ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

মোস্তফা সেলিম

ফকির ভেলা শাহের মরমী জগত

প্রকাশিত: ০৭:১৬, ১১ জানুয়ারি ২০১৯

ফকির ভেলা শাহের মরমী জগত

প্রাচীন প্রাগ্জ্যোতিষপুর বা কামরূপ রাজ্য, হরিকেল রাজ্য হয়ে যে প্রাচীন শ্রীহট্ট, সেখানেই ভাষালিপির এক বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে চতুর্দশ শতকে। পৃথিবীতে প্রচলিত কয়েক হাজার ভাষার যেখানে নিজস্ব লিপিই নেই, সেখানে এক ভাষার একাধিক লিপির যে প্রবর্তন বাংলাদেশের সিলেটে হয়; ভাষালিপির ইতিহাসে এটি এক বিরল অধ্যায়। বাংলালিপির পাশাপাশি ‘সিলেটি নাগরী’ পাঁচ শ’ বছর দাপটের সঙ্গে টিকে ছিল বঙ্গের উত্তর-পূর্বাঞ্চলজুড়ে। এ লিপির সাহিত্যজগত নেহায়ত ছোট নয়। নাগরীলিপিতে লিখেছেন সৈয়দ শাহনূর, দীন ভবানন্দ, আরকুম শাহ, শিতালং ফকির, মমিন উদ্দিন দৈখুরা, শেখ ভানুসহ বহু মরমি গীতিকবি। এই ধারায় অনন্য এক সাধক ফকির ভেলা শাহ। বাংলা সাহিত্যের মূলস্রোতে নাগরীলিপির সাহিত্যের প্রবেশ ঘটেনি অজানা কারণে। এমন গৌরবের উপাখ্যানের কোন স্বীকৃতি নেই আমাদের সাহিত্যের ইতিহাসেও। এর ফলে, নাগরীলিপির সাধকদের সঙ্গে সাক্ষাত-পরিচয়ের দীনতাও রয়েছে আমাদের। কয়েকজন কালজয়ী গীতিকবি রয়েছেন নাগরীলিপির সাহিত্যে, বিশেষত এঁদের হাতে রচিত হয়েছে বাংলা মরমী গানের অনশ্বর এক জগত। এঁদেরই একজন ফকির ভেলা শাহ, মধ্যযুগের এক শক্তিমান পদকর্তা। আঠারো শতকে তাঁর জীবনকাল যাপন করেছেন সিলেটের বালাগঞ্জে। দুই ফকির ভেলা শাহ অগণিত মরমী ফকিরদের একজন, যাঁদের জীবৎকাল সম্পর্কে খুব একটা তথ্য নেই। এ রকম ক্ষেত্রে শ্রুতি এবং অনুমাননির্ভরতায় গবেষকেরা একটা মীমাংসায় পৌঁছানোর চেষ্টা করেন। ভেলা শাহ সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার রফিনগর পরগনায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন মর্মে অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধিসহ কয়েক গবেষকের তথ্যে উল্লেখ পাই। ভেলা শাহের প্রকৃত নাম কারোরই জানা নেই। শ্র্রীহট্টের ইতিহাসের আকরগ্রন্থ শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত গ্রন্থের উত্তরাংশে চতুর্থ ভাগে জীবনবৃত্তান্ত অংশে ‘ভৌলা শাহ’ নামে এক ফকিরের বৃত্তান্ত ছাপা হয়েছে। এই ভৌলা শাহই ফকির ভেলা শাহ। এই লেখাতেও ভেলা শাহের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় নেই। তবে, তিনি যে দুর্দান্ত এক ফকির ছিলেন, সে বিষয়ে গবেষক নানা জোরালো তথ্যপ্রমাণ উপস্থাপনে প্রয়াসী হয়েছেন। ভেলা শাহকে ‘আঠারো শতকের সাধক কবি’ বলে নন্দলাল শর্মা অনুমান করেছেন। সবচেয়ে জোরালো যুক্তিটি হচ্ছে, ১৯১৭ সালে প্রকাশিত গ্রন্থ শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত উত্তরাংশে তাঁর প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে। গ্রন্থে তাঁর বিস্তারিত পরিচয় নেই। এ থেকে আমরা বুঝে নিতে পারি, ওই সময়ের থেকে বেশ কিছুকাল পূবেই বর্তমান ছিলেন ভেলা শাহ। এ ছাড়া তাঁর এলাকাটি নিষ্কর বা খাজনাবিহীন ছিল বলে আমরা সরেজমিনে জেনেছি। মুঘল আমলে বিশেষত সম্রাট আকবরের আমলে সুফি ফকিরদের সম্মানে তাদের খানকাহ ও সংলগ্ন এলাকা নিষ্কর হিসেবে ঘোষিত ছিল। সমস্ত সাক্ষীসাবুদ এবং তথ্যপ্রমাণ যাচাই-বাছাইসাপেক্ষে সিদ্ধান্তে পৌঁছা যায়, ভেলা শাহের জন্ম আঠারো শতকেই। এই তথ্য-উপাত্ত যাচাই এবং তাঁর সম্পর্কে অনুসন্ধানের জন্য ক্ষেত্র গবেষণার উদ্দেশে ৯ ডিসেম্বর ২০১৮ সরেজমিনে বালাগঞ্জের উদ্দেশে রওনা হই। সকাল সোয়া আটটায় গীতিকবি গিয়াসউদ্দিন আহমদের পুত্র সংস্কৃতিকর্মী এবং নাট্যকার মু. আনোয়ার হোসেন রনি তাঁর প্রাইভেট কারে তুলে নিলেন জিন্দাবাজারের হোটেল গোল্ডেন সিটি থেকে। তিনি পেশায় ব্যাংকার, বালাগঞ্জের গোয়ালাবাজারে ঢাকা ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক। রাস্তায় যোগ দিলেন বালাগঞ্জের মাটি ও মানুষ গ্রন্থের লেখক আব্দুল হাই মোশাহিদ। সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের তাজপুর বাজারের বামদিকের রাস্তায় প্রবেশ করে ৮ কিলোমিটার দূরে বোয়ালজুর বাজার। ওখানে তৃণমূল গবেষক মুহাম্মদ আবদুল জলিল গাইড করার জন্য আমাদের সঙ্গে যুক্ত হলেন। তিনি জানালেন, ওখানেই অনতিদূরে শায়িত আছেন সাধক মমিন উদ্দিন দৈখুরা। দৈখুরা অসাধারণ এক মরমী গীতিকবি, নাগরীলিপিতে রচনা করেছেন তাঁর গান। তাঁর দইখুরার রাগ গ্রন্থটি সম্পাদনা করেছি ২০১৪ সালে, ওটি আমাদের ‘নাগরী গ্রন্থসম্ভার’ সিরিজের একটি পুথি। দৈখুরার মাজার থেকে মাইল দেড়েক দূরে বালাগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে ৪ কিলোমিটার উত্তরে বড়ভাগা নদীর বাঁকে নন্দীবাজার ব্রিজ পেরোলেই বামপাশের গ্রাম ‘চক পিরপুর’। একটি ছোট্ট রাস্তা উত্তর দিক থেকে এসে ব্রিজসংলগ্ন রাস্তায় যুক্ত হয়েছে; ও-পথে দুই শ’ হাত এগোলেই বৃক্ষশোভিত একটি কবরস্থান। ওই কবরস্থানের এক পাশে লাল দেয়ালঘেরা একটি কবর, এটিই ভেলা শাহের সমাধি। ওর ওপরে একটি তেরোপাল দিয়ে কবরটিকে আচ্ছাদিত করেছেন তাঁর খাদেম শাহ সফিক মিয়া। ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক এই সদস্য জানান, তিনি পার্শ্ববর্তী গায়েবুল্লাহর মাজারের খাদেম। পাঁচ-ছয় বছর থেকে তিনি ফকির ভেলা শাহের মাজারের খাদিম হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। এর নেপথ্যের কাহিনীটি বেশ চমকপ্রদ। কয়েক বছর পূর্বে এক সন্ধ্যায় ভেলা শাহের কবরস্থানের পাশের রাস্তা অতিক্রম করছিলেন সফিক মিয়া, টর্চলাইটের আলোয় তিনি হঠাৎ লক্ষ্য করেন তার পথ আগলে আছে এক বিশাল দেহের সাপ। মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে তিনি উলটো পথে বাড়ি ফেরেন। ওই রাতেই প্রচণ্ড জ্বর আসে তাঁর। তখন স্বপ্নে দেখেন এক দরবেশ তার কাছে জানতে চাইছেন, তিনি কেন ফকির ভেলা শাহের উরস করেন না। স্বপ্নেই দরবেশকে প্রতিশ্রুতি দেন, তিনি উরস করবেন এবং তার পরই তিনি চালু করেন উরস। প্রতি বছর অগ্রহায়ণ মাসের ১৫ তারিখ এই উরস আয়োজন করা হয়ে থাকে। আমন্ত্রিত হয়ে আসেন কিছু বাউল শিল্পী। সারারাত গান-বাজনা হয়। তবে, ভেলা শাহের গান হয় কমই। সফিক মিয়া জানান, তার বাবা-চাচাকেও আগে মাঝেমধ্যে ভেলা শাহের উরস করতে দেখেছেন। বর্তমানে তিনি উভয় মাজারেরই খাদেম। স্থানীয় মানুষের কাছে ভেলা শাহ একজন কামেল মানুষ। তারা এই অধ্যাত্ম সাধককে স্মরণ করেন শরিয়তি সিলসিলায়। প্রতি বছর স্থানীয় ঈদগাহ ময়দানে তাঁর জন্য ইসালে সওয়াবের উদ্দেশে জলসার আয়োজন হয়। সাধক ভেলা শাহের গান বা তাঁর দর্শনের কোন চর্চা হয় না। হয় ওয়াজ নসিহত, দোয়া-কালাম। বিস্ময়ের ঘটনা, মরমী গান লিখে যে ফকির তাঁর চারপাশে ছড়িয়ে ছিলেন সুফি সৌরভ, এর কোন অস্তিত্ব নেই কোথাও। আমাদের মনে হলো, তাঁকে চর্চায় নয়, বরং আবেগে ধারণ করছেন এলাকার মানুষ। ফকির ভেলা শাহ অসাধারণ সমীহ পেয়েছিলেন তৎকালে। তাঁর সম্মানে এলাকাটি ছিল নিষ্কর। এই অনন্য অধ্যাত্মবাদীর বাড়িঘর, বংশধর কিংবা তার আয়ুষ্কাল সম্পর্কে কোন তথ্যই পাওয়া গেল না। নানা শ্রেণীর মানুষের কাছে এ সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তরে কেবলই হতাশা বেড়েছে আমাদের। এলাকায়, এমনকি, তাঁর গান নিয়ে ‘চক পিরপুর’ গ্রামের মানুষের সীমাহীন ঔদাসীন্য পীড়াদায়ক। তাঁর জন্মকাল নিয়ে রয়েছে ধোঁয়াশা। ভেলা শাহের পিতা-মাতার নামটিও উদ্ধার করতে পারেনি কেউ। ফকির ভেলা শাহ আধ্যাত্মিকতায় ছিলেন উঁচু মানের এক সুফি, ছিলেন মরমী গানের নিষ্ঠাবান এক সাধক। তাঁর সম্পর্কে প্রচলিত রয়েছে নানা জনশ্রুতি। তিনি কলাগাছের ভেলায় চড়ে সিলেটের ভাটি অঞ্চলে ঘুরে বেড়াতেন, এ কারণেই তাঁর নাম ভেলা শাহ। এই ছদ্মনামের আড়ালে তাঁর প্রকৃত নামটি চিরতরে হারিয়ে গেল। সরেজমিনে দেখা গেল, ভেলা শাহ বড়ভাগা নদীর কিনারে শায়িত। এখানে রয়েছে প্রাচীন বৃক্ষ। বৃক্ষের সঙ্গে ভেলা বেঁধে বা স্থানীয় নদীতে ভেলা চালিয়ে বা বাস করে জীবন অতিবাহিত করে এক প্রকার নিমগ্নতায় থাকার সুযোগটি হয়ত নিয়েছিলেন ফকির ভেলা শাহ। ভেলা শাহ শৈশবেই তাঁর জীবনের সবচেয়ে কঠিন অভিজ্ঞতা-অধ্যায়ের সাক্ষাত পেয়েছিলেন। পিতা-মাতা হারিয়ে তিনি এক প্রকার ভিন্ন বাস্তবতার শিক্ষা অর্জন করেছেন। আমাদের ধারণা, এই অধ্যায়ই তাঁর মধ্যে আত্মানুসন্ধানের প্রেরণা সঞ্চার করে। তাঁর মাতুলালয়ে এক খালার আশ্রয়ে কয়েক বছর কাটিয়ে, ১৫-১৬ বছর বয়সে তিনি নেমে পড়েন অধ্যাত্ম পথে। ‘পশ্চিমের পথে’ এই যাত্রা বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন ফাতেমা চৌধুরী তাঁর সিলেটী নাগরীলিপি সমীক্ষা গ্রন্থে। কিন্তু, এই পশ্চিম বাংলার প্রান্তসীমার ভেতরে, নাকি সুদূরে, তার কোন ব্যাখ্যা নেই গ্রন্থে। তবে, তিনি বলেন, ‘ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ এক কামেল দরবেশের সন্ধান পান এবং তাঁর সান্নিধ্যে দিন কাটাতে থাকেন’। এই বাক্যে যে ইঙ্গিতটি তিনি রেখেছেন, তার সারার্থ হলো, অবিরত চলতে চলতে একটা সময়ে তাঁর গুরুকে আবিষ্কার করেন ভেলা শাহ। সে ক্ষেত্রে আমরা, ফাতেমা চৌধুরীতে আশ্বস্ত হয়ে, সিদ্ধান্ত নিতে পারি, তিনি উপমহাদেশের ভূগোলের বাইরে সুদূর মধ্যপ্রাচ্যে গমন করেছিলেন। এই দরবেশই ছিলেন তাঁর মুরশিদ। এই মুরশিদের দীক্ষায় তিনি অর্জন করেন অধ্যাত্ম সাধনার দর্শন। অচ্যুতচরণ তত্ত্বনিধির মতে, তিনি ‘এক সিদ্ধ ফকিরের সঙ্গপ্রাপ্ত হন।’ গুরুর খেদমতে ভেলা শাহের একাগ্রতা সম্পর্কে তত্ত্বনিধি আরও লিখেছেন, ‘অতঃপর তাঁহার শরীর অসুস্থ হইয়া পড়িলে তিনি শয্যাশায়ী হইলেন। অনুসঙ্গীবর্গ অনিদ্রা করিয়া সতর্কভাবে তাঁহাকে রক্ষা করিতে লাগিলেন। এইভাবে অনেকদিন গেল, শিষ্যবর্গ অবিরত অনিদ্রা থাকিয়া ক্লান্ত হইয়া পড়িলেন। তাঁহাদের গুরুভক্তি ক্রমশ কমিতে লাগিল। তখন আর সকলে কাছে থাকেন না, পাশ কাটিয়া এড়াইতে পারিলেই সুখী! কিন্তু একজন শিষ্য এই রোগাক্রান্ত হন নাই।’ তিনি অন্য কেউ নন, স্বয়ং এই ভেলা শাহ। ফকিরের বিদায়লগ্ন উপস্থিত হলে, এক রাতে শিষ্যদের ডাকলেন। সকল শিষ্য নিদ্রাবিভোর হলেও তখনও মুরশিদের সেবার জন্য জেগেছিলেন ভেলা শাহ। ফকির তাঁকে কাছে যেতে ইঙ্গিত করলেন, ভেলা শাহের মাথায় হাত দিয়ে ‘আমি চলিলাম, আমার যাহা কিছু ক্ষমতা, তাহা তোমাতে সঞ্চারিত হউক, এক্ষণে দেশে যাও’- এই আশীর্বাদ করে দেহান্তরিত গুরু। এই পির, যার অন্য অভিধা মুরশিদ, তাঁর মৃত্যুর পর ফকির ভেলা শাহ ফিরে এলেন স্বভূমে, সিলেটের বালাগঞ্জে। মরমী জীবন, অধ্যাত্মসাধনায় তখন তিনি ব্যাকুল। তাঁর এই সাধন-ভজনের সুবাস দ্রুতই ছড়িয়ে যায় তাঁর অঞ্চলে। সাধারণ মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে তাঁর ডেরায়। ফকিরের তাতে অস্বস্তি কমে না, ক্রমেই বাড়ে। অধ্যাত্মচর্চায় দীক্ষিত মানুষের স্বভাব হচ্ছে নিজেকে গুটিয়ে, নিভৃতে মহামহিমের সান্নিধ্য অর্জনের সাধনা করা; তপজপ করে স্রষ্টার নৈকট্য লাভের জন্য নিজেকে ব্যস্ত রাখা। কিন্তু সেটা কি সম্ভব হয়? হয় না। গোলাপ শুধু বাগানকে পুষ্পিত করে না, চারপাশে ছড়িয়ে দেয় সৌরভ। তাতে মাতোয়ারা হয় প্রেমিক মন। পির-ফকিরেরা যখন অধ্যাত্মসাধনার চূড়ান্ত স্তরে বা মার্গে অবস্থান করেন, তখন তাঁরা কেরামতি বা অলৌকিক কিছু শক্তি অর্জন করেন। ভেলা শাহের জীবনেও এই সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ভেলা শাহ সম্পর্কে অনেক জনশ্রুতি প্রচলিত। তত্ত্বনিধি মহাশয় এ রকম একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন। সিলেট শহরের এক জমিদারের যুবতী কন্যা বস্ত্র পরিধানে অনাগ্রহী ছিলেন। কোনভাবেই তাকে যখন বস্ত্র পরিয়ে ভদ্রস্থ করা যাচ্ছিল না, তখন বাধ্য হয়ে তাকে প্রায় গৃহবন্দী করে রাখতেন পিতা। কন্যার এহেন আচরণে গৃহস্বামী ছিলেন অসহায়। কিন্তু পিতৃহৃদয় ছিল ব্যথাতুর। একদা তার কাছে পৌঁছাল ফকির ভেলা শাহের নানা কেরামতির খবর। ছুটে এলেন তিনি ভেলা শাহের কাছে। জমিদারের আকুতি শুনে ভেলা শাহ একদিন গেলেন জমিদারবাড়িতে। ফকির বাড়িতে পা রাখতেই, জমিদারকন্যা বস্ত্র পরিধানের জন্য উপস্থিত সকলের কাছে অনুরোধ শুরু করেন। এ ঘটনার পরই তার বস্ত্র পরিধানে অনাগ্রহ কেটে যায় এবং তার বিবাহ হয়। ভেলা শাহের অসংখ্য ভক্ত জোটে তাঁর জীবদ্দশায়। শিষ্যদের মধ্যে নাইর শাহ, পিয়ার শাহ এবং লাল শাহ উল্লেখযোগ্য। ভেলা শাহ লিখেছেন বহু গান। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে, তাঁর জীবনকাল, জন্মঠিকুজি এবং জীবনসংশ্লিষ্ট নানা তথ্য যেমন আমাদের জানা নেই, তেমনি তাঁর অমর সৃষ্টি সম্পর্কেও আমরা অজ্ঞাত। তিনি কতসংখ্যক গান লিখেছেন, তা এখনও অজ্ঞাত; এই হিসাবটি হয়ত কোনকালেও আর পাওয়া যাবে না। তাঁর প্রাপ্ত একমাত্র পাণ্ডুলিপি খবর নিশান। তিন আঠারো শতকের গোড়ায় ভারত মহাদেশে চালু হয় মুদ্রণ। নাগরীলিপির পাণ্ডুলিপি মুদ্রণ শুরু হয় ১৮৭০ সালে, সিলেটের ইসলামিয়া প্রেসে। বিভিন্ন বিষয়ে প্রায় অর্ধশত পুুঁথি মুদ্রিত হয়েছে সে সময়ে সিলেটের ‘ইসলামিয়া প্রেস’ এবং ‘সারদা প্রেস’-এ। একই সময়ে কলকাতার বটতলায় ‘হামিদী প্রেস’ এবং ‘জেনারেল প্রিন্টিং ওয়ার্কস প্রেস’ থেকে নাগরীলিপি ছাপা হয়েছে। কিন্তু ভেলা শাহের খবর নিশান পাণ্ডুলিপি বা পুঁথি আকারেই ছিল। পরবর্তীকালে এর মুদ্রণ হয় এবং একাধিক সংস্করণ প্রকাশিত হয়। আমাদের হাতে যে পাণ্ডুলিপি আছে, এর কপি ছিল লন্ডনের বার্মিংহামে বসবাসকারী আব্দুল হামিদের কাছে। এ বছরে (সেপ্টেম্বর, ২০১৮) লন্ডন সফরকালে তিনি আমাকে তাঁর বাড়িতে আমন্ত্রণ করেছিলেন এবং হাতে থাকা কয়েকটি পাণ্ডুলিপি আমাকে হস্তান্তর করেন। ১৯৯০ সালে তাঁর উদ্যোগে বার্মিংহামে আয়োজিত হয়েছিল নাগরীলিপির একটি আন্তর্জাতিক সেমিনার। সেখানে আমন্ত্রিত হয়ে অংশগ্রহণ করেছিলেন সিলেটপ্রেমী গবেষক মুহম্মদ আসাদ্দর আলী (১৯২৯-২০০৫)। নানা রকম পুঁথির বাক্সভর্তি ফটোকপি তিনি সঙ্গে নিয়েছিলেন। এই পুঁথির সংগ্রহটি অনুষ্ঠানের আয়োজক আব্দুল হামিদের কাছে তিনি রেখেছিলেন। মুহম্মদ আসাদ্দর আলীর সংগ্রহে ছিল নাগরীলিপির বিপুল পরিমাণ হাতে লেখা পুঁথি এবং মুদ্রিত গ্রন্থ। তাঁর এই সংগ্রহে ভূমিকা ছিল ‘নাগরীস্যার খ্যাত’ অধ্যাপক এরহাসুজ্জামান (১৯৪১-২০১৮) এবং ‘সিলেটবন্ধু’ আমিনূর রশীদ চৌধুরীর (১৯১৫-১৯৮৫)। আসাদ্দর আলীর মৃত্যুর পর সেগুলোর কোন হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। আমাদের ধারণা, কোন চতুর লোকের কাছে বাক্সবন্দী হয়ে আছে তিল তিল শ্রমে সংগৃহীত তাঁর ওই সম্পদ। আব্দুল হামিদের কাছ থেকে সংগৃহীত পুথির পৃষ্ঠাসংখ্যা ৩০। পাণ্ডুলিপির পৃষ্ঠার সাইজ ৮ ইঞ্চি ী ৬ ইঞ্চি। পুথির পুষ্পিকায় বলা হয়েছে ‘খবর নিশান পুথি’ তামাম হয় ১৩৩৩ তাং ১৮ কার্ত্তিক রুজ বৃহস্পতিবারে এই পুথির মালীক লেখক শ্রীফয়াজ আলী, সাং রাধানগরপুর পং চৈতন্যনগর পোঃ আঃ গোবিন্দগঞ্জ জিলা-শ্রীহট্ট স্টেশন ছাতক মহকুমা সুনামগঞ্জ ॥’ এর নিচে ফার্সিতে দুটো লাইন লিপিবদ্ধ রয়েছে, ‘আগর কিছি দা’ওয়া মি কুনদ ই কিতাব / বরোজ কিয়ামত শোদ লা জাওয়াব’ অর্থাৎ ‘যদি কেউ আমার কাছে এই কিতাব সম্পর্কে দাবি করে; তাহলে কিয়ামতের দিন তার উত্তর দেয়ার কিছু থাকবে না।’ পুষ্পিকার তথ্য মতে, এই পুঁথিটি ৯২ বছর আগে অর্থাৎ ১৯২৬ সালে দিকে লিখিত। সম্প্রতি খবর নিশান-এর অন্য একটি মুদ্রিত গ্রন্থ (৮ ডিসেম্বর, ২০১৮) আমাদের হস্তগত হয়েছে। ওইদিন সিলেট সদর উপজেলার পরগনার বাজারের নয়াগাও গ্রামের মোঃ তসলিম উদ্দিন বারিকের বাড়িতে যাই এই পুঁথি সংগ্রহের জন্য। বারিক মিয়ার বাড়ি নয়াগাঁওয়ের মানুষের কাছে ‘কোর্টের কোনা’ নামেই পরিচিত। একটি বড় টিলায় পার্শ্বদেশে তাঁর গৃহস্থবাড়ি। এই টিলায় গৌড় গোবিন্দের সময়ে ছিল থানা এবং গারদ। বারিক মিয়া জানালেন, তাঁর পরিবার ওখানকার প্রাচীন বাসিন্দা। বুরহান উদ্দিনের আমল থেকেই ওখানে তাঁদের পূর্বপুরুষদের বাস। বারিক মিয়ার পোশাকি নাম মোঃ তসলিম উদ্দিন বারিক। পিতা আরশাদ আলী তরফি মিয়া ছিলেন নামডাকওয়ালা পুঁথিপাঠক। আশপাশের দশ-বিশ গ্রামে ছিল তাঁর পসার। বারিক মিয়া পিতার কাছ থেকে শিখেছেন পুঁথি পাঠ এবং উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন কয়েকটি পুঁথি। বারিক মিয়ার জীবনের বেলা গড়িয়ে এখন অস্তাচলে। তিনি জানালেন, এখনও আশপাশের গ্রামে তাঁর আসর হয়। দূর গ্রামে ডাক পড়ে তাঁর। বালাগঞ্জ, বিশ্বনাথ, গোলাপগঞ্জের নানা গ্রামে তাঁর আসর হয়, বিশেষত শীতকালে। তসলিম উদ্দিন বারিকের কাছ থেকে সংগৃহীত বইটি সম্পূর্ণ নয়। ৯৪ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থেও প্রথম ১-৪ পৃষ্ঠা নেই এবং ৫-৮ পৃষ্ঠা আংশিক এবং ওই পৃষ্ঠাগুলোর নিচের দু-একটি লাইন নেই। আবার ৯ এবং ১০ পৃষ্ঠা নেই। গ্রন্থের ৮৭ পৃষ্ঠা পর্যন্ত ভেলা শাহের রচনা। ৮৮ থেকে ৯৪ পৃষ্ঠায় ‘বারমাসী’ শিরোনামে অন্য কাহিনী। এই অংশ ভেলা শাহের রচনা নয়। এ সংযোজন সম্ভবত প্র্রকাশক করেছিলেন। এ বইয়ের সাইজ ৮ ইঞ্চি ী ৫ ইঞ্চি। গ্রন্থের পাতাগুলো বেশ শক্তপোক্ত, সম্ভবত এটি বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকেই মুদ্রিত। এই গ্রন্থে গান বা রাগের পাশাপাশি পয়ার রয়েছে। পয়ারগুলোতে ধর্মীয় নানা বিষয়ে আলোচনা রয়েছে। আমাদের সংগ্রহে অন্য আরেকটি মুদ্রিত খবর নিশান রয়েছে। এই গ্রন্থের পাটা