ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রবার্ট ফ্রস্ট ॥ দৃষ্টির সীমানা পেরিয়ে

প্রকাশিত: ০৭:১০, ১১ জানুয়ারি ২০১৯

রবার্ট ফ্রস্ট ॥ দৃষ্টির সীমানা পেরিয়ে

সাদিক ইসলাম। রবার্ট লি ফ্রস্ট (১৮৭৪-১৯৬৩) ছিলেন আমেরিকার কিংবদন্তি কবি ও নতুনের স্বপ্নদৃষ্টা। রবার্ট ফ্রস্টের কবিতাগুলো প্রকৃতির নিটোল, সরল চিত্র আর মানব জীবনের প্রতিদিনকার ঘটনাগুলো অঙ্কিত করলেও সাধারণের ভেতরেই জীবনকে গভীরতর রহস্যের আবর্তে ফেলে দেয়। প্রকৃতির সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল Lovers quarrel এর মতো কখনও মধুর, কখনও তিক্ত, কখনও অভিমানের। তিনি প্রথাগতভাবে প্রকৃতিকে না দেখে, চিরায়ত বিশ্বাসকে গ্রহণ না করে নিজস্ব আধুনিক একটি ধারা সৃষ্টি করেন। যেমনটি ‘Road not Taken’ কবিতাটির নাম দিয়ে স্পষ্ট। ব্যতিক্রম ছিল তার কাছে গ্রহণযোগ্য আর স্বাভাবিক সত্যকে বিসর্জন দিয়ে তিনি নিজের মতো তৈরি এক সত্য দিয়ে প্রকৃতিতে এক ভিন্নতর সত্য খুঁজে পান অস্পষ্টতা যেখানে স্পষ্ট হয়ে ওঠে কবি চেতনায়। গাছ, ফুল, ফল, পাখি, মথ, মাকড়সা, বনভূমি, বরফখন্ড, অরণ্য-বৃক্ষলতা-পাহাড়-নদী, মাটি, পাথরখ-, নিরাভরণ সবুজকে গ্রহণ করে কবি গজিয়ে ওঠা আধুনিকতাকে পরিত্যাগ করেন কিন্তু প্রকৃতির মাঝে যে গভীর রহস্য তার ব্যাখ্যা তিনি যেন উহ্যই রেখে যান তার নতুন স্বাদের দ্ব্যর্থক কবিতাগুলোতে। বাস্তব পৃথিবী কবি চিন্তায় কখনও কখনও পরাবাস্তবরূপে রূপান্তর লাভ করে। ওয়ার্ডসওয়ার্থ প্রকৃতিতে ঈশ্বরের সৃষ্টি আর মায়া দেখেন স্বরূপে, রবীন্দ্রনাথ সসীমের মাঝে অসীমকে খুঁজে পান নানা ব্যঞ্জনায়। কোলরিজ সত্য জগতের আবরণে অতিপ্রাকৃত সত্তার উপস্থিতিতে রোমাঞ্চিত। জন কিটস পাঁচ ইন্দ্রীয় ছাড়া আর অন্যকিছু দিয়ে এই পৃথিবীর অপার সৌন্দর্য আস্বাদন করতে চান না। রবার্ট লি ফ্রস্ট প্রকৃতির সরলতার মাঝেই সৃষ্টির সুগভীর রহস্য উন্মোচিত হতে দেখেন; আপাত দৃষ্টিতে তার বোধগম্য কবিতাগুলো উপমায়, চিত্রময়তায়, প্রতীকী ব্যঞ্জনায়, ছন্দ আর শব্দের খেলায় নিরাভরণের অন্তরেই ছদ্মবেশে অন্তর্নিহিত, গূঢ় কিছু বলতে চায় যার ব্যাপ্তি নিকট থেকে সুদূরে। কবি দৃষ্টিগ্রাহ্য এই জগতকেই দেখেন কিন্তু তার নব্য প্রকৃতি চেতনা সীমার মাঝে থেকেও সীমানা পেরিয়ে খুঁজে ফিরে আরেক চেতনা লোকের স্পর্শ। রবীন্দ্রনাথ যেমন চোখের অলোয় চোখের বাহিরে দেখেন তৃতীয় নয়নে। ‘স্টপিং বাই উডস অন অ স্নোয়ি ইভনিং’ কবিতাটি রবার্ট ফ্রস্টের একটি অসাধারণ শিল্প সৃষ্টি। কবিতাটি শুধুমাত্র এটির শেষ চার লাইনের বিখ্যাত বাণীর জন্য স্মরণীয় হয়ে আছে তা নয়; এটির অন্তর্নিহিত বিশেষ তাৎপর্য কবিতাটিকে আরও গুরুত্ববাহী করে তোলে। এটির ‘New Hampshire’ (১৯২৩) কাব্যগ্রন্থে সন্নিবেশ ঘটে যার জন্য ফ্রস্ট পুলিৎজার পুরস্কার অর্জন করেন। কবিতাটি ছোট কিন্তু জটিল ও ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ। এটির স্তরেস্তরে বিন্যস্ত গভীর দার্শনিক চিন্তা। কবিতাটিতে ছোট একটি বিষয় জীবনের বড় প্রশ্ন নিয়ে কবিকে আচ্ছন্ন করে; জীবন নিয়ে, সৃষ্টি নিয়ে, সৃষ্টি জগত নিয়ে ; এমনকি পুরো মানব জাতির অস্তিত্বের সামনে দাঁড়িয়ে যায় কবির ধ্যানমগ্ন চিত্ত। কবিতাটির কাহিনী খুব ছোট; বলতে গেলে তেমন কিছুই না। চরিত্র বলতে কবি নিজে, তার অনুগত ঘোড়াটি, একটি অজানা বনভূমি আর শীতল শীতের সন্ধ্যায় বরফখন্ড কে আরও হিম করে দেয়া বাতাসে উড়তে থাকা তুষারপাত। আপাত সরল কবিতাটি প্রতীক, উপমা আর অজ্ঞেয় প্রশ্নে ভরপুর। সবচেয়ে বেশি করে কি মৃত্যু চিন্তা কবিকে জাপটে ধরে? ‘Stopping by Woods on a Snowy Evening’ কবিতায় শীতলতা, আধার, সাদা বরফ এগুলো সব কবির সতেজ চিন্তাধারাকে যেন ব্যাধিগ্রস্ত করে দেয়। কবিতাটিতে কবিকে যেমন বিভ্রান্তিকর এক সময়হীন সন্ধ্যায় স্থির অস্বস্তিতে দেখা যায় তেমনি পাঠকও যুগযুগ ধরে এই কবিতা নিয়ে বিভ্রান্ত। অনির্বচনীয় বোধ, পরিবেশ আর পরিস্থিতি কবির বিক্ষিপ্ত, অস্থির মনোভাব, ক্ষণিকের এক চিলতে কিন্তু নিগূঢ়, অভিভূত ভাবনা সন্ধ্যার আঁধারের মতোই পাঠককে চিরায়ত এক ধাঁধার মাঝেই রাখে। নিউ ইংল্যান্ডের প্রকৃতি আর গ্রাম্য জীবন ফ্রস্টের কবিতায় এসেছে ধারাবাহিকভাবে। বস্তুর মাঝে ব্যক্তিত্ব আরোপ, নিশ্চল বস্তুকে নিগূঢ় করে তার মাঝে সচল জীবনের অনুসন্ধান তার কবিতাকে বিশিষ্ট করে তুলেছে। কবি এখানে পুরো বিশ্বের প্রতিনিধি হয়ে এক হিম শীতল রাতে বরফাচ্ছাদিত একটি লেকের ধারে আঁধারে ঢাকা বনরাজির সামনে বিমোহিত হয়ে থমকে দাঁড়ান। কোন এক অজানা শক্তি কবিকে তার চলমান ঘোড়া থেকে রহস্যঘন পৃথিবীর এক দুর্ভেদ্যপ্রান্তে কোন এক অজ্ঞাত জিজ্ঞাসার সামনে এনে দাঁড় করায়। যেমনভাবে ‘A Passage to India’ উপন্যাসে ইএম ফস্টার মারাবার পাহাড়ের অদ্ভুত প্রতিশব্দে অস্ততিতে পড়ে যান কিংবা বিভূতিভূষণ আরণ্যক উপন্যাসে লবটুলিয়া, বিহারের গহীন অরণ্যের যাদুকরী মোহে আটকে যান। কিন্তু ফ্রস্ট ভীষণ রকমের প্রকৃতিপ্রেমী তাই বরফ জমাট হ্রদ বা নিকষ কালো জঙ্গল তার ধ্যানী চেতনায় সুন্দরের প্রতিরূপ হয়ে ধরা পড়ে। কিন্তু কবিতাটি শুরু হয় উত্তরহীন প্রশ্ন দিয়ে। কবির দ্বিধাবিভক্ত মন নিজেকেই জিজ্ঞাসা করে ‘কার এই বন আমি কি জানি/হয়ত খুব কাছে তার গৃহ খানি।’ কবি জানেন তার এই শীতলতম রাতে এখানে থেমে কোন কারণ ছাড়াই এই বনের আর বরফাচ্ছাদিত লেকের অনাকাক্সিক্ষত পরিবেশে তাকে কেউ দেখবে না কারণ তার এই অবান্তর নির্জন প্রকৃতি দর্শন কারও কাছেই স্বাভাবিক বিষয় নয়। আশপাশে কোন বাড়ি নেই শুধু প্রকৃতি যেখানে মুখ্য সেখানে এই অদ্ভুত রাতে কারও থেমে যাওয়া অনেক বেশি অস্বাভাবিক। তার ঘোড়াটিও কবির বেখেয়ালি আচরণে সেটির গলার ঘুণ্টিটি বাজিয়ে জানতে চায় তার সওয়ার কোন ভুল করল কিনা। মাথা নেড়ে ঘোড়া কবির কাছে জানতে চায় চিহ্নহীন, আশ্রয়হীন এই নির্জনতায় কবির কাজ কী? অবোধগম্যতা ফ্রস্টের কবিতার একটি দিক; প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদান কবির কবিতায় এসেছে প্রতীক হয়ে। এই কবিতাটির অন্তর্নিহিত তাৎপর্যপূর্ণ অভিব্যক্তির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার তরী’ কবিতার অনেকখানি মিল খুঁজে পাওয়া যায়। সূক্ষ্মদর্শী প্রকৃতিপ্রেমী দুই কবিই চলমান বা নিশ্চল নিসর্গের সঙ্গে মানব জীবনের প্রতিফলিত দেখেন। রবীন্দ্রনাথ সোনার তরী কবিতায় যেমন মেঘাচ্ছন্ন আঁধারঘন এক সময়ে মসি মাখা অজানা গ্রাম তীরে অজানা এক তরীকে অদ্ভুত বেগে আর অদ্ভুত বেশে দেখতে পান তেমনি ফ্রস্টও খুব বিচলিতভাবে আঁধারঘন এক ছমছমে অবস্থায় প্রশ্নাকারে দাঁড়িয়ে থাকা প্রকৃতির সামনে নিজেকে শুধু দেখেন না; মানুষ, প্রকৃতি, সৃষ্টি আর অস্তিত্বের এক বড় সঙ্কটে আটকে যান। রবীন্দ্রনাথ তার বিখ্যাত মরমী কবিতায় একা কূলে বসে তবু প্রকৃতির দুর্ভেদ্যতা ফেঁড়ে যে এক অপচ্ছায়া আসে তাকে কিছুটা যেন চিনেন- রবীন্দ্রনাথ তাই বলেন ‘গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে/দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।’ কিন্তু ফ্রস্ট আঁধার, বনানী, সাদা, শীতল বরফখন্ডের মাঝে শুধু অজ্ঞতাই খুঁজে পান। এ যেন মহাত্মাদের এক কালে বসে থেকে মহাকালের সন্ধান চেষ্টা, আঁধারের ভেতর দিয়ে উৎসারিত আলোর সন্ধান চেষ্টা। ফ্রস্ট, রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতিতে যেমন মানব জীবনের প্রতিচ্ছবি দেখেছেন; জটিল জীবনের থেকে সহজ- সরল প্রকৃতিতে আশ্রয় খুঁজেছেন তেমনি আবার তাদের মনস্তত্ত্বের জটিল দিকটিও অব্যাখ্যায়িত। রবার্ট ফ্রস্ট ছিলেন একজন ডুয়ালিস্ট বা দ্বৈতবাদী, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একজন সর্বশ্বেরবাদী বা ভাববাদী। কিন্তুপ্রকৃতি নিয়ে তাদের ভাবনা অনেক জায়গাতেই মিলে যায় ফ্রস্ট তার কবিতা ‘বার্চেস’ কবিতায় একটি গাছে শিশুদের খেলা দেখে কল্পনার সীমাহীন রাজ্যে তলিয়ে যান। তার নিজের শৈশবের কথা মনে পড়ে যায়। বার্চ গাছ আর গাছ থাকে না স্বর্গে আরোহনের সিঁড়ি হয়ে যায়। প্রকৃতি জীবনের উপমা হয়ে আসে। গাছে আরোহন কল্পলোকে পাড়ি দেবার স্বপ্ন হয়। ইন্দ্রীয় জগত থেকে অতিন্দ্রীয় জগতে যাবার হাতছানি হয় বার্চ গাছ। গাছের শাখায় উঠে শিশুরা দোল খায় কখনও উপরে উঠে কখনো নিচে নামে; এ যেন কবির কাছে মর্ত্যরে বেদনা ছেড়ে কল্পলোকে উড্ডয়ন করবার হাতছানি। কবি কবিতায় বলেন ‘আমি যখন ভাবনার জগতে নিঃষেশিত / জীবন যখন পথ হারা বনের চেয়েও ভীষণ/যেখানে জ্বলন্ত মুখে মাকড়সার জাল পেঁচিয়ে ধরে’ তখন কবি কল্পনায় চলে যান বার্চ গাছের দোলায়; সেটা যেন তাকে জীবনের দোলার কথা মনে করিয়ে দেয়। বার্চ গাছের উত্থানপতন কবিকে কল্পনা আর বাস্তব, সত্য ও মিথ্যা, বস্তু জগত ও ভাবনা, পৃথিবী ও স্বর্গের মাঝে দোদুল্যমান অবস্থার কথা মনে করিয়ে দেয়। ‘Earths the right place for love, face burns’ ও ‘one eye is weeping.’ শব্দগুচ্ছ কবি মনের অনিশ্চয়তাকে আরো বেদনাঘন করে দেয়। ‘বার্চেস’ কবিতাটির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ‘তাল গাছ’ কবিতার যদিও মিল খুঁজতে যাওয়া পুরোপুরি ঠিক হবে না তবুও রবীন্দ্রনাথও একটা স্বপ্নের হাতছানি রেখে যান। এই সুধাহীন জগত ভেদ করে, আকাশ ফুঁড়ে আরেক জগতে যাবার সাধ রবীন্দ্রনাথেরও জাগে রবীন্দ্রনাথের স্বপ্নচারীতা তাল গাছ হয়ে অনন্তে যেতে চায়- ‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে সব গাছ ছাড়িয়ে উঁকি মারে আকাশে। মনে সাধ, কালো মেঘ ফুঁড়ে যায়, একেবারে উড়ে যায়।’ বার্চ গাছের মতো তালগাছের পাতার মর্মরে রবীন্দ্রনাথ খুঁজেন বস্তুলোক উত্তীর্ণ হয়ে অলোকের পথে যাবার রাস্তা। আকাশের তারা এড়িয়ে আরেক লোকে যাবার বাসনা ফ্রস্টের স্বর্গারোহণের কথা মনে করিয়ে দেয়- ‘সারাদিন ঝরঝর থত্থর কাঁপে পাতা পত্তর ওড়ে যেন ভাবে ও, মনে মনে আকাশেতে বেড়িয়ে তারাদের এড়িয়ে যেন কোথা যাবে ও।’ অন্যদিকে মৃত্যু চিন্তা ফিরে আসে ফ্রস্টের After Apple-Picking (আফটার অ্যাপল পিকিং) কবিতাটিতে। ঘুম (sleep) শব্দটি কবি সাতবার ব্যবহার করেন যা ঘুম বা মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়; কবিতাটির নামেই বোঝা যায় মানুষের সেই আদি পাপের স্মরণ আর স্বর্গ থেকে মানবের মহা-পতন। আদম আর হাওয়ার আপেল পাপের অপরিণামদর্শিতা আর স্বর্গ হতে মানব জাতির পৃথিবীতে নির্বাসন After Apple-Picking কবিতাটিতে যেমন আছে তেমনি অনেক প্রতীক আর উপমার ব্যবহার যেমন মই, শূন্য পাত্র, অসমাপ্ত কাজ (আপেল আহরণ) দিয়ে কবি মানব জীবনের ভঙ্গুরতার অনেক দিক দেখিয়ে দেন। মই স্বর্গ আরোহনের ইচ্ছা, আকাক্সক্ষার প্রতিফলন, যেখান থেকে সে নির্বাসিত। অপূর্ণ আপেল পাত্র মানুষের কাজের অপূর্ণতাপ্রকাশ করে, মানুষের ক্লান্তির ছাপ হয়ে থাকে। কবি মানব জাতির ভ্রষ্ট পথ যাত্রা যেমন দেখিয়েছেন তেমনি তিনি স্বর্গ আর পৃথবীর মধ্যে পার্থক্য তুলে এনেছেন; স্বর্গ ছিল আদম আর ইভের জন্য সব পাওয়ার কিন্তু পৃথিবীতে সব পেতে হলে যেমন কাজ করতে হয় তেমনি মৃত্যু চিন্তা তাড়িয়ে বেড়ায় সবসময়। কবি সারাদিনের কাজের শেষে ক্লান্ত ; রাত্রি আসন্ন অবসন্ন কবি যেন অবসন্ন মানব জাতিরপ্রতীক হয়ে যান আর পৃথিবী যা স্বর্গের এক ছায়া মাত্র কবি সেই পৃথিবীকে দেখেন সাধারণ চোখে নয় এক খন্ড কাচের ভেতর দিয়ে যা পৃথিবীর বিকৃত আর অস্পষ্ট রূপই প্রকাশ করে কিছুটা ‘স্টপিং বাই উডস অন আ স্নোয়ি ইভনিং’ এর আঁধারের মতোই । ‘winter sleep, pane of glass, my dreaming, cellar bin, rumbling sound, cider-apple heap, woodchuck, human sleep. hoary glass’ ইত্যাদি শব্দগুচ্ছ পরাবাস্তব আর অস্পষ্ট এক পৃথবীর চিত্র আঁকে। ফ্রস্ট জানলার কাচ দিয়ে বিকৃত আর সাদা বিবর্ণ ঘাস (hoary grass) দেখেন। যেটি সতেজ কোন জগতের চিত্র আঁকে না জীবনের বিবর্ণতাকেই স্পষ্ট করে। ‘After Apple-Picking’ কবিতাটি মৃত্যু চিন্তা, ধর্মীয় অনুভূতি, অনুতাপ, মৃত্যুর পরের জীবন, ধর্মীয় মূল্যবোধ যেমন ইঙ্গিত করে তেমনি জাগতিক অস্তিত্বের প্রতিও কবির দায়বদ্ধতা থেকে যায়। যা কবির একটি লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। ‘মেনডিং ওয়াল’ (Mending Wall) কবিতাতে কবি মানুষকে প্রকৃতি বিরুদ্ধ হিসেবে দেখিয়েছেন। কবি স্পষ্ট করে বলেন বিশ্বপ্রকৃতি কোন