ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা

প্রকাশিত: ০৪:১৮, ১৪ জানুয়ারি ২০১৯

মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা

মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে, যা প্রশংসাযোগ্য। ডিজিটাল পদ্ধতির প্রয়োগ তার ভেতর অন্যতম। ই-মনিটরিং সিস্টেমের আওতায় আসছে সারাদেশের সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। ইতোমধ্যেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষা পদ্ধতি পর্যবেক্ষণ ও পরিদর্শন শুরু করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের কর্মকর্তারা। এর ফলে শিক্ষকদের অংশগ্রহণে গতি আসবে বলে ধারণা করা যায়। সরকারের আরেকটি পদক্ষেপ হলো সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫৩ হাজার ৬৮৯টি ল্যাপটপ এবং ২২ হাজারের বেশি মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর বিতরণ করা হয়েছে। চলতি শিক্ষাবর্ষেই প্রায় সাড়ে ৫ হাজার শিক্ষার্থীকে ডিজিটাল ডিভাইস বিতরণ করা হবে। ডিজিটাল ক্লাসরুম তৈরিতে এসব কার্যক্রম বিশেষ ভূমিকা রাখবে। তবে শিশু শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার ভার থেকে মুক্ত করার উদ্যোগ না নিলে তাদের আনন্দময় পাঠ সম্পন্ন হবে না। এজন্যে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) পরীক্ষা গ্রহণের নিয়ম তুলে দেয়া জরুরী। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় পরীক্ষার প্রথম দিনেই অনুপস্থিত থেকেছে লক্ষাধিক পরীক্ষার্থী। বলা দরকার, এই পরীক্ষায় যারা অংশ নিয়ে থাকে সেইসব কোমলমতি শিশুর বয়স দশ-এগারোর মধ্যে। এই বয়সে একটি পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ নিঃসন্দেহে তাদের ওপর বাড়তি মানসিক চাপ। শিক্ষা মানে শুধু অর্থকরী কাজ বা চাকরির জন্য কিছু মানবযন্ত্র উৎপাদন নয়; শিশুর ওপর শুধু বইয়ের বোঝা চাপিয়ে তাকে মানবিক গুণসম্পন্ন আদর্শ মানবরূপে গড়ে তোলাও অসম্ভব। রাশি রাশি হাসি আর মজার খেলার মধ্য দিয়ে শিশুর পাঠদান নিঃসন্দেহে সুফল বয়ে আনে। পরীক্ষার মতো চাপসম্পন্ন শৃঙ্খলা যে একটি শিশুর ওপর বিশেষ নেতিবাচক প্রভাব ফেলে তাতে কোন সন্দেহ নেই। আজকে আমরা যদি চিত্রকর, সঙ্গীতশিল্পী ও ফুটবল এবং ক্রিকেটের মতো খেলার সঙ্গে জড়িত সফল ব্যক্তিদের দিকে তাকাই এবং তাদের জীবনে বেড়ে ওঠা সম্পর্কে খোঁজখবর নিই তাহলে আমরা দেখব তারা শৈশবকাল থেকেই এ ধরনের প্রতিভার পরিচয় দিয়েছিলেন। তাদের ঝোঁক ছিল এসব বিষয়েই। তাই কোন শিশুর কোন্দিকে ঝোঁক এবং কিসে সে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য ও আগ্রহবোধ করে সেসব বিবেচনা করে তার শিক্ষাদান নির্ধারণ করা দরকার। শুধু শুধু পরীক্ষার বোঝা চাপালে শিশুর মানসিক বিকাশ রুদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাছাড়া পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলেই তার জীবন ব্যর্থ- এমন ধারণাও অমূলক। বেসরকারী সংস্থার মোর্চা গণসাক্ষরতা অভিযানের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, এই সমাপনী পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য দেশের ৮৬ দশমিক ৩ শতাংশ বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের কোচিং করতে হয়েছে। আর ৭৮ শতাংশ সরকারী বিদ্যালয়ে কোচিং ছিল বাধ্যতামূলক। পাসের হার বাড়াতে খাতায় নম্বর বাড়িয়ে দেয়া, প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ নানা অনিয়ম হচ্ছে। পরীক্ষার হলে দেখাদেখি করে লেখা এবং উত্তরপত্র মেলানোর জন্য শেষের ৪০ থেকে ৬০ মিনিট অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এই পরীক্ষার জন্য প্রাইভেট পড়ার নির্ভরশীলতা বাড়ছে, পাঠ্যবইকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে গাইডবই। শিশুরা শেখার আনন্দ পেতে এবং সৃজনশীল হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে প্রাথমিক স্তরে এই পাবলিক পরীক্ষা সুদূরপ্রসারী নয়, ইতিবাচক ফল বয়ে আনাও অসম্ভব। অসুস্থ প্রতিযোগিতা কখনই একটি শিশুকে প্রকৃত শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে পারে না। আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যত। তাই তাদের ভবিষ্যত নির্মাণে কার্যকর ভূমিকা রাখাই হচ্ছে তাৎপর্যপূর্ণ একটি কাজ। সেই কাজটি সুন্দরভাবে সম্পন্ন হওয়ার জন্য সব পক্ষের সক্রিয় সহযোগিতা জরুরী। আমরা আগেও বলেছি, অদরকারী পরীক্ষার ভার থেকে মুক্ত হয়ে শিশুরা আনন্দময় অর্জনের ভেতর দিয়ে বেড়ে উঠুক- এটাই প্রত্যাশা।
×