নেই, নেই আখ্যাপত্র। এ কারণে এটি কবে, কোথায় এবং কে প্রকাশ করেছিলেন, তার সুরাহা করা যায়নি। এর পৃষ্ঠাসংখ্যা ৮৪। গ্রন্থের সূচনা পৃষ্ঠার ঊর্ধ্বাংশে একটি মসজিদের প্রতিকৃতির মধ্যে আরবি হরফে ক্যালিগ্রাফিতে আল্লাহু লেখা রয়েছে। বইটির বাহ্যিক গড়ন-বৈশিষ্ট্য দেখে মনে হচ্ছে এটি ৭০-৮০ বছর আগে মুদ্রিত। এখানেও কয়েকটি রাগ এবং পয়ার রয়েছে। ভেলা শাহ তাঁর পয়ারে মূলত ধর্মীয় বিষয় আলোচনা করেছেন দ্বিপদী ছন্দে। এই গ্রন্থে রয়েছে ৩৪টি গান। এই গানগুলোতে ভেলা শাহের মরমীচিন্তার প্রতিফলন আমাদের অবাক করে। তত্ত্বকথার এই গানে ফকিরি, পদাবলি ইত্যাদি অনবদ্য এটি রূপ মূর্ত হয়ে ওঠে আমাদের মানসলোকে। খবর নিশানের গানগুলো বর্তমান গ্রন্থে সঙ্কলন করা হয়েছে। গানগুলো নানা রাগের, নানা ভাবের। তবে, সবই সমর্পিত হয়েছে পরমাত্মার সঙ্গে বন্ধুত্বের আকাক্সক্ষায়। চার সুফি সাধনার তরিকায় একা একা কেউ দীক্ষিত হতে পারেন না, সাধনপন্থা এবং সুফি তরিকার জ্ঞানের জন্য প্রয়োজন হয় একজন মুরশিদের কাছে দীক্ষা গ্রহণের। ভেলা শাহ একই তাগিদ রেখেছেন গানে। এই কথারই ইশারা, সঙ্কেত দেখি গানে, ‘পির মুরশিদকে না ভজলে নামাজ রোজা অসাড়’। অন্য গানে তিনি বলেন, ‘আকাশটার নউকা ভাইরে লাগিআছে কত গুড়া ॥/ শুজন কানডারি নাএর শুইনে করে উড়া */ এই নাএর ভরশা নাই রে পলকে ডুবি জাইব ॥/ শুজন কানডারি নাএর উড়াল বৈটা বাইও রে*/ উড়াল বৈটা বাইও নাএর পির মুরশিদ ভজিআ ॥/ আবৈশ দএআর নাতে লইব তরাইআ*’ শরিয়তপন্থী এবং সুফিদের মধ্যে স্রষ্টার নৈকট্যলাভের সাধনা অভিন্ন হলেও সাধনচর্চায় রয়েছে ভিন্নতা। ভেলা শাহের গানের দর্শনে লক্ষণীয় হচ্ছে এ-দুয়ের একটি মিথষ্ক্রিয়া বা সমন্বয়। তিনি সুফি, তবে শরিয়তপন্থী, কিন্তু সাধনভজনে তিনি মুরশিদকে দিশারী হিসেবে বেছে নেন। তাঁর মতে, মুরশিদের দীক্ষা না নিলে কলমা, নামাজ, রোজা অসাড়। তাঁর গানে এর কঠিন সমর্থন মেলে, ‘কলমার জিকির বিনে আর জিকির নাই */ কলমার জিকির জফ ভাইরে আর জিকির নাই ॥’ একই গানে অন্যত্র গাইছেন, ‘রুজা রাখ নমাজ পড় ওজু কর শার ॥/ না ভজিলে পির মুরশিদ শকলি ওশার*’ ভেলা শাহের ভিন্ন ভিন্ন গানে একই প্রতিধ্বনি, একই সুর। সুফিবাদে তিনটি মতবাদ প্রচলিত, তবে ‘জিলানী প্রমুখ মধ্যপন্থা নিয়ে শরীয়তের সঙ্গে আপোস করে নেন’। ভেলা শাহ এই সমন্বয়বাদী সুফি তরিকায় যে প্রবলভাবে বিশ্বাসী ছিলেন এর প্রমাণ তাঁর গানের বাণী। এ কারণে শরীয়তপন্থি এবং সুফিবাদী উভয় তরিকার মানুষের কাছে তাঁর ছিল গ্রহণযোগ্যতা। সরেজমিন আমরা এই বিষয়টির সত্যতা দেখেছি। জীবন মানেই শ্বাস-প্রশ্বাসের খেলা, আসা-যাওয়া। দেহখাঁচায় বন্দী যে জীবন, তার অস্তিত্বচিহ্ন হচ্ছে দম। জীবন হচ্ছে দমেরই অস্তিত্ব। বাউল ফকিরেরা দম সাধনা করে সিদ্ধি অর্জনের চেষ্টা করেন। ফকিরি সাধনায় দম নিয়ন্ত্রণ করে সাধকেরা জীবনের অনিত্যতার চর্চা করেন। ঘুমে অচেতন দেহে দম যাওয়া-আসা করে অবিরত। সেই ঘুম হচ্ছে জীবনের বৈরী। তন্দ্রালোকে দমের পাখি উড়াল দিলে দেহ হয় নিথর। তাই, ফকির ঘুমের জন্য সতর্ক হওয়ার বার্তা দিয়েছেন তাঁর গানে। ‘দুইটি আংকি লাগিআ জাইব শেশে রে/ দুকেরি মন্দিরে ০ শুকে নিদরা জাইও রে ০’ প্রেমাত্মায় একাকার হয়ে সুফিপন্থী বাউল ফকিরেরা লাভ করেন অপার্থিব সুখ, যাকে স্বর্গ-বেহেশত বলেন শাস্ত্রবাদীরা। প্রেমাত্মার সঙ্গে ভেলা শাহ ফকিরের মিলনের সুতীব্র বাসনা তাঁর এক গানে মূর্ত হয়ে ওঠে। পাগলপারা ফকিরের অন্তরাত্মায় ‘ঝুরে পরানিরে’। প্রাণবন্ধুর সঙ্গে বিরহের হতাশাই ফোটে তার গানে। তিনি বলেন, ‘নএআনে বহে জল ধারারে বন্দু দুক শহিতে না পারি ॥