বাধা পছন্দ করে না। কিন্তু মানুষ নিজেই নিজেদের থেকে দূরত্ব তৈরি করে নেয়। কবি দুই প্রতিবেশীর মধ্যে দেয়াল দেয়ার বিরুদ্ধে কিন্তু কবি এও জানেন যে দেয়াল না দিলেও মানুষের মাঝে যে দেয়াল তা ভাঙ্গা যাবে না। মানুষ প্রবৃত্তিগতভাবেই একে অপরের বিরুদ্ধে। তাই কবি বাহিরের দেয়ালের কথা যেমন বলেন তেমনি ভেতরের দেয়ালের কথাও বলেন। মানুষ দেয়াল দিয়ে নিজেকে পৃথক করে রাখলেও গাছ তার শাখা মেলে দেয়াল টপকে ঠিকি প্রতিবেশীর সীমানায় চলে যায়। কিন্তু রোমান্টিক কবিদের মতো ফ্রস্ট প্রকৃতিকে আশ্রয়, সান্ত¡না, জীবনের সত্যতার স্বরূপ, আত্ম- আবিষ্কারের হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ বা মানব সত্তার পরিপূরক হিসেবে নেননি। তার কাছে প্রকৃতি অজ্ঞেয় আর ভিন্ন সত্তা ধারী। তাই কবি, তার কবিতায় প্রকৃতির সামনে বিভ্রান্তি, অস্থিরতা আর অজ্ঞতা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন প্রায় ক্ষেত্রে। কবির এই অস্থিরতা অনেক কবিতায় প্রতীয়মান। ‘West-Running Brook, Fire and Ice Road not Taken’ ও ‘ট্রি এট মাই উইনডো’ কবিতাতে কবি প্রকৃতি আর মানবের বৈপরীত্য থেকে মানব মনের দ্বৈতসত্তার টানাপোড়েন নিয়ে মগ্ন; ‘Tree at my Window কবিতার গাছ আর মানব মনের মাঝে যে পর্দা তা আরো বেশি করে ‘Road not Taken’ কবিতায় মানব মনের দৈবচয়নের বিচলতার মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেন। ফ্রস্ট আমেরিকার আধুনিক ভাবধারার অগ্রগণ্য চিন্তাবিদ তিনি ভাগ্যের চেয়ে মানুষের জীবনের পছন্দ আর তার ফলাফলের ওপর বেশি বিশ্বাসী ছিলেন। তাই কবি জীবনকে পুরো ভাগ্যের হাতে সঁপে না দিয়ে; চলার পথে বাধা, প্রতিকূলতা, রুক্ষতা, বিরুদ্ধ শক্তির বিরুদ্ধে টিকে থাকার প্রত্যয় আর ঋজুতার ওপর বেশি জোর দিয়েছেন। আধুনিক জীবনের হতাশা, বিভ্রান্তী, প্রশ্ন, বিলাপ, দুর্দশা, একাকীত্ব, নৈরাশ্য কবির মন আলোড়িত করেছিল। মানব মনের সেই অমানিশা কবি যেন অজ্ঞেয় প্রকৃতিতে খুঁজে পান। মানবাত্মার এই জগতে টিকে থাকার যুদ্ধ, মিথ্যার অমিতচারীতা, স্বপ্ন ভঙ্গ কবিকে নিরাশ করে, হতাশ করে, মানসিকভাবে তার ভেতরটা ভেঙ্গে দেয় তাই বিশ্ব প্রকৃতি কখনও তার কাছে বন্ধু আবার কখনো প্রতিকূলতার নামান্তর হয়। কিন্তু কবি হাল ছেড়ে দেন না। রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেন ‘পথ আমারে সেই দেখাবে যে আমারে চায়/আমি অভয় মনে ছাড়বো তরী এই শুধু মোর দায়।’ ফ্রস্টও জীবানাবশানের আগে সব আশা আর জীবনেরপ্রতি দায়বদ্ধতা ত্যাগ করেন না। ‘ডিজাইন’ (Design) কবিতাটি একটি সনেট। একটি সাদা ফুলে বাসা বাধা একটি মথকে সাদা একটি মাকড়সা কিভাবে গিলে ফেলে তার অমঙ্গলকর চিত্র পাওয়া যায়। কবিতায় dead, death, snow, darkness, night শব্দগুলোর ব্যবহার একটি গোথিক বিষাদময়, আঁধারের আবহ তৈরি করে। কবি ফুলের মাঝে লুকিয়ে থাকা মথও যে প্রকৃতির রুদ্র রূপ থেকে নিরাপদ নয় তা দেখান। ফুলের বুকে একটি মথও যেমন নিরাপদ নয় তেমনি মানবতাও সবখানেই যে অরক্ষিত পরোক্ষভাবে তাইব কবিপ্রকাশ করেন । কবিতাটিতে সুন্দরের পাশে ভয়ালকে স্থাপন করে কবি অনিরাপদ অস্তিত্বের প্রতি তার বিচলিত ভাবপ্রকাশ করেন। কবি প্রশ্ন করেন অমঙ্গলও কি তবে সৃষ্টির রহস্যের একটি উদ্দ্যেশ্য? ‘What but design of darkness to appall? If design govern in a thing so small..’ ‘আ মাইনর বার্ড’ (A Minor Bird) কবিতায় ফ্রস্টের মানুষ যেপ্রকৃতি বিরুদ্ধ আচরণ করছে তার উপলব্ধি আছে; কবিতাটিতে পরিবেশবাদী ভাবনার উন্মেষ আছে। কবি small, little বা tiny শব্দগুলো ব্যবহার না করে Minor শব্দটি ব্যবহার করে ইঙ্গিত করেছেন প্রকৃতি মানুষের কাছে নগন্য বা তুচ্ছ। কবি প্রথমে বিরক্ত হয়ে একটি পাখির গান বন্ধ করতে হাততালি দেন কিন্তু পরক্ষণেই উপলব্ধি করেন এই পৃথিবীতে মানুষের যেমন অধিকার আছে ছোট্ট একটি পাখিরও সমান অধিকার আছে প্রকৃতিকে ভোগ করার- ‘And of course there must be something wrong In wanting to silence any song.’ ‘ফায়ার এন্ড আইস’ (Fire and Ice) কবিতায় প্রকৃতির দুটো বস্তু ‘আগুন’ ও ‘বরফ’ দিয়ে ফ্রস্ট বলেন মানুষই একদিন তার ধ্বংসের কারণ হবে। কবি মানুষের তীব্র আকাক্সক্ষাকে fire হিসেবে আর ঘৃণাকে ওপব হিসেবে তুলনা করেন। মানব দৈহিক এই ক্রিয়া দুটো (‘আগুন’- হিংসা ও ‘বরফ’- ঘৃণা) একদিন মানুষের বিলুপ্তি ডেকে আনবে বলে কবি বিশ্বাস করেন। ধারণাটি কবি যে আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে কবিতাকে সংযুক্ত করছেন আবার তার প্রমাণ মিলে। আকাক্সক্ষা লোভ আর হিংসা হয়ে মানুষের সর্বগ্রাসী ক্ষুধা প্রকাশ করে। গ্যাস, তেল, প্রাকৃতিক শক্তি আর পদার্থ যুগে যুগে মানুষে মানুষে চিরস্থায়ী দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেছে আর ঘৃণা জাতি, ধর্ম, বর্ণের বা মানুষের ব্যক্তিক ঘৃণা মানুষে মানুষে বিভাজন করে