ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

স্বাধীনতার পূর্ণতা যাঁর ছোঁয়ায়

প্রকাশিত: ০৩:৪৫, ১৯ জানুয়ারি ২০১৯

 স্বাধীনতার পূর্ণতা যাঁর ছোঁয়ায়

সৃষ্টির সেরা জীব হলো মানুষ। সৃষ্টিকর্তা আমাদের মেধা-প্রতিভা বিচার-বিবেক বুদ্ধি ইত্যাদি অতি মূল্যবান বস্তু দান করেছেন, যা মস্তিষ্কে ও আত্মমননে সুসন্নিবেশ করে দিয়েছেন। এগুলো আমরা সৎপথে ও সুপথে কাজে লাগিয়ে জীবন এবং মানবতার সেবার মাধ্যমে অমরত্ব লাভ করে থাকি। মানবজাতির সূচনা লগ্ন থেকেই এ বিশ্বে বহু রহস্যময় জীবনের জন্ম হয়েছে। সময়ের হাত ধরে মনীষী, মানব, মহামানবের আবির্ভাবও হয়েছে। তাদের মধ্যে লাখো কোটি মানুষের জীবনাবসান হয়েছে, যাদের কোন জীবন বৈশিষ্ট্যের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় না। আবার কিছু মানুষের জীবন ইতিহাস স্মৃতিতে অম্লান অমর ভাস্বর হয়ে সুখের অনুভূতিতে বেঁচে থাকে তাঁর কর্মের মাধ্যমে। আমাদের জীবন অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু সৃজনশীল কর্মের মাধ্যমে সীমিত পরিসর জীবন পরিধিকে বিশাল কর্মযজ্ঞে ব্যয় করে, বহুমুখী মানবতার সেবা করে জীবনকে উদ্ভাসিত করা সম্ভব। আত্মতৃপ্তির মাধ্যমে জীবনকে বিকশিত করে স্বর্গীয় অনুভূতি উপলব্ধি করতে পারি। আমরা সহজ-সরল পথের সুষ্ঠু সম্মানজনক কাজের মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিতে পারি। সত্যের কোন ধ্বংস নেই। মিথ্যার কোন বাস্তব অস্তিত্ব বা স্থায়িত্ব নেই। সত্যের সংগ্রামই মানুষকে নিয়ে যায় সর্বোচ্চ শিখরে। এ বিশ্বে যারা অমর হয়ে আছেন তারা সবাই জীবে দয়া ও মানবতার সেবা করে গেছেন। সাধারণ অর্থে যারা গণমানুষের সেবা করে গেছেন তারা এ বিশ্বজগতে অনন্য সম্মানের সঙ্গেই বিচরণ করেছেন। বর্তমান সমসাময়িক বিশ্বে যারা আলোকিত, আলোচিত তাদের মধ্যে আমার অত্যন্ত আদর্শিক চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বাঙালী জাতির পিতা। তিনি ব্রিটিশ ভারত বিভক্তির আগে থেকেই একজন অকুতোভয় নির্ভীক সাহসী রাজনৈতিক জনদরদী নেতা হিসেবে গণ্য হয়ে এসেছেন। তিনি হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের মতো বিশাল ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে থেকে ধাপে ধাপে সৃজনশীল কৌশলী নেতা হিসেবে গড়ে উঠেছিলেন। তিনি ১৯৪৭ সালের পর ’৫২, ’৫৪ থেকে শুরু করে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত একচ্ছত্র দেশপ্রেমিক নেতা হিসেবে এ দেশের শোষিত-বঞ্চিত মানুষের মুক্তির নেতৃত্ব দিয়ে দেশের সব শ্রেণীর মানুষের কাছে উজ্জ্বল প্রদীপের মতো দেদীপ্যমান। আত্মার গতি, প্রকৃতির স্রোতের বন্ধনকে এক সুতায় গেঁথে পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। নানা চড়াই-উতরাই অতিক্রম করে জাতি-ধর্ম-বর্ণ ও দলমত নির্বিশেষে একমত পোষণের সন্নিবেশ ও নির্মল সৌহার্দ্যরে মনোভাব সৃষ্টি করেছিলেন। এভাবেই তাঁর অনুপ্রেরণায় এ দেশের মানুষ স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনতে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ ও ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁর দুর্বার সাহসী উচ্ছ্বাস, নির্দেশ ও আদর্শের আহ্বানে আমরা কঠোর আন্দোলন এবং সংগ্রামের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা