ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সঙ্কীর্ণতায় চাপা পড়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধারা

প্রকাশিত: ০৪:০৬, ২৮ জানুয়ারি ২০১৯

 সঙ্কীর্ণতায় চাপা পড়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধারা

২৫ মার্চ রাতে ববর্র পাকিস্তানী সেনাবাহিনী যে অকল্পনীয় হত্যাকা- চালায়, তার ফলেই প্রায় কোন রকম সামরিক প্রস্তুতি ছাড়াই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। ১৯৭১ সালের মার্চ এবং এপ্রিলে প্রাথমিক সামরিক প্রতিরোধে অংশগ্রহণকারীদের শতকরা প্রায় ৯৫ ভাগই ছিলেন পাকিস্তান সামরিক বাহিনী, ইপিআর, পুলিশ, আনসার থেকে আগত সদস্য। প্রাথমিক পর্যায়ের এই প্রতিরোধ এপ্রিলের শেষ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। একই সময়ে বিপুল সংখ্যক ছাত্র-জনতা প্রতিদিন সীমান্ত অতিক্রম করতে থাকেন ভারতে প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য। এপ্রিলের শেষ নাগাদ প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের প্রায় সবাই ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হন। টাঙ্গাইলের মধুপুরের গড় এবং রৌমারী থানা দুর্গম এলাকা হওয়ার কারনেই সীমান্ত অতিক্রম না করে এই এলাকায় প্রতিরোধ বাহিনীর বেশ কিছু সদস্য আশ্রয় গ্রহণ করেন। মে মাসের দিকে ৫ হাজার গেরিলা প্রশিক্ষণ পাচ্ছিল, যা অক্টোবরে মাসে ২০ হাজারে উন্নীত হয়। প্রতিদিনই মুক্তিযুদ্ধে বেসামরিক সদস্যদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। সামরিক বাহিনীর সদস্য সংখ্যা একই থাকার ফলে মুক্তিবাহিনীতে বেসামরিক যোদ্ধাদের অনুপাত প্রতিদিনই উল্লেখযোগ্য হারে বাড়তে থাকে। বেসামরিক ছাত্র-জনতার মধ্য থেকে ভারতের মুর্তি নামক স্থানে সামরিক বাহিনীর অফিসার হিসেবেও ট্রেনিং শুরু হয় এবং প্রথম ব্যাচ কমিশন লাভ করে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন। শহীদ লেফটেন্যান্ট আশফাকুস সামাদ বীর উত্তম, শেখ কামাল, মেজর কাইয়ুম খান (অব) এই ব্যাচেই কমিশন লাভ করেন। মাঠ পর্যায়ে যুদ্ধের নেতৃত্ব স্বাভাবিকভাবেই সামরিক অফিসারদের হাতে থেকে যায়। ১৯৭১ সালের ২১ নবেম্বর থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী সীমান্তবর্তী এলাকায় প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এবং ৩ ডিসেম্বর ভারত কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের সঙ্গে সঙ্গেই ভারতীয় সামরিক বাহিনী সীমান্ত অতিক্রম করে সরাসরি পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে লিপ্ত হয়। উল্লেখ্য, ২১ নবেম্বরের পূর্ব পর্যন্ত রৌমারী এবং বিলুনিয়া ব্যতীত কোন ভূখন্ডই মুক্তিবাহিনীর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে ছিল না। এর কারণও ছিল, কারণ মুক্তিবাহিনীর কাছে সেই সময় কোন ট্যাঙ্ক, যুদ্ধবিমান তো দূরের কথা, ট্যাঙ্ক, যুদ্ধবিমান বিধ্বংসী কোন অস্ত্রই ছিল না। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে ‘বিজয় দিবসে’ আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের কমপক্ষে ৮০ শতাংশ ছিলেন বেসামরিক ব্যক্তিত্ব (৯০এ-র মত মূলত ছাত্র এবং কৃষক, শ্রমিক) এবং বাকি অংশ ছিল সামরিক ব্যক্তিত্ব (পাকিস্তান সেনাবাহিনী, ইপিআর, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ থেকে আগত প্রায় ২০ হাজার সদস্য)। