ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো

প্রকাশিত: ১১:১৫, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো

ফিরোজ মান্না ॥ কবি সৈয়দ শামসুল হক ‘একুশের কবিতায়’ সভ্যতার মণিবন্ধে সময়ের ঘড়ি/ শিশু জন্ম থেকে জরাদেহ ক্ষীণশ্বাস মানবের অবলুপ্তির সীমারেখায় বলে গেল সেই কথা/ সেই কথা বলে গেল অনর্গলÑ’ কবিতায় গানে, গল্প, উপন্যাসে মায়ের ভাষা বাংলাকে নিয়ে এভাবেই আবেগ প্রকাশ হয়ে আসছে ’৫২ থেকে আজ পর্যন্ত। বাংলার মানুষের কাছে পাকিরা মায়ের ভাষাকে রক্তে মাখিয়ে দিয়েছে। সেই মায়ের ভাষায় শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টি চলছেই। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন মায়ের ভাষা যে রক্তে রঞ্জিত সেই ইতিহাস নদীর মতোই বহমান থাকবে। মাতৃভাষা আন্দোলনের শুরুটা ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ। ঢাকায় এসে পৌঁছান পাকিস্তানের স্থপতি মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ্। ভারত বিভাগের পর এটাই ছিল তার প্রথম পূর্ব পাকিস্তান সফর। ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক গণসংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় ও সেখানে তিনি ভাষণ দেন। তাঁর ভাষণে তিনি ভাষা আন্দোলনকে পাকিস্তানের মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির ষড়যন্ত্র হিসেবে উল্লেখ করেন। যদিও তিনি বলেন, পূর্ববঙ্গের প্রাদেশিক ভাষা নির্ধারিত হবে প্রদেশের অধিবাসীদের ভাষা অনুযায়ী। কিন্তু তিনি দ্ব্যর্থহীন চিত্তে ঘোষণা করেনÑ ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, অন্য কোন ভাষা নয়।’ তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, জনগণের মধ্যে যারা ষড়যন্ত্রকারী রয়েছে, তারা পাকিস্তানের শত্রু এবং তাদের কখনই ক্ষমা করা হবে না। জিন্নাহ্র এ বিরূপ মন্তব্যে তাৎক্ষণিকভাবে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে উপস্থিত ছাত্র-জনতার একাংশ। উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষাÑ এ ধরনের একপেশে উক্তিতে আন্দোলনকারীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে গিয়েও জিন্নাহ্্ একই ধরনের বক্তব্য রাখেন। তিনি উল্লেখ করেন, এ আন্দোলন সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির বহির্প্রকাশ এবং অভিযোগ করেন কিছু লোক এর মাধ্যমে তাদের ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করতে চাইছে। যখন তিনি উর্দুর ব্যাপারে তার অবস্থানের কথা পুনরুল্লেখ করেন, উপস্থিত ছাত্ররা সমস্বরে না, না বলে চিৎকার করে ওঠে। একইদিনে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের একটি প্রতিনিধি দল জিন্নাহ্র সঙ্গে সাক্ষাত করে এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে একটি স্মারকলিপি দেয়। প্রতিনিধি দলে ছিলেন শামসুল হক, কামরুদ্দিন আহমদ, আবুল কাশেম, তাজউদ্দীন আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, আজিজ আহমদ, অলি আহাদ, নঈমুদ্দিন আহমদ, শামসুল আলম এবং নজরুল ইসলাম। কিন্তু জিন্নাহ্ ও খাজা নাজিমুদ্দিনের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তিকে একপেশে এবং চাপের মুখে সম্পাদিত বলে তারা প্রত্যাখ্যান করেন। অনেক তর্ক-বিতর্ক ও অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে সভাটি অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্ররা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য জিন্নাহ্র কাছে স্মারকলিপি পেশ করেন। ২৮ মার্চ জিন্নাহ্ ঢাকা