ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রত্যাখ্যাত সন্ত্রাস, বিভাজন ও দুর্নীতির রাজনীতি

প্রকাশিত: ০৮:৪৩, ৩০ জানুয়ারি ২০১৯

প্রত্যাখ্যাত সন্ত্রাস, বিভাজন ও দুর্নীতির রাজনীতি

১৯৭৫ সালের নারকীয় হত্যাকা-ের পথ ধরে এ দেশে শুরু হয় বিভাজনের ও ইতিহাস বিকৃতির রাজনীতি। বহু যুগের রাজনৈতিক বিকাশের ধারাবাহিকতায় এবং আওয়ামী লীগ তথা বঙ্গবন্ধুর আপোসহীন সংগ্রাম ও গণমুখী রাজনীতির ফলে পঞ্চাশের দশক থেকেই এ ভূ-খ-ে বাঙালী জাতীয়তাবাদী চেতনা অতি দ্রুত বিকাশ লাভ করতে থাকে- যা ১৯৬৬ সালের ছয়দফা আন্দোলনের মাধ্যমে নতুন মাত্রা লাভ করে। পাকিস্তানী শোষণ ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এ দেশের সব মানুষ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গড়ে তোলে প্রতিরোধ ও প্রতিবাদের অপ্রতিরোধ্য সংগ্রামের রূপকথা। বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে মানুষ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ছিনিয়ে আনে স্বাধীনতা, যার মূল নীতিগুলো : গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র ছিল এর ভিত্তিমূল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম তাই একটি জাতির আদর্শের সংগ্রাম, যে আদর্শগুলো গড়ে উঠেছে তথাকথিত ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব’কে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করে। বাঙালী জাতীয়তাবাদ ধারণ করে অসাম্প্রদায়িক সাম্য ও মৈত্রীর গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। এখানেই বাঙালী জাতীয়তাবাদের সঙ্গে বাংলাদেশী জতীয়তাবাদের মৌলিক পার্থক্য। পাকিস্তানী ভাবাদর্শে লালিত পালিত স্বাধীনতাবিরোধী বুদ্ধিজীবী প্রণীত বিকৃত বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী ভাবধারাকে জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখলের অনতিকাল পরেই প্রবর্তিত করার সর্বাত্মক প্রয়াস গ্রহণ করে। এটা ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের ভিত্তিমূলে আঘাত করে দেশকে সাম্প্রদায়িক, অগণতান্ত্রিক মিনি পাকিস্তানে রূপান্তরিত করার নীলনক্সার অংশবিশেষ। এই নীল নক্সার প্রধান উদ্যোক্তা হিসেবে জিয়ার উত্থান ১৯৭৫-এর হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তার বহুবিধ সন্দেহজনক ভূমিকা তার মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার বিষয়টিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে রেখেছে। মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে খর্ব করার জন্য তার উদ্যোগগুলোর কথা এখন একটি বিরাট প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে জাতির সামনে। ’৭৫-এর হত্যাকা-ের পর জিয়া মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করে দেয়ার ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। সামরিক শাসনের যাঁতাকলে পিষ্ট করে সমগ্র জাতিকে। ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত চলে কার্ফ্যুর রাজনীতি। এর মাঝেই আবার সকল মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তিকে বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামাবলি গায়ে দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। এর পর শুরু হয় এ দেশের মানুষের সব গর্বের অর্জনগুলোকে একে একে ধ্বংস করার পরিকল্পিত প্রক্রিয়া। দেশের সংবিধানের মৌলিক আদর্শগুলোর বিপরীতে পুনর্প্রতিষ্ঠা করা হয় পাকিস্তানী বিভেদের রাজনীতি। বিনা অপরাধে ও বিনা বিচারে গণহারে হত্যা করা হয় হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা সেনা সদস্যকে। বঙ্গবন্ধুকে পুরোপুরি কেবল নিষিদ্ধই করা হয় না, বরং