অর্জন করি। যদিও ১৬ ডিসেম্বর আমাদের বাঙালী জাতির জন্য এক অফুরন্ত ভালবাসা, আনন্দ ও বিজয়ের মহোৎসবের দিন; কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য পাওয়ার অপেক্ষায় বাংলাদেশের ৭ কোটি মানুষ চঞ্চল অস্থির উন্মুখ হয়ে পড়েছিলেন। তখন মনে হয়েছে আমাদের অপেক্ষার ক্ষণ যেন আর শেষ হয় না। যাঁর দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ, অক্লান্ত পরিশ্রম ও কঠোর সংগ্রাম, আন্দোলন এবং জেল-জুলুমের বিনিময়ে আমাদের এ গৌরবময় বিজয় এনে দিয়েছে, তাঁর সান্নিধ্য না থাকায় আমরা অনেকটা নিরানন্দে প্রথম বিজয় দিবস পালন করি। আমরা উন্মুখ হয়ে তীর্থের কাকের মতো তাঁর আগমনের অপেক্ষায় পথ চেয়ে থাকি। অবশেষে হানাদার বাহিনীর কর্তৃপক্ষ পাকিস্তানের জুলুমবাজরা বিশ্বের সকল নেতা ও জনগণের চাপে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। আর আমরা ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি আমাদের গর্বের এবং গৌরবের, নিরহঙ্কার, অন্যায়ের সঙ্গে আপোসহীন বাঙালীর দরদী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে পেয়ে আনন্দে আতিশয্যে বুক ভরে স্বাধীন দেশের মাটিতে সজীব নিশ্বাস ফেলি। উল্লেখ্য, পাকিস্তানের কারাগারে ২৯০ দিন থাকার পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বেলা ১টা ৪১ মিনিটে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখেন। তিনি পাকিস্তান থেকে ছাড়া পান ৮ জানুয়ারি। এদিন ভোর রাতে বঙ্গবন্ধুকে বিমানে তুলে দেয়া হয়। সকাল সাড়ে ৬টায় তিনি লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে পৌঁছান। ১০টার পর তিনি ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এ্যাডওয়ার্ড হিথ, তাজউদ্দীন আহমদ ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ অনেকের সঙ্গে কথা বলেন। ৯ জানুয়ারি তিনি ব্রিটিশ বিমানবাহিনীর একটি বিমানে দেশের পথে যাত্রা করেন। পাক হানাদাররা ২৫ মার্চ রাতেই বঙ্গবন্ধুকে ধানম-ির ৩২ নম্বর রোডের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। তাঁকে প্রথমে এ্যাসেম্বলি বিল্ডিং-এ, পরে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের একটি স্কুলের অন্ধকার ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। ছয় দিন তিনি বন্দী ছিলেন সেই ঘরে। ১ এপ্রিল তাঁকে রাওয়ালপিন্ডি, পরে মিয়ানওয়ালী জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাঁকে বাইরের পৃথিবী থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়। পাকিস্তানীদের উদ্দেশ্য ছিল শেখ মুজিবকে ভয় দেখিয়ে আপোস করতে বাধ্য করা ও তাঁর মুক্তির বিনিময়ে বাংলাদেশের অন্য নেতৃবৃন্দকে মীমাংসায় আসতে চাপ দেয়া। এতে সমঝোতা না হলে প্রহসনের বিচারের নামে বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দেয়া। বঙ্গবন্ধু বিষয়টি জানতেন। তাই নিজের পক্ষ সমর্থনের জন্য কোন আইনজীবী নিয়োগ করেননি। পাকিস্তান সরকার নিজেই উদ্যোগী হয়ে তাঁর আইনজীবী হিসেবে নিয়োগ দেয় এ কে ব্রোহিকে। বিচারের রায় আগেই ঠিক হয়ে আছে, রায় নির্ধারিত বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরে কর্তৃপক্ষকে বললেন, ‘আমার লাশটা বাংলার মানুষের কাছে পাঠিয়ে দিও।’ নির্দিষ্ট দিনে শেখ মুজিব ও ব্রোহি দু’জনই আদালতে যেতেন। তাঁরা আদালতে চুপচাপ বসে থাকতেন, তামাশা দেখতেন। সাক্ষীদের জেরা করা দূরের কথা, আইনজীবী আদালতে কথাই বলতে চাইতেন না। যদিও বা সাক্ষীদের দু-একটা প্রশ্ন করতেন, কিন্তু সাক্ষীরা প্রশ্নের বিশ্বাসযোগ্য উত্তর দিতে পারত না। এমনও ঘটনা ঘটেছে- মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে এসে পরিচিত এক ব্যক্তি শেখ মুজিবের দিকে তাকাতে পারেননি। আদালতে চোখ নামিয়ে মাথা নিচু করে ছিলেন। এমনও ঘটনা ঘটেছে- বঙ্গবন্ধুকে মানসিক চাপে ফেলার জন্য জেলখানার সেলের পাশে তাঁর জন্য কবর খোঁড়া হচ্ছিল। ১৫ ডিসেম্বর ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবের ফাঁসির আদেশ কার্যকরের আদেশ দেয়। কিন্তু ইতোমধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে তার অনুগত বাহিনীর আত্মসমর্পণের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেলে তার প্রভাব পড়ে পশ্চিম পাকিস্তানে। আত্মসমর্পণের উত্তেজনা আর দৌড়ঝাঁপের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ফাঁসির আদেশ কার্যকর করতে দেরি হয়ে যায়। এই সুযোগে ওই জেলখানার জেলার বঙ্গবন্ধুকে জেলখানা থেকে সরিয়ে নিজের বাড়িতে লুকিয়ে রাখেন। সেখান থেকে তাঁকে চাশমা ব্যারেজ কলোনিতে সরিয়ে নিয়ে যান। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ইয়াহিয়া প্রেসিডেন্ট পদ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। পাকিস্তানের নতুন প্রেসিডেন্ট হন জুলফিকার আলি ভুট্টো। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয়ার জন্য আন্তর্জাতিক চাপ বাড়তে থাকে। পরিস্থিতি বিপরীতমুখী দেখে ভুট্টো শেখ মুজিবকে মুক্তি দেবার সিদ্ধান্ত নেন। ভুট্টো বুঝতে পেরেছিলেন শেখ মুজিবের কিছু হলে বাংলাদেশে বন্দী পাকিস্তানী সৈন্য, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও তাদের অনুগতরা সেখান থেকে প্রাণ নিয়ে ফিরে আসতে পারবে না। ভুট্টো ১৯ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে রাওয়ালপিন্ডিতে সাক্ষাত করেন। প্রথম সাক্ষাতে বঙ্গবন্ধু ভুট্টোকে বলেন, ‘আমি মুক্ত কিনা বলুন’। ভুট্টো বললেন, ‘আপনি মুক্ত’ কিন্তু আমি আপনাকে যেতে দেয়ার আগে কয়েকদিন সময় চাই’। আরেক মুহূর্তে ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে বলছিলেন, ‘দুই অংশ এখনও আইন আর ঐতিহ্য দিয়ে যুক্ত।’ তখন শেখ মুজিব তাকে মনে করিয়ে দিলেন যে, ‘গত জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে আর এই ফলাফলকে কখনই শ্রদ্ধা করা হয়নি।’ বঙ্গবন্ধু এমনও বললেন, ‘যদি পাকিস্তান এখনও একটি দেশ হয়ে থাকে তাহলে আপনি প্রেসিডেন্ট নন, সেটা আমি।’ এদিকে আন্তর্জাতিক নেতারা শেখ মুজিবকে ছেড়ে দিতে বারবার পাকিস্তান সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই বিশ্ব মিডিয়ায় শেখ মুজিব ছিলেন পরিচিত মুখ। তাঁর দৃঢ় ব্যক্তিত্ব ও বাকপটুতা তাঁকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত হতে সাহায্য করে। এমনকি মুক্তিযুদ্ধে অর্থ, অস্ত্র ও কূটনৈতিকভাবে প্রত্যক্ষ সহযোগিতাকারী পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ মিত্র আমেরিকাও শেখ মুজিবকে ছেড়ে দিতে পাকিস্তানের প্রতি অনুরোধ জানায়। ২৬ ডিসেম্বর শেখ মুজিবকে চশমা ব্যারেজ কলোনি থেকে হেলিকপ্টারে করে সিহালা অতিথি ভবনে নিয়ে আসা হয়। পরের দিন ভুট্টো সেখানে এসে শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করেন এবং তাঁকে মুক্তির সংবাদ দেন। ৫ জানুয়ারি, ১৯৭২ প্রেসিডেন্ট ভুট্টো শেখ মুজিবের সঙ্গে তৃতীয় এবং শেষবারের মতো দেখা করতে যান। শেখ মুজিব ভুট্টোকে বললেন, ‘আপনি অবশ্যই আমাকে আজকে রাতে মুক্তি দেবেন। আর দেরি করার কোন জায়গা নেই। হয় আমাকে মুক্ত করুন নয় হত্যা করুন।’ ভুট্টো ৭ জানুয়ারি রাত ৩টার সময় শেখ মুজিবকে লন্ডনের উদ্দেশে বিমানে তুলে দেন। পরদিন সকাল সাড়ে ৬টায় তিনি এসে পৌঁছান লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে। হিথরো বিমানবন্দরে এই মহানায়ককে বীরোচিত সংবর্ধনা দেন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ ব্রিটিশ রাজকীয় এয়ারফোর্সের একটি বিমানে ঢাকার পথে থামলেন দিল্লীর পালাম বিমানবন্দরে। শ্রদ্ধা-সম্মান জানালেন ভারত ও তার জনগণ এবং বন্ধু ইন্দিরা গান্ধী। আদায় করলেন সৈন্য প্রত্যাহারের ওয়াদা। কৃতজ্ঞতা জানালেন ভারতের নেতৃবৃন্দ এবং জনগণের কাছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাদের সহায়তার জন্য। ঢাকা ফিরে জনগণের প্রত্যাশার জবাব দিলেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। বঙ্গবন্ধুর আগমনের মধ্য দিয়ে নেতৃত্বের একটা সঙ্কটও দূর হয়। যুদ্ধ পরবর্তী দেশ গড়তে ও উন্নতির চাকা চালু করতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব গ্রহণ ছিল সময়ের দাবি। তাই এই মহানায়কের স্বদেশে ফিরে আসা ছিল সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ॥ দুই ॥ আমাদের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা চতুর্থবার এবং টানা তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি ২৪ জন মন্ত্রী, ১৯ জন প্রতিমন্ত্রী এবং ৩ জন উপমন্ত্রীসহ ৪৭ সদস্যের নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন। গত ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণের রায়ে তিনি এই দায়িত্ব লাভ করেন। বিশ্লেষকদের ভাষায় এটা ভূমিধস বিজয়। এই বিজয়ে যেমন আনন্দ আছে, তেমনি শঙ্কাও আছে। বিশাল জয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ থাকে দুর্বল। ফলে সুযোগসন্ধানী, অনুপ্রবেশকারী ও মতলববাজরা দলে ঢুকে পড়ে। তারা এক সময় বেপরোয়া হয়ে যায়। তারা সুযোগ নিয়ে আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য সহযোগী সংগঠনেও ঢুকে যায়। ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের আগে এমন অবস্থা হয়েছিল। সবাই বাকশাল, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ হয়ে গিয়েছিল। ফলে কি হলো? আমাদের মহামানবকে আমরা রক্ষা করতে পারলাম না, আমাদের দুর্বলতার কারণে। মোশতাক-জিয়ার মতো বিশ্বাসঘাতক সুযোগ নিয়েছিল এবং আঘাত করেছিল রাতের অন্ধকারে। সেই চক্রটি যে থেমে নেই তা নানা সময় দেখা গেছে। গত দশ বছরের উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় জনগণের প্রত্যাশা অধিক হওয়া স্বাভাবিক। তবে জনগণের প্রত্যাশা পূরণের অঙ্গীকার যেমন আছে, তেমনি বাস্তবায়নেও নানা বাধা থাকে। সব বিষয় মাথায় রেখেই সামনে