মানুষের ধবংস ডেকে আনছে। প্রকৃতির দুই আদিম শক্তি আগুন ও বরফ হাজার হাজার বছর ধরে তাদের হিংস্রতা চাপা রেখেছে কিন্তু মানুষ প্রতিনিয়ত তার লোভ আর ঘৃণা উগড়ে দিয়ে পৃথিবীতে দ্বন্দ্বের বিষবাষ্প ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে। আবার Fire ও ওপব একই সত্তার দ্বিবিধ বৈশিষ্ট্য; অভিন্নপ্রকৃতির ভিন্নতর বিচিত্রপ্রকাশ। ‘স্টপিং বাই উডস অন আ স্নোয়ি ইভনিং’ কবিতার শুরুতে যে নিরাশার অতল কবি দেখেন পরিশেষে এসে তার থেকে বের হয়ে আসেন টমাস ডিলান যেন ফ্রস্টকে দেখে শিখেন ‘মৃত্যু অনিবার্য কিন্তু জীবন অনেক শক্তিশালী’। জীবনের সেই মহা মূল্যবান দায়িত্ব নিতে ফ্রস্ট এক চুলও নড়েন না; তাই তার দৃঢ়প্রতিজ্ঞা ‘এই বনরাজি মোহনীও, গভীর আঁধারময়/কিন্তু মরার আগে প্রতিশ্রুতি রেখে যেতে হয়।’ জীবন নশ্বর, ভঙ্গুর, কণ্টকিত হতে পারে কিন্তু বাঁচবার প্রতি দুর্নিবার ইচ্ছা, জীবনেরপ্রতি শক্ত আকুতি জীবনকে করে তোলে ভীষণভাবে অর্থপূর্ণ; তাই কবি ‘স্টপিং বাই উডস অন আ স্নোয়ি ইভনিং’ কবিতায় এসে and miles to go before ও sleep দুইবার উচ্চারণ করে জীবনেরপ্রতি কবিরপ্রতিজ্ঞা, দায়বদ্ধতাকে আরো জোরালো করে তোলেন। ফ্রস্ট পুরোপুরি অদৃষ্টবাদী বা নিয়তিবাদী নন। তার বিশ্বাস যা ঘটছে তা পরোপুরি ভালর জন্য বা পুরোপুরি মন্দের জন্য ঘটছে। ঘটে যাওয়া বয়ে চলা পৃথিবীর স্বাভাবিক নিয়ম। পৃথিবীতে মৃত্যু অনিবার্য আর মানুষকে সবসময় বিরুদ্ধ শক্তির মুখোমুখি হতে হয়। মন্দ ছদ্মবেশে সুন্দরের আড়ালেই থাকে ওৎপেতে। তাই জীবনের অমানিশার প্রতি মানুষকে সব সময় সজাগ থাকতে হয়। এক বিরুদ্ধ শক্তির সাথে যুদ্ধ করে, লুকিয়ে থাকা মাকড়সার মতো শত্রুর জন্য সব সময় প্রস্তুত থাকতে হয়। উত্তরহীন প্রশ্ন, অস্পষ্ট পর্দা আর শক্ত দেয়ালের এড়িয়ে এগিয়ে যেতে হয়। প্রকৃতির ফুল যেমন ভালবেসে একটি মথকে বুকে আশ্রয় দেয় আবার ভক্ষক মাকড়সা সেই মথকে গিলে খায়। তাই প্রকৃতি সুন্দর আবার ভয়াল কিন্তু অনেক কবিতার মতো ‘স্টপিং বাই উডস অন আ স্নোয়ি ইভনিং’ কবিতায় ফ্রস্ট অজ্ঞতায় আত্ম-বিশ্বাস হারান না তিনি জীবনের জন্য আরো দৃঢ় প্রতিজ্ঞ কারণ তার দৃষ্টি সীমানা পেরিয়ে যায় তিনি তাই ‘গোয়িং ফর ওয়াটার’ কবিতায় সুদূরের প্রতি তার বাসনা রেখে যান। ‘আমরা ছুটে যাই যেন চাঁদকে ছুঁতে/গাছের আড়ালে ধীরেধীরে উদিত যা/শুকিয়ে যাওয়া পাতাহীন গাছ/পাখিহীন প্রান্তর নিস্তব্ধ বাতাস।’
×