নতুন প্রজন্মের কাছে তাকে বিকৃতভাবে উপস্থাপিত করা হতে থাকে। ফলশ্রুতিতে পয়দা হয় একটি বিকৃতমনা প্রজন্মের যারা অদ্যাবধি এই বিকৃতির নারকীয় চক্র থেকে বের হতে পারেনি। কোন জাতিকে ধ্বংস করতে হলে এর নতুন প্রজন্মকে সেই জাতির অর্জগুলোকে হেয় করতে শেখাও। জিয়া-এরশাদ-খালেদার ২১ বছরের ক্ষমতাকালে বুদ্ধিবিকশিত ও বিবেক নিঃশেষিত এই প্রজন্মের অনেকেই এখনও বিকৃত ধ্যান-ধারণা পুষ্ট। এদের অনেকেই ছাত্র রাজনীতি থেকে রাজনীতিবিদ হয়েছে। অনেকে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত, অনেকে বর্তমানে সরকারী সর্বোচ্চ পদাধিকারী, অনেকে সংসদেও স্থান পেয়েছেন বহুবার। স্বাধীন বাংলাদেশে ’৭৫ সাল পরবর্তী সামরিকতন্ত্র থেকে শুরু হয় গণতন্ত্র, মানবাধিকার, জাতীয়তাবাদ ও সুশাসনের চরম সঙ্কট। এই সঙ্কট বিদ্যমান থাকে অন্যূতন ২১ বছর। জিয়ার আমলে সংঘটিত তথাকথিত ‘হ্যাঁ’-‘না’ ভোটটি ছিল জাতির সঙ্গে চরম বেইমানি ও গণতন্ত্রের সঙ্গে উপহাস ও চরম অবমাননার নামান্তর। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের প্রধান বেনিফিশিয়ারি ও পরিকল্পনাকারী জিয়ার ধাপে ধাপে ক্ষমতা দখল ও সুসংহতকরণের অন্যতম পদক্ষেপ ছিল ১৯৭৮ সালের এই তথাকথিত গণভোট। এই প্রহসনে জেলখানায় বন্দী বিরোধী দলীয় রাজনীতিবিদদের ভোটসহ মৃত ব্যক্তিবর্গের ভোটও ’হ্যাঁ’ বাক্সে পড়ে। প্রকৃতপক্ষে এই ভোটে শতকরা দুইভাগ ভোটারের উপস্থিতি না থাকলেও সংগৃহীত ভোট দেখানো হয় ৫৪.৩%, যার ৭৬.৬% পেয়ে জিয়া নিজেকে নিজেই গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত মনে করতে থাকেন। সেই সঙ্গে শুরু হয় বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র। এক্ষেত্রে জিয়া তার পাকিস্তানী পূর্বসূরি ও প্রাক্তন প্রভু আইয়ুব খানের পদাঙ্ক যথাযথভাবে অনুসরণ করেন। আইয়ুব ১৯৬০ সালে নিজেকে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত করেন তথাকথিত গণভোটের মাধ্যমে, যেখানে ভোট দানের হার দেখানো হয়েছিল ৯৫.৬%! জিয়ার পরবর্তী প্রতিটি পদক্ষেপ মনে করিয়ে দেয় পাকিস্তানী সামরিক শাসকদের ক্ষমতা পোক্ত করার ইতিহাস: ক্যান্টনমেন্টে আসীন থেকে রাজনৈতিক দল গঠন ও এর জন্য রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির অপব্যবহার, চিহ্নিত সন্ত্রাসী দুর্নীতিবাজ ও দলছুটদের সমন্বয়ে রাজনৈতিক দল গঠন, ধারাবাহিকভাবে প্রধান বিরোধী দল ও নেতাদের বিনাশ সাধনের সার্বিক পদক্ষেপ ও সেনাবাহিনীতে কর্মরত অবস্থায় তথাকথিত নির্বাচন অনুষ্ঠান ও রাজনীতিবিদ বনে যাওয়া। পাকিস্তানী এই মডেল পরবর্তী সময়ে জিয়ার উত্তরসূরি ও জিয়া হত্যার প্রধান বেনিফিসিয়ারি এরশাদ অনুসরণ করেন। জিয়ার প্রত্যক্ষ মদদে দেশে একদিকে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে স্বাধীনতাবিরোধী ও গণহত্যাকারী রাজনৈতিক অপগ-ের দল, অপরদিকে নির্বিচারে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে হত্যা করা হতে থাকে মুক্তিযোদ্ধাদের। সামরিক বাহিনীর মূল পদগুলো দেয়া হতে থাকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকা পাকিস্তানীদের সেবাদাস অফিসারদের। হত্যা করা হয়, মুক্তিযুদ্ধের বীর সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ ও তাহেরকে। জিয়া সামরিক বাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধাদের কোণঠাসা করে পাকিস্তান ফেরত ও পাকিস্তানী ভাবধারাপুষ্ট অফিসারদের নিয়ে আসে সামনের কাতারে, যার ফলে এরশাদ চলে আসে লাইমলাইটে। সম্ভবত তখন থেকেই জিয়ার মৃত্যুর প্রহরও এগিয়ে আসতে থাকে। পরে জিয়ার হত্যাকা-ের প্রধান বেনিফিসিয়ারি হয় এরশাদ ও বেগম খালেদা জিয়া। জাতির বিভাজন ও কুশাসনের মাত্রা এরশাদ ও খালেদা জিয়ার শাসনামলগুলোতে পুষ্পে পল্লবে বিকশিত হতে থাকে। এরশাদ জিয়ার পদাঙ্ক অনুসরণ করে ১৯৮২ সালে ক্ষমতা দখল করে কার্ফু গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনে। সামরিক শাসন জারির তিন বছর পর এরশাদ তার অবৈধ সামরিক শাসনকে বৈধতা দেয়ার জন্য ২১ মার্চ ১৯৮৫ সালে গণভোট অনুষ্ঠান করে। এতে ৭২.