/ কেমনে বনচিমু ঘরেরে বন্দু ওবাগিনি নারী রে */ নিরবদি দহে পরানিরে বন্দু দুক শহন না জাএ ॥/ ডাকিতে না শুন আরে বন্দু কি হৈব উফাএ ওরে */ ভেলাশা ফকিরে কহেরে বন্দু কাতর হৈআ ॥/ তুমি বন্দে ধর দএআরে বন্দু ওধম জানিআ রে * দিল বা আত্মা বাস করে অন্ধকার কোঠরে, অধ্যাত্ম আলোয় যখন জ্যোতির্মান হয় মানুষের আত্মা, তখন তাঁর আভায় উদ্ভাসিত হয় দশ দিক। চিত্তকে শুদ্ধ করেই অর্জন করে নিতে হয় মুক্তির পথ, ফকিরদের সাধনার গন্তব্য এই-ই। ভেলার গানে পাই তাঁর তত্ত্বদর্শন, ‘আন্দাইর ঘরে জলে বাতি দিপত তেল নাই ॥/ রুশনি হইলে শকলে দেকে কমিতে নিলএ নাই*’ প্রেমে জয়, শক্তি ক্ষয়ে নয়। ভেলার গানে তাঁর বন্ধুকে পাওয়ার আকুলতা বড়ই হৃদয়গ্রাহী। তিনি তাঁর সমস্ত আয়োজনের ডালি সাজিয়ে রেখে গাইতে থাকেন, ‘কার টাইন কহিমু দুকরে বন্দু কেবারে শুনিব ॥/ জার লাগি ঝুরে পরানিরে বন্দু কেবা আনিআ দিব রে*’ সাধনায় এবং সুফিচিন্তায় মার্গের সর্ব্বোচ্চ স্তরে পৌঁছে গিয়েছিলেন ভেলা। তাঁর গানে এর প্রকাশ দেখি, ‘নউকা বাইআ জাওরে নউকা বাইআ জাওরে ॥/ গহীন শাগরে নউকা বাইআ জাও রে */ লাহুত মনজিলের ফিআল আতশের ধার ॥ / ধিরে ধিরে বাইও বৈটা শমদুর হৈবাএ পার */ মলকুত মনজিলের ফিআল নফছ তার আবি ॥/ পানচ বৈটা পড়ে নাএর গলই এ জলে বাতি ॥/ নাছুত মনজিলের ফিআল নফছ তার বাদি॥/ নাএ বশি কর ধিআন লাগাইআ দুইটি আংকি*/ জবরুত মনজিলের ফিআল নফছ তার খাকি ॥/ তনে মনে একছতর করি করএ বন্দেগি*’ প্রেমের প্রতীক রাধা-কৃষ্ণ বাউল ফকিরদের গানে রূপক হিসেবে ঘুরেফিরে এসেছেন। ভেলা শাহ এক্ষুণে ব্যতিক্রম নন। তিনি বলেন, ‘মনে উটে অনেক জালা০ ভাবিতে চিন্তিতে রাদার তনু কালা ॥/ ঘরে বএরি দারুন ননদিনি রে*/ শশুড়ি হৈল পরানের বএরি০ ঘরের বার না হইতে পারি ॥/ লুকে বুলে রাদা কলংকিনি রে*/ মুই নারি ওবুলা০ দএআ ধর শাম কালা রে॥/ শংগে নেও ওবুলা রাদারে*/ গকুলের লুকে বুলে আর০ পিরিতি হৈল রাদার গলার হার॥’ স্রষ্টার গভীর প্রেমে ভেলা শাহ ছিলেন অধীর, তার প্রেমেই আত্মহারা হয়ে তাঁকে অন্তহীন খুঁজেছেন তিনি। তাই তাঁর প্রতিটি গানেই প্রেমাত্মার প্রতি মিলনের আকাক্সক্ষা এবং না পাওয়ার বিরহের করুণ সুর বাজে। ভেলার একটি গান, ‘কদম ডালে বশিআ বন্দে শদাএ ফুকে বাশি ॥/ না ভরিলাম যমুনার জল হৈলাম উদাশি */ কতা হনে আইশে বাশি কতা চলে জাএ॥/ ধিআন করি চাইআ দেখ কতাতে মিশাএ*/ কহে ফকির ভেলাশাহএ বাশি বড় ধন॥/ নিকুঞ্জ মন্দিরে বাজে বাশি জফে নিরন্তর*’ ভেলা শাহ বন্ধুর প্রেমে আকুল। দিবানিশি অন্তরে বাস করছেন তাঁর নিরঞ্জন। স্বপ্নে তিনি বন্ধুর দেখা পেলেও জাগ্রত হলে তাঁর হাপিত্যেশ বেড়েই যায়। এ অপ্রাপ্তির বেদনায় তাঁর মন দাউ দাউ করে জ্বলে। এই জ্বালার বিবরণ পাই তাঁর এক গানে। ভেলা শাহ বলেন, ‘বনেতে ওগুনি জলে দেখে শরব জনে॥/ ওবাগির হিদরে আনল জলে রাতর দিনে*।’ জগতে রয়েছে নানা পথ-মত, ধর্ম, আচার-উপাচার। সৃষ্টিকর্তা বা ঈশ্বরের নামে মানুষের মধ্যে চলমান সব ধর্ম বা পন্থা সঠিক নয়। ভেলা শাহ প্রেমাস্পদকে পাওয়ার জন্য পথ নির্ধারণ করে উপাসনার ইঙ্গিত করছেন তার গানে : ‘পন্থ চিন নারে আরে মন০ পন্থ চিন শার॥/ ভবের জনম বেরথা গেলে না আশিব আর*/ শাদুর শনে পন্থ লইলে পন্থের পাএ দিশা॥