ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

‘মাঘের শীতে বাঘ কাঁপে’ সেইদিন শেষ

প্রকাশিত: ০৯:৫৬, ২৮ জানুয়ারি ২০১৯

 ‘মাঘের শীতে বাঘ কাঁপে’  সেইদিন শেষ

নিখিল মানখিন ॥ ‘মাঘের শীতে বাঘ কাঁপে’র দিন শেষ। বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাবে বদলে গেছে প্রকৃতির অনেক নিয়ম। মাঘ মাসেই দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৩ ডিগ্রী সেলসিয়াসে উঠেছে। দীর্ঘদিন বৃষ্টি না থাকায় ধুলোময় হয়ে উঠেছে রাজধানীর পরিবেশ। ধুলো ধূসর পরিবেশে সর্দি-কাশি, শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া, এ্যাজমা ও ফুসফুসে নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে নগরবাসী। রাজধানীতে দীর্ঘদিন বৃষ্টি নেই। সামান্য বাতাসেই বিশেষ করে যানবাহন চলাচলের গতিবেগেই উড়তে থাকে ধুলো-ময়লা। প্রতিনিয়ত এমন পরিবেশের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। নাক-মুখ বন্ধ করে পথ চলতে হয়। সারাবছর রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করে জমে থাকা মাটি শীতকালে ধুলো হয়ে উড়ে। আর সাধারণ মানুষ ধুলার রাজত্বে অসহায় হয়ে মুখে অনেকেই মুখোশ পড়ে। এই ধুলায় একদিকে বেড়েছে ভোগান্তি, অন্যদিকে রোগবালাই। পরিবেশবাদী সংগঠন পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) এক গবেষণায় দেখা গেছে, রাজধানী ঢাকায় বিভিন্ন দূষণের মধ্যে ধুলোর দূষণের অবস্থান শীর্ষে। এজন্য জনস্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতির প্রভাব বাড়ছে। জীবাণুমিশ্রিত ধুলোয় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে নানা রোগব্যাধি। গবেষণায় দেখা গেছে, ধুলার কারণে রাজধানী ঢাকাবাসীর মধ্যবিত্ত একটি পরিবারের প্রতিমাসে কমপক্ষে ৪ হাজার টাকা থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত ব্যয় হয়। এর কারণে পরিধেয় কাপড় চোপড়সহ ঘরের আসবাবপত্র ধুলায় ভরে যায়। এগুলো পরিষ্কার করতে উল্লেখযোগ্য সময় ও অর্থ নষ্ট হয়। এতে পানি ও বিদ্যুতেরও অপচয় বাড়ে। নগরীর বিভিন্ন স্থানে ফ্লাইওভার নির্মাণ, রাস্তা সংস্কার কিংবা উন্নয়নের নামে খোঁড়াখুঁড়ি চলছে উন্মুক্তভাবে। নিয়ম অনুযায়ী নির্মাণ এলাকা ঘেরাও করে কাজ করার কথা থাকলেও তা না করে মাটি, বালি, পাথর ইত্যাদি রাস্তার ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা হচ্ছে দিনের পর দিন। গাড়ির চাকায় সেগুলো পিষ্ট হয়ে ধুলা ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসে। বিশেষজ্ঞরা জানান, ধুলার মাধ্যমে বাতাসে নানা রোগের জীবাণু ছড়ায় এবং শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত সমস্যা দেখা দেয়। বিশেষ করে যাদের এলার্জি রয়েছে তাদের চরম মূল্য দিতে হচ্ছে। এছাড়া শিশু ও বৃদ্ধরা সর্দি-কাশিসহ ফুসফুসের নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। মাত্রাতিরিক্ত ধুলায় পথচারী এবং যানবাহনের যাত্রীদের অনেকেই নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। মাসের পর মাস নগরীর কেন্দ্রস্থলে এই ধুলার মহোৎসব হলেও কর্তৃপক্ষ নির্বিকার। বাড়ছে রোগবালাই। পরিবেশ অধিদফতরের তথ্য মতে, বছরের অন্য সময়ের তুলনায় শীত মৌসুমে রাজধানীর বাতাসে ধুলোর পরিমাণ বহুগুণ বেড়ে যায়। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের দূষিত নগরীর মধ্যে ঢাকার অবস্থান ২৩তম। বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদফতরের গবেষণায় দেখা গেছে, বায়ু দূষণের মানদ- পিএম ২.৫ মাইক্রোন অনুযায়ী, প্রতি ঘনমিটার বাতাসে সহনীয় মাত্রা ৬৫ মাইক্রোগ্রাম। কিন্তু ঢাকার বাতাসে আরও কয়েকগুণ বেশি, অর্থাৎ ২৭৫ মাইক্রোগ্রাম। একই সঙ্গে বাতাসে বেড়েছে কার্বনডাইঅক্সাউড, কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রোজেন যৌগসহ অন্যান্য ক্ষতিকর কণার উপস্থিতি। বেড়েছে রোগবালাই ॥ ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রাও ৩১ ডিগ্রী সেলসিয়াস এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের উপরে রেকর্ড হচ্ছে। দিনের বেলায় বিরাজ করছে গ্রীষ্মের আবহ। আর সন্ধ্যা থেকে পরদিন সকাল নয়টা পর্যন্ত অনুভূত হচ্ছে হালকা থেকে মাঝারি শীত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবেই এমনটি ঘটছে। এমন মিশ্র আবহাওয়ায় রাজধানীতে সর্দি-কাশি জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে। নগরীর অনেক হাসপাতাল ও ক্লিনিকে এমন মৌসুমি জ্বরে আক্রান্তরা ভিড় জমাচ্ছে। রোগীর কাশি অনেক সময় রূপ নিচ্ছে শ্বাসকষ্টে। কেউ কেউ আক্রান্ত হচ্ছে নিউমোনিয়ায়। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে কিছু ওষুধপত্র সেবন করলে কয়েকদিনের মধ্যেই সমস্যা কেটে যাবে। রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে মৌসুমি জ্বরে আক্রান্তের ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডাঃ এবিএম আবদুল্লাহ জনকণ্ঠকে জানান, আগের তুলনায় মৌসুমি জ্বরে আক্রান্ত রোগীর ভিড় বেড়েছে। আমার ব্যক্তিগত চেম্বারেও এ ধরনের রোগীর আগমন বেশি। সব বয়সের মানুষই আক্রান্ত হচ্ছে। চেম্বারে প্রতিদিন ১৮ থেকে ২৩ রোগী আসছে। তিনি জানান, এটি ভাইরাসজনিত রোগ। আর ভাইরাসবাহিত এসব রোগ অন্য আরেকটি রোগে আক্রান্ত হতে সহায়তা দেয়। আবহাওয়ার বিরূপ আচরণের কারণে এ সব রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি দেখা যাচ্ছে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। রোদে ঘোরাফেরা কমাতে হবে। বাইরের খোলা জায়গার খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। বেশি পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি খাওয়া উচিত। নিয়মিত শরীর মুছে দিতে হবে। জ্বর থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শে জ্বর কমানোর ও শরীরের ব্যথা কমার ওষুধ খেতে পারেন। খাওয়া-দাওয়া স্বাভাবিক রাখতে হবে। শরীরে যাতে পুষ্টির অভাব না হয়, সে জন্য পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে। শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় পুষ্টিকর খাবার। আর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ঠিক থাকলে সেই ক্ষমতা দিয়ে সাধারণ ভাইরাস জ্বর ভাল হয়ে যায়। অসুস্থ ব্যক্তিকে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে। বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে। বাইরের খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। আবহাওয়া অধিদফতর জানায়, রবিবার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা সীতাকুন্ডে ৩২.৬ ও সর্বনিম্ন সীতাকুন্ডে ১৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস রেকর্ড হয়। আর ঢাকার সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল যথাক্রমে ৩১.৩ ও ২০.২ ডিগ্রী সেলসিয়াস।
×