২% ভোটারের উপস্থিতি দেখানো হয় যদিও প্রকৃতপক্ষে ৩% ভোটরের উপস্থিতিও লক্ষ্য করা যায়নি। আর এরশাদ নিজেকে ৯৪% ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করে ‘গণতান্ত্রিকভাব‘ নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতার মসনদ পাকাপোক্ত করে। জিয়ার সামরিক শাসনামলে দুর্নীতি ও কুশাসনের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের শুরু হয় যা বিকশিত হতে থাকে এরশাদ ও পরবর্তীতে খালেদা জিয়ার শাসনামলে। ২০০১ সালে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় ক্ষমতায় আসার পর পরবর্তী পাঁচ বছর বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মন্ত্রী, আমলা, আশীর্বাদপুষ্ট ছাত্রদলের ও অঙ্গ সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীসহ সবাই জনগণের সম্পদ আত্মসাত করে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার প্রত্যক্ষ মদদে গড়ে ওঠে হাওয়া ভবন নামে দুর্নীতির আখড়া। তারেক রহমানের নেতৃত্বে রাষ্ট্রের সব কর্মকা-ে এই ভবনের হস্তক্ষেপ মানুষের জীবন ও জীবিকাকে করে তোলে অসহনীয়। ২০০১ সালে খালেদা জিয়ার শাসনামলের শুরু থেকেই বিভাজনের রাজনীতি এতটাই প্রকট আকার ধারণ করে যেÑ সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর শত শত পরিবার হামলা, লুটপাট ও গণধর্ষণের শিকার হয়ে ১৯৭১ সালের মতো দেশ ত্যাগে বাধ্য হয়। এসব অপকর্মের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত প্রায় তিন হাজার বিএনপি-জামায়াত কর্মীকে উচ্চ আদালতের নির্দেশে শনাক্ত করা হয়। এর মধ্যে ২৬ জন ছিলেন মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তায় উত্থান ঘটে হুজি ও জেএমবির মতো চরমপন্থী গোষ্ঠী, বাংলা ভাইয়ের মতো সন্ত্রাসীরা মেতে ওঠে রক্তের হোলি খেলায়। হত্যা করা হয় সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া ও সাবেক সংসদ সদস্য আহসানউল্লাহ মাস্টারসহ আওয়ামী লীগের ২৬ হাজার নেতা-কর্মীদের। বঙ্গবন্ধু কন্যা, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রায় বিশ বার হত্যা করার চেষ্টা করা হয়। সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা, যা পরিচালিত হয় সম্পূর্ণভাবে রাষ্ট্রীয় মদদে ও তারেক রহমানের পরিকল্পনা অনুযায়ী। এই নারকীয় হামলায় মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মরহুম প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ আওয়ামী লীগের ২৪ নেতাকর্মী এবং এর সহযোগী সংগঠনের সদস্যরা নিহত হন এবং আহত হন ৩শ’ জনেরও বেশি নেতাকর্মী। এর বিপরীতে দেশ ও জাতি আজ দাঁড়িয়ে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দ্বারপ্রান্তে। ক্ষুধা, জড়া, অশিক্ষা, রোগ, সামাজিক বিভেদ, জাতীয় বিভাজনসহ অনেক প্রতিকূলতাকে আমরা অতিক্রম করেছি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে¡। নতুন প্রজন্মের সম্মুখে আজ উজ্জ্বল ভবিষ্যতের হাতছানি, যে জীবন দেবে আমাদের সন্তানদের সম্মানজনক জীবন ও জীবিকা, বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে ‘আমার সোনার বাংলা’ গেয়ে যাওয়ার সামর্থ্য, দেবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলার শক্তি ও সাহস। তাই তো আজ জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত বিভাজন ও সন্ত্রাসের ধারক-বাহকেরা, আমন্ত্রিত সাহসী, প্রজ্ঞাবান ও দূরদর্শী নেতৃত্ব। লেখক : শিক্ষাবিদ
×