এগোতে হবে। মনে রাখতে হবে, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন হচ্ছে শেখ হাসিনার হাত ধরে। যেদিন শেখ হাসিনা ফিরে এসেছিলেন দেশে আমরা তখন শ্লোগান দিতাম শোককে শক্তিতে পরিণত করতে হবে। সেই শ্লোগানটি বাস্তবায়ন করেছেন শেখ হাসিনা। শোককে শক্তিতে পরিণত করে অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। ১৫ আগস্টের হত্যাকারীদের বিচার সম্পন্ন করেছেন। জাতীয় চার নেতার খুনীদের বিচার করেছেন। যুদ্ধাপরাধীদের অনেকের বিচার কার্যকর করেছেন। আমরা যা কখনও চিন্তা করতে পারিনি। বাংলাদেশকে শেখ হাসিনা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে উন্নত ও শক্তিশালী দেশ হিসেবে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। সর্বসাধারণের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। শেখ হাসিনার হাতকে কোনভাবেই দুর্বল করা যাবে না। আমাদের একটা ভুল শেখ হাসিনার শক্তিকে দুর্বল করে দিতে পারে, যা স্বাধীনতাবিরোধীদের পক্ষে পথ তৈরি করে দিতে পারে। আমি বঙ্গবন্ধুর নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ, দেশপ্রেম ও জনগণের জন্য নিবেদিত এবং সাংগঠনিক দক্ষতার আকর্ষণে তাঁর প্রতিষ্ঠিত দল আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে ১৯৬৬ থেকে একাত্ম হই। বঙ্গবন্ধুর ডাকে এবং আওয়ামী লীগের নিবেদিতপ্রাণ তাঁর ঘনিষ্ঠ সহচর সৈয়দ নজরুল ইসলামের অনুপ্রেরণায় স্বাধীনতা অর্জনের জন্য চাকরি ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধ আন্দোলন ও সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ি এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনের জন্য সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করি। অতঃপর মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র সংগ্রামে অংশগ্রহণ করার জন্য ভারতে ট্রেনিং গ্রহণ করি। এক পর্যায়ে যুদ্ধকালে মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লে ভারতের হাসপাতালে মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সহৃদয় সহায়তায় চিকিৎসায় বেঁচে যাই। আমার নিজের আত্মত্যাগ, দুঃখ-কষ্ট থাকা সত্ত্বেও দেশ স্বাধীনের পর আমাদের প্রাণপ্রিয় ও ভালবাসার প্রতীক বিশ্বের অবিসংবাদিত নেতা, স্বাধীনতার স্থপতিকে কাছে পেয়ে আমরা স্বাধীনতার প্রকৃত ও সত্যিকার স্বাদ উপভোগ করতে পারায়, তখন সকলেই উৎফুল্ল-আনন্দিত ছিলাম। কোন কোন ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ আর বর্তমান আওয়ামী লীগের মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। ১৯৭৫ সালে আওয়ামী লীগে লুকিয়ে থাকা দুষ্টচক্রের কারণে বঙ্গবন্ধুকে অকালে হারাতে হয়েছে। বর্তমানেও হাইব্রিড, ধান্ধাবাজ লুটপাটকারী চক্র আওয়ামী লীগে গুনগুন করছে। তাদের চাপে সত্যিকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অর্জনকারীদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে সুন্দর পরিপাটি বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ টিকে রাখতে হলে এখন থেকেই সুযোগ সন্ধানীদের রুখে দাঁড়াতে হবে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হলে আমাদের আরও অনেক পথ এগিয়ে যেতে হবে। লেখক : সাবেক পরিচালক, বিআরটিএ
×