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সম্মুখযুদ্ধে নিহত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রায় ৯০ ভাগই ছিলেন অসামরিক ব্যক্তিত্ব। বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর বেশ ক’জন ঊর্ধতন কর্মকর্তা ও প্রাক্তন সেক্টর কমান্ডারদের মতে এই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মূল কারণ, বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন প্রচ- সাহসী কিন্তু আবেগ নির্ভর, বয়সে তরুণ, পর্যাপ্ত সামরিক প্রশিক্ষণ এবং সামরিক অভিজ্ঞতার অভাব। পরবর্তীতে দেশের অভ্যন্তরে ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগী এবং সাহায্যকারী হিসেবে এই সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পায়। মুক্তিযুদ্ধের ওপর প্রকাশিত যুদ্ধভিত্তিক প্রায় সব জনপ্রিয় বইয়ের লেখকই প্রাক্তন সামরিক ব্যক্তিত্ব। তারা তাদের বইয়ে বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধাদের নাম-ঠিকানা লিপিবদ্ধ করতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়েছেন। এসব অজানা বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব নিয়ে লেখা দুটি বইয়ের (‘একাত্তরের কিশোর মুক্তিযোদ্ধা’, মেজর হামিদুল হোসেন তারেক, বীর বিক্রম, ‘জনযুদ্ধের গণযোদ্ধা’, মেজর কামরুল ইসলাম ভুইয়া) লেখক ও প্রাক্তন সামরিক ব্যক্তিত্ব। শুধুমাত্র এই দুটি বই পড়লেই বোঝা যায়, এ রকম কত বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধা বীরত্বের স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের ওপর প্রকাশিত সব বইয়ের মধ্যে মেজর নাসির উদ্দিন রচিত ‘যুদ্ধে যুদ্ধে স্বাধীনতা’ একটি অসাধারণ রচনা। অসাধারণ এই কারণে, এই বইয়ে তিনি নিরপেক্ষভাবে ইতিহাস লিপিবদ্ধ করার পাশাপাশি মানবিক দিকগুলোও ফুটিয়ে তুলেছেন। এক পর্যায়ে তিনি লিখেছেন এক বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধার আকুতির কথা (সেই মুক্তিযোদ্ধার দুই সহযোদ্ধা মারাত্মকভাবে আহত) যাতে তার বন্ধুদের জীবন বাঁচানো যায়। সেই দুই আহত মুক্তিযোদ্ধা কিছুক্ষণ পরই মারা যান। আমাদের দুর্ভাগ্য, মেজর নাসিরের মতো মানবিক গুণসম্পন্ন অফিসারও কিন্তু সেই তিনজনের নাম-ঠিকানা জিজ্ঞেস করেননি বা করলেও হয়ত ভুলে গিয়েছিলেন। বীরত্বসূূচক খেতাব হচ্ছে এমনই এক খেতাব, যা শুধুমাত্র যুদ্ধে সাহসিকতা আর বীরত্বের জন্য দেয়া হয়। আমরা যদি আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতার জন্য প্রদত্ত পদক তালিকা দেখি তা হলে আমরা এসব বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধে সাহসিকতার কোন প্রতিফলন দেখতে পাই না। সাতজন বীরশ্রেষ্ঠর মধ্যে একজনও বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধা নেই! অনেক বীর উত্তমের মধ্যে মাত্র কয়েকজন আছেন বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধা। সব সেক্টর কমান্ডারকে ঢালাওভাবে, যা কিনা কর্নেল শাফায়াত জামিল, বীর বিক্রমের ভাষায় ‘খয়রাতি’ (একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নবেম্বর, কর্নেল শাফায়াত জামিল) বীর উত্তম খেতাব দেয়া হয়েছিল। ‘শহীদ এবং সাহসী মুক্তিযোদ্ধাদের বঞ্চিত করে’ কবিতায় উচ্চাভিলাষী সেক্টর কমান্ডার/সামরিক অফিসার নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে নিয়েছিলেন সব বীরত্বসূচক পদক। এ প্রসঙ্গে সবচেয়ে অবিশ্বাস্য, হাস্যকর এবং উদ্ভট যুক্তি দিয়েছেন এ কে খন্দকার! তিনি তার বইয়ের ২০৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বসূচক খেতাব প্রদানের সিদ্ধান্তে সব সেক্টর অধিনায়ক একমত ছিলেন না। কয়েকজন সেক্টর অধিনায়ক মনে করতেন, খেতাবের বিষয়টি পেশাদার সৈনিকদের জন্য প্রযোজ্য। দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খেতাব অবমাননাকর বা অপ্রয়োজনীয়। এতে করে মুক্তিযোদ্ধাদের দেশপ্রেমকে খাটো করে দেখা হয়!’ এই যুক্তি দেখিয়েই বসে থাকেননি তিনি। সত্যিকার বীরদের বঞ্চিত করে, আরও অনেক সামরিক বাহিনীর অফিসারের মতো তিনিও সম্পূর্ণ অন্যায্যভাবে পেয়েছেন সাহসিকতার জন্য দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদক ‘বীর উত্তম’! আমি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তন্ন তন্ন করে ঘেঁটে দেখেছি, কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে তার সাহসিকতার কোন প্রমাণ তো দূরের কথা, সরাসরি অংশগ্রহণেরও কোন প্রমাণ পাইনি। ১৯৬৯ -১৯৭১ এর দিনগুলোতে সজীব, সেবক, সবুজ এই তিনভাই আর খসরু মন্টু, সেলিম এর নাম ছিল মানুষের মুখে মুখে। তারা ছিল সেই সময়ের রবিনহুড! আমাদের দেশের খুব কম মানুষই জানেন যে, সেই সময়ের যুব নেতা-ছাত্র এবং বর্তমান মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রী এ কে এম মোজাম্মেল হক ১৯ মার্চ জয়দেবপুরে প্রথম প্রতিরোধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন, তারই মতো মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন (চট্টগ্রাম), সংসদ সদস্য বাহার উদ্দিন। (কুমিল্লা), সংসদ সদস্য হাসানুল হক ইনু, সাবেক সংসদ সদস্য মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, প্রাক্তন মন্ত্রী প্রয়াত সৈয়দ মহসীন আলীর মতো হাজার হাজার প্রচারবিমুখ এই ধরনের অসম সাহসী এবং ত্যাগী গণযোদ্ধাদের জন্যই আমাদের এই দেশ স্বাধীন। কিন্তু তারা পাননি কোন বীরত্বসূচক খেতাব! যেমন বীরত্বসূচক খেতাব বঞ্চিত হয়েছেন রাজারবাগ পুলিশ লাইনের সাহসী শহীদ পুলিশ ভাইয়েরা। যারা ২৫ মার্চ রাতে ৩০৩ রাইফেল দিয়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও! আমরা জানি, এসব ত্যাগী গণযোদ্ধা মেডেল বা খেতাবের তোয়াক্কা করেন না। তবুও জাতির এবং ইতিহাসের স্বার্থে বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধাদের মূল্যায়ন হওয়া অতি জরুরী। না হলে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম মনে করবে ‘‘আর্মড ফোর্সের লোকজন’ই শুধু যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিল! ভিয়েতনাম যুদ্ধের চল্লিশ বছর পর অস্ট্রেলিয়া আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রায় সাত দশক পর নিউজিল্যান্ড ‘মাউরী আধিবাসী’ বিধায় বঞ্চিত বীর’দের ‘ভিক্টোরিয়া ক্রস’ দিয়ে তাদের বীরত্বের স্বীকৃতি দিতে পারলে আমরা কেন পারব না ‘শুধুমাত্র সামরিক বাহিনীর সদস্য না হওয়ার অপরাধে বঞ্চিত’ হাজারও বীরদের স্বীকৃতি দিতে? এখনও অনেক মুক্তিযোদ্ধা জীবিত আছেন, আছেন অনেক প্রতক্ষ্যদর্শী, যারা সাক্ষ্য দিতে পারেন সেই সব চরম আত্ম্যত্যাগের! তাই আর কালক্ষেপণ না করে, সেই সব বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধাকে অবিলম্বে বীরত্বসূচক খেতাব প্রদান করা উচিত দেশের ইতিহাসের স্বার্থেই। লেখক : প্রকৌশলী, মুক্তিযুদ্ধ গবেষক [email protected]
×