকে আটকিয়ে দেন মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন। এমনকি শুরুতে চাপেও রাখা যায় নিউজিল্যান্ডকে। ২৫ ওভারে ১২০ রানের বেশি করতেও পারেনি নিউজিল্যান্ড। কিন্তু পরের ২৫ ওভারেই নিকোলস, টেইলর, লাথামের ঝড়ো ব্যাটিংয়ে ২১০ রান স্কোরবোর্ডে যোগ করে ফেলে স্বাগতিকরা। টেইলর আবার এই ম্যাচেই একটি রেকর্ডের মালিক হন। নিউজিল্যান্ডের জার্সিতে ওয়ানডেতে সবচেয়ে বেশি রান এখন টেইলরের। আট হাজার ৭ রান করা বাঁহাতি টপঅর্ডার ব্যাটসম্যান স্টিভেন ফ্লেমিংকে পেছনে ফেলে দেন টেইলর। সাত হাজার ৫৭ রান নিয়ে খেলতে নামা টেইলর বুধবার হাফ সেঞ্চুরি করার পর যখন আর ১ রান করেন তখনই তার রান হয়ে যায় আট হাজার ৮ রান। ৮২ বলে ৭ চারে শেষ পর্যন্ত ৬৯ রান করে আউট হওয়া টেইলরের রেকর্ডের দিনে নিউজিল্যান্ড যে আকাশচুম্বী রান স্কোরবোর্ডে যোগ করেছে, তারপরই আসলে বাংলাদেশের হার দেখা হয়ে যায়। বাংলাদেশ যখন শুরুতেই ৬১ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে ফেলে, তখনতো অনেক বড় হারই নাকি হতে চলেছে, সেই শঙ্কাই জাগে। তামিম, সৌম্য, লিটন, মুশফিক, মাহমুদুল্লাহর মতো ব্যাটসম্যানদের হারিয়ে বিশাল বড় হার থেকে মুক্ত হওয়ার পথ খুঁজতে থাকে বাংলাদেশ। অবশেষে সেই পথ পাওয়া যায়। সেই পথ খুঁজে বের করেন সাব্বির। সঙ্গে থাকেন সাইফউদ্দিন। দুইজন মিলে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে থাকেন। সাউদির বোলিং তোপ। বোল্ট ও ফার্গুসনের সুইং আর বাউন্সগুলো ঠেকিয়ে দিতে যেখানে ব্যর্থ হন দলের নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যানরা। সেখানে খুব স্বাভাবিকভাবেই সাউদি, বোল্ট, ফার্গুসনদের বলগুলোকে মোকাবেলা করেন সাব্বির ও সাইফউদ্দিন। দুইজন মিলে ষষ্ঠ উইকেটে ১০১ রানের জুটিও গড়েন। দলের ১৬২ রানের সময় ৬৩ বলে ৪ চারে ৪৪ রান করা সাইফউদ্দিন আউট হলে দুইজনের জুটির ইতি ঘটে। দল যে খাদের কিনারায় পড়ে গিয়েছিল, দুইজন মিলে তা থেকে দলকে রক্ষা করেন। সাইফউদ্দিন সাজঘরে ফিরলেও সাব্বির উইকেট আঁকড়েই থাকেন। শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত লড়াই করতে থাকেন। তার সামনে দিয়ে এক এক করে পাঁচ ব্যাটসম্যান আউট হন, কিন্তু তিনি অবিচল থাকেন। শেষে গিয়ে আর পারেননি। সেঞ্চুরি করার পর সাউদির বলে কট এ্যান্ড বোল্ট হয়ে যান। সাব্বিরের আউটের সঙ্গে বাংলাদেশের ইনিংসেরও শেষ হয়। সাব্বির হাল ধরেছিলেন। না হলে বাংলাদেশ আরও আগেই অলআউট হয়ে যেত। হারের ব্যবধান তখন এক শ’ রানের অনেক বেশিও হতে পারত। তবে হার এড়ানো যায়নি। আরেকটি হার হয় বাংলাদেশের। নিউজিল্যান্ড সফরে এবারও হারের মালাই গলায় ঝুলল।
×