ত্যাগ করেন এবং সেদিন সন্ধ্যায় রেডিওতে দেয়া ভাষণে তার পূর্বেকার অবস্থানের কথাই পুনর্ব্যক্ত করেন। জিন্নাহ্ ঢাকা ত্যাগের পর ছাত্রলীগ এবং তমদ্দুন মজলিসের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে তমদ্দুন মজলিসের আহ্বায়ক শামসুল আলম দায়িত্ব মোহাম্মদ তোয়াহার কাছে হস্তান্তর করেন। পরবর্তীতে তমদ্দুন মজলিস আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হওয়ার জন্য কমিউনিস্টদের দায়ী করে একটি বিবৃতি প্রদান করে এবং পরে তারা আস্তে আস্তে আন্দোলনের পথ থেকে সরে আসে। বদরুদ্দীন উমর ‘পূর্ববাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি-১’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সাক্ষাত দেন। ওই সাক্ষাতটি ছিল চীফ সেক্রেটারি আজিজ আহমদের বাসভবনে। সেদিন সংগ্রাম পরিষদের সদস্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন শামসুল হক, কামরুদ্দীন আহমদ, আবুল কাসেম, তাজউদ্দীন আহমদ, লিলি খান, মহম্মদ তোয়াহা, আজিজ আহমদ, আলি আহাদ, নঈমুদ্দীন আহমদ, শামসুল আলম এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম। সেদিনের আলোচনায় জিন্নাহ্ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্যদের বলেন, নাজিমুদ্দীনের সঙ্গে তাদের যে চুক্তি হয়েছে সেটা তিনি স্বীকার করেন না। কারণ নাজিমুদ্দীনের থেকে জোরপূর্বক সেই চুক্তিতে সই আদায় করা হয়েছে। এর প্রমাণ হিসেবে তিনি বলেন যে, আট দফা চুক্তির মধ্যে প্রত্যেকটি দফাতেই নাজিমুদ্দীনকে কী বলতে হবে তাই বলা হয়েছে কিন্তু অন্যপক্ষের কর্তব্য সম্পর্কে কোন উল্লেখ নেই। চুক্তি কখনও একতরফা হয় না, সর্বতোভাবে তা একটা দ্বিপাক্ষিক ব্যাপার। কিন্তু আট দফা চুক্তি স্পষ্ট প্রমাণ করে যে, তা এক পক্ষের সুবিধার জন্য করা হয়েছে এবং চুক্তিতে স্বাক্ষর জোরপূর্বকই আদায় করা হয়েছে। ওই আলোচনায় জিন্নাহর প্রধান বক্তব্য ছিল এই যে, পাকিস্তানে একাধিক রাষ্ট্রভাষা হলে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিপন্ন হবে। তাছাড়া একাধিক রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নটিকে তিনি পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন বলেও বর্ণনা করেন। এই পর্যায়ে মোহম্মদ তোয়াহা তাকে বলেন যে, কানাডা, সুইজারল্যান্ডসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই একাধিক রাষ্ট্রভাষা রয়েছে। এটা মোটেই কোন নজিরবিহীন ঘটনা নয়। জিন্নাহ কিন্তু ওই সমস্ত দেশে একাধিক রাষ্ট্রভাষার কথা সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করেন। জিন্নাহর এমন বক্তব্যের পর সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এদিকে, শাহ আজিজুর রহমানরা নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ নামে একটি স্বতন্ত্র ছাত্র প্রতিষ্ঠান গঠন করেন। এই প্রতিষ্ঠানটি মোটামুটিভাবে কলকাতা থেকে আগত মুসলিম ছাত্রলীগ নাজিমুদ্দীন সমর্থক উপদলীয় নেতৃত্বের আওতাভুক্ত ছিল। সেই হিসেবে ঢাকার ছাত্র সম্প্রদায়ের মধ্যে তাদের বিশেষ কোন প্রভাব ছিল না। কিন্তু সে প্রভাব না থাকলেও পার্লামেন্টারি রাজনীতির সঙ্গে যথেষ্ট যোগাযোগ ছিল। জিন্নাহ এই ছাত্র প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। এই দলটিতে তখন শাহ আজিজুর রহমান ব্যতীত দেলাওয়ার হোসেন, লুৎফর রহমান, সুলতান হোসেন খান, আব্দুল মালেক এবং মাজহারুল কুদ্দুস উপস্থিত ছিলেন। জিন্নাহ তাদের সঙ্গে ছাত্র ঐক্য এবং অন্যান্য বিষয়ে আলাপ করেন। পরে জিন্নার মিলিটারি সেক্রেটারি মোহম্মদ তোয়াহাকে চিঠি দিয়ে জানান যে, তিনি তাদের সঙ্গে সাক্ষাত করতে চান। চিঠিতে তোয়াহাকে অনুরোধ করা হয় তিনি যেন অন্য আর একজন ছাত্র প্রতিনিধিকে তার সঙ্গে নিয়ে আসেন। সেই কথামতো তোয়াহা আলোচনার জন্য মিলিটারি সেক্রেটারির কাছে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বায়ক নঈমুদ্দিন আহমদের নাম পাঠান। শাহ আজিজুর রহমান ও মোহম্মদ তোয়াহার মতে মিলিটারি সেক্রেটারির চিঠি পান এবং তার দলভুক্ত মাজহারুল কুদ্দুসের নাম দেন। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ এবং নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রতিনিধিদের সঙ্গে জিন্নাহর এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৪৮ সালের ১৮ নবেম্বর পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান পূর্বপাকিস্তান সফরে আসেন। ২৭ নবেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে তিনি এক ছাত্রসভায় ভাষণ দেন। ওই সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়নের তরফ থেকে প্রদত্ত মানপত্রে বাংলা ভাষার দাবি পুনরায় উত্থাপন করা হয়। কিন্তু তিনি কোনরূপ মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন। ১৭ নবেম্বর আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের এক সভায় আজিজ আহমদ, আবুল কাশেম, শেখ মুজিবুর রহমান, কামরুদ্দীন আহমদ, আবদুল মান্নান, তাজউদ্দীন আহমদ প্রমুখ একটি স্মারকলিপি প্রণয়ন করেন এবং সেটি প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানের কাছে পাঠানো হয়। প্রধানমন্ত্রী এক্ষেত্রেও কোন সাড়া দেননি। ভাষা আন্দোলনের মতো আবেগিক বিষয়ের পুনরায় জোরালো হওয়ার পেছনে ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিনের ভাষণ প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন খাজা নাজিমুদ্দিন ২৫ জানুয়ারি ঢাকায় আসেন এবং ২৭ জানুয়ারি পল্টন ময়দানের এক জনসভায় দীর্ঘ ভাষণ দেন। তিনি মূলত জিন্নাহর কথাই পুনরুক্তি করে বলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। রেডিওতে সরাসরি সম্প্রচারিত তার ভাষণে তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, কোন জাতি দুটি রাষ্ট্রভাষা নিয়ে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে পারেনি। নাজিমুদ্দিনের বক্তৃতার প্রতিবাদে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২৯ জানুয়ারি প্রতিবাদ সভা এবং ৩০ জানুয়ারি ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট পালন করে। সেদিন ছাত্রসহ নেতৃবৃন্দ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় সমবেত হয়ে ৪ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘট ও প্রতিবাদ সভা এবং ২১ ফেব্রুয়ারি প্রদেশব্যাপী হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। পরে তাঁরা তাঁদের মিছিল নিয়ে বর্ধমান হাউসের (বর্তমান বাংলা একাডেমি) দিকে অগ্রসর হয়। পরদিন ১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বার লাইব্রেরি হলে অনুষ্ঠিত সভায় মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ৪০ সদস্যের সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মিপরিষদ গঠিত হয়। সভায় আরবী লিপিতে বাংলা লেখার সরকারী প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করা হয় এবং ৩০ জানুয়ারির সভায় গৃহীত ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্তকে সমর্থন দেয়া হয়। পরিষদ থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি হরতাল, সমাবেশ ও মিছিলের বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।
×