/ হারিলে দিনের পন্থ পাইবার নাই তার আশা*’ অর্থবিত্ত, বংশগরিমা এবং রূপের অহমিকা অধঃপতনের পথে মানুষকে নিয়ে যায়। রূপ ক্ষণস্থায়ী, স্বল্পায়ু। যৌবনে ভাটা এলে, রূপের বন্দরে তখন আর কেউ তরী ভেড়ায় না। ভেলা বলেন, ‘রুফ গেল রুফের বাজারে জউবন গেল গৈআ॥/ হারিলাম ওমুইলি ধন পাফে মন দিআ* শমএ কালে ছিল রুফ ওশমএ কালে নাই॥ এ ভবে না করিও মমিন এ রুফের বড়াই*’ ভেলা শাহ নদীতীরের মানুষ। তাঁর নিবাস ছিল বড়ভাগা নদীর কিনারেই। ভেলা ভাসিয়ে নদীতে ভেসে বেড়াতেন উদাসী এই ফকির। নদী তাঁর সখা, নৌকা এ কারণে তার গানে রূপক হিসেবে এসেছে। নৌকা উনিশ গুড়া লেগেছে। এই উনিশ গুড়ার ভিন্ন নাম করেছেন মহাজন। ভেলা শাহ বলেন, ‘মুরশিদ কি বলিমু কারে ॥/ আনিআ হারিলাম ধন বন্দুআর বাজারে */ পুরবে পশর নাএ পশ্চিমে বাতি জলে ॥/ উত্তরে গলই নাএ দকিনে কানডার ধরে* পরবাতে মেলিলু শান্তার শমদুরে বালুচর ॥/ চারি আঙ্গুল পাতাল নাএ বুজিআ কানডার ধর */ নাএর ছিফত কহি শুন ভাই মমিনে ॥/ উনৈশ গুড়া লাগিছে নাএ জানএ শুজনে*/ উনৈশ গুড়া উনৈশ নাম রাকিছে করতাএ ॥/ কুনু লুকে না চিনে তারে কি হৈব উফাএ*’ ভেলা শাহের সকল গানেই বেজেছে মরমি সুর। তাঁর রচনায় সহজিয়া ধারাটি যেমন স্বতঃস্ফূর্ত, তেমনি অধ্যাত্মবাদের মার্গীয় প্রকাশ রয়েছে সাবলীলভাবে। ফকিরি-বৈষ্ণবীয় মিলিত ধারায় তাঁর গানের বাণী পুষ্ট। এক অনন্য বাণীসমৃদ্ধ কথাছন্দে মূর্ত হয়েছে প্রেমের মন্ত্রধ্বনি। তৈরি হয়েছে ভেলাময় এক অপার্থিব স্বর্গীয় প্রেমের জগত। পাঁচ খবর নিশান-এর ভাষা এবং শব্দের ব্যবহার-প্রয়োগে নিজস্বতা বা স্বাতন্ত্র্য চোখে পড়ার মতো। গ্রন্থের ভাষা কিছুটা খটোমটো ঠেকতে পারে পাঠকের কাছে, এর অবশ্য কারণও আছে। বাংলাদেশের যে কয়েকটি উপভাষা বা আঞ্চলিক ভাষার রয়েছে চমৎকার নিজস্বতা, এ গোত্রের একটি উপভাষা, সিলেটি। এর পেছনে ঐতিহাসিক, ভৌগোলিক কারণ রয়েছে। সিলেটের উপভাষায় রচিত হয়েছে নাগরীলিপির গোটা সাহিত্য। গণমানুষের কাছে বিপুল আদৃত নাগরীলিপিতে সেকালে সাধু-ফকিরেরাও তাঁদের গান রচনা করেছিলেন। গ্রন্থে আরবী, ফারসি এবং বিদেশাগত আরো কিছু শব্দ আমাদের নজরে পড়ে। এ ছাড়া কিছু শব্দের আঞ্চলিক প্রয়োগ হয়েছে। সিলেটে ১৩০৩ সালে হজরত শাহজালালের প্রযত্নে এক সুফি কাফেলা এসে পৌঁছে। আরবের নানা অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে এই দলে, পথে পথে যোগ হয় আফগানিস্তান ও ভারতের নানা প্রদেশের সুফি মতাদর্শের বহু মানুষের। হজরত শাহজালালের কাফেলায় সিলেট অবধি লোকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ৩৬০ জনে। সিলেটে পৌঁছে তাঁরা মতাদর্শ প্রচারের জন্য ছড়িয়ে পড়েন সিলেটের কেন্দ্রে-প্রান্তে। এরাই মূলত সিলেটে আরবী, ফারসি শব্দের বাহক। এ ছাড়া ‘রাজভাষা’ ফারসি এবং ‘ধর্মভাষা’ আরবী হওয়ায় তা দ্রুত প্রসার লাভ করে এ অঞ্চলে। বাংলাদেশের সিলেটে অঞ্চলের শব্দভাণ্ডারে তাই এত বৈচিত্র্যের সমাহার। এ ছাড়া সুফিবাদের আঁতুড়ঘর যেহেতু পারস্য-আরবে, তাই সুফি দর্শনের বিভিন্ন পরিভাষা হচ্ছে আরবী, ফারসি। একারণে ভেলা শাহের গানে আরবী-ফারসি শব্দের ছড়াছড়ি। ছয় ফকির ভেলা শাহের গানের সংখ্যা কম নয়। খবর নিশান গ্রন্থে সঙ্কলিত হয়েছে তার মাত্র কয়েকটি গান। এই অল্প কয়েকটি গানের মর্মবাণীতে খুঁজে পাই এক অসাধারণ মরমীমানস। তাঁর গানের সমস্ত ভুবন যদি পরিভ্রমণ করা যেত, নিশ্চিত করে বলা যায়, আমরা সন্ধান লাভ করতাম আরো বিপুল ও বিচিত্র এক জগতের।
×