ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভোট প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা ॥ লক্ষ্য মধ্যবর্তী নির্বাচন

নির্বাচনে ভরাডুবি হলেও ষড়যন্ত্র থেমে নেই ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের

প্রকাশিত: ০৬:০৫, ১০ জানুয়ারি ২০১৯

নির্বাচনে ভরাডুবি হলেও ষড়যন্ত্র থেমে নেই ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের

রাজন ভট্টাচার্য ॥ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভরাডুবির পরও সরকারবিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত বিএনপি-গণফোরামের নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক মোর্চা জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপির সঙ্গে কামাল হোসেন রাজনৈতিক সখ্য তৈরি করলেও নির্বাচনের পরও উভয়পক্ষ তা অটুট রাখতে অনড়। তাদের মূল লক্ষ্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মহাজোট সরকারের বিরুদ্ধে জনমত তৈরির পাশাপাশি নির্বাচনের আইনগত বৈধতা প্রশ্নে আদালতে বিচার চাওয়া। নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করার পাশাপাশি বিভিন্ন কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে সরকারকে বিব্রত অবস্থায় রাখা। অথচ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে হেভিওয়েটের প্রায় সব নেতাই নির্বাচনে হেরেছেন। নেতাদের জনসমর্থন না থাকলেও মনোবল কমেনি। থামেনি ষড়যন্ত্রের চিন্তাও। এই প্রেক্ষাপটে বিশিষ্টজরা বলছেন, সরকারের প্রতিপক্ষ হিসেবে এখনও মাঠে তৎপর বিএনপি-জামায়াত জোট। তাদের সঙ্গে নতুন মিত্র হিসেবে যুক্ত হয়েছে কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারাও। যারা সব সময় সরকারের বিরুদ্ধে গণমাধ্যমে নানা কথাবার্তা বলে আসছেন। তাই সরকারকে সতর্ক থেকে পথ চলার পরামর্শ দিয়ে তারা বলেছেন, নতুন সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি চলমান উন্নয়ন কর্মকা- অব্যাহত রাখা। সেইসঙ্গে সরকারের বিরুদ্ধে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র প্রতিহত করা ও আন্তর্জাতিক বিশে^ সম্পর্ক উন্নয়ন। নির্বাচনের আগে তরুণ প্রজন্মের উদ্দেশে ভোট বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন সাবেক আওয়ামী লীগের নেতা ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ কামাল হোসেন। ফ্রন্টের নেতা আসম আব্দুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্না, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর, কাদের সিদ্দকীসহ অনেকেই ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাদের কথায় পরিষ্কার ছিল ক্ষমতায় আসা সময়ের বিষয় মাত্র। কিন্তু ভোটের হিসাব নিকাশ গণেশ উল্টে দিয়েছে। ভরাডুবি হয়েছে বিএনপি তথা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের। ৩০০ আসনের মধ্যে মাত্র ৭টি আসন পায় তারা। যে কটি নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয় এরমধ্যে সবচেয়ে কম আসনে জয় পায় এবারই। আর কামাল হোসেন আওয়ামী লীগ ছাড়ার পর থেকে কখনই তিনি কিংবা তার দলের পক্ষ থেকে কেউ এমপি হতে পারেননি। বিএনপিকে ভোটাররা না চাওয়ায় নানা অভিযোগ তুলে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। এখানেই শেষ নয়। তাদের দুজন নির্বাচিত সাংসদের শপথ নিয়েও কয়েক দফা নাটক হয়েছে। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হল তারা শপথ নিচ্ছেন না। গত রবিবার ড. কামাল হোসেন বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করে নির্বাচনে বিভিন্ন চিত্রের প্রমাণ তুলে ধরেন। বৈঠক শেষে কামাল হোসেন বলেন, আমাদের উত্থাপিত অনিয়ম দুর্নীতির চিত্র কূটনীতিকরাও বিশ^াস করেছেন। তারাও আমাদের অভিযোগের সঙ্গে একমত। আমাদের বক্তব্য হলো, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সর্বজন গ্রহণযোগ্য, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়নি। নির্বাচনে পুলিশ, প্রশাসনকে ব্যবহার করে বিজয় ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। আমাদের দাবি দ্রুত সময়ের মধ্যে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের। এই দাবিতে আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচী ঘোষণা করা হবে। তবে তথ্যচিত্র দেখে কোন কূটনীতিক আনুষ্ঠানিক মন্তব্য জানাননি। একই দিন একটি প্রভাবশালী দেশের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তবে বৈঠকে কি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে তা জানা যায়নি। এই বৈঠকে ফখরুল একাই ছিলেন। বিএনপি কিংবা ফ্রন্টের কোন নেতাকেই সেখানে নেয়া হয়নি। অথচ ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের দিন সকালে সার্বিক পরিস্থিতি সন্তোষজনক বলেছিলেন কামাল হোসেন। সেইসঙ্গে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নির্বাচনে টিকে থাকারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বিকেল থেকেই কামাল হোসেনের মুখে বিএনপি-জামায়াতের সুর। সন্ধ্যায় নানা অভিযোগ এনে নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেন তিনি। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীদের ১৯ আসনে ছাড় দেয় বিএনপি। এরমধ্যে মাত্র দুটি আসন পায় গণফোরামের নেতারা। বাকি পাঁচ আসনে জয় পায় বিএনপির নেতারা। তবে বয়সের কারণে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ও গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন নির্বাচনে অংশ নেননি। এর মধ্যে দলটির সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টু ঢাকা-৭ আসনে ও নির্বাহী সভাপতি সুব্রত চৌধুরী ঢাকা-৬ আসনের মনোনয়ন পেলেও বিজয়ী হতে পারেননি। এছাড়া মৌলভীবাজার-২ আসনে সুলতান মোহাম্মদ মনসুর, হবিগঞ্জ-১ আসনে রেজা কিবরিয়া, কুড়িগ্রাম-২ আসনে আমসা আমিন, পাবনা-১ আসনে আবু সাইয়িদ, ময়মনসিংহ-৮ আসনে খালেকুজ্জামান ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে ঐক্যফ্রন্টের হয়ে নির্বাচনে অংশ নেন। মৌলভীবাজার-২ আসনে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে ৮৯ হাজার ৭৪২ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট মনোনীত প্রার্থী সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ। সিলেট-২ আসনে গণফোরামের নিজস্ব প্রতীক ‘উদীয়মান সূর্য’ নিয়ে জয়ী হয়েছেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট মনোনীত গণফোরামের প্রার্থী মোকাব্বির খান। তিন আসনে কাদের সিদ্দিকীর দল ॥ ঋণখেলাপী হওয়ায় নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেননি কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি আবদুল কাদের সিদ্দিকী। আসন ভাগাভাগিতে তিনটি আসনে চূড়ান্ত মনোনয়ন পায় তার দল। এর মধ্যে টাঙ্গাইল-৪ আসনে লিয়াকত আলী, টাঙ্গাইল-৮ আসনে কাদের সিদ্দিকীর মেয়ে কুঁড়ি সিদ্দিকী ও গাজীপুর-৩ আসনে ইকবাল সিদ্দিকীর মধ্যে একটি আসনেও কেউ বিজয়ী হতে পারেননি। চার আসনে জেএসডি ॥ নির্বাচনে ৪ আসনে জোটের চূড়ান্ত মনোনয়ন পেয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) নেতারা অংশ নিলেও দলটির সভাপতি আসম আবদুর রবসহ কেউই বিজয়ী হতে পারেননি। এরমধ্যে কুমিল্লা-৪ আসনে দলের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন, ঢাকা-১৮ আসনে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শহীদউদ্দিন মাহমুদ স্বপন, কিশোরগঞ্জ-৩ আসনে সাইফুল ইসলাম। প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্যের পক্ষ থেকে পাঁচ আসন পেয়ে নির্বাচনে অংশ নিলেও একটিতেও কেউ বিজয়ী হতে পারেননি। নির্বাচন শেষে এবার ফ্রন্টের নতুন মিশন। সরকারবিরোধী এই মিশনের মূল লক্ষ্য মধ্যবর্তী নির্বাচন আদায় করা। এজন্য মঙ্গলবার বৈঠক করেছেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা। নির্বাচন পরবর্তী আন্দোলনের কর্মসূচী নির্ধারণে এই বৈঠক আহ্বান করা হয়। ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীদের নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে মামলা করার বিষয়টি নিয়েও আলোচনা হয়েছে বৈঠকে। সংবিধান অনুসারে দশম জাতীয় সংসদ না ভেঙ্গে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নেয়া শপথের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে জাতীয় সংসদের স্পীকার, প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে আইনী নোটিস পাঠানো হয়েছে। মঙ্গলবার রেজিস্ট্রি ডাকযোগে সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী তাহেরুল ইসলাম তাওহীদের পক্ষে নোটিসটি পাঠান সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ও বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন। সরকারবিরোধী এসব ষড়যন্ত্র নিয়ে সজাগ দেশের বিশিষ্টজনরা। নির্বাচন পরবর্তী বিভিন্ন আলোচনায় তারা সরকারকে নানামুখী পরামর্শ দিয়েছেন। সম্প্রীতি বাংলাদেশ আয়োজিত গোলটেবিলে নাট্যজন পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘নির্বাচনের আগে দেশের বিভিন্ন স্থানে আমরা ঘুরেছি। আমরা চেয়েছিলাম মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী, মানবিক দর্শনের মানুষ এবারের নির্বাচনে জঙ্গিবাদী- সাম্প্রদায়িক শক্তিকে রুখে দেয়। আমরা এবারের নির্বাচনে তা পেয়েছি। এতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অসাম্প্রদায়িক শক্তির বিজয় হয়েছে। বিশ^বাসী জেনেছে আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অবিচল। সচেতন তরুণ সমাজ। তারা জেনে শুনে ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। প্রমাণ হয়েছে এখানে সাম্প্রদায়িক, উগ্রবাদী গোষ্ঠীর কোন ঠাঁই নেই। আলোচনায় অংশ নিয়ে মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মদ আলী শিকদার (অব) বলেন, এবারের নির্বাচনে সব চক্রান্ত, ষড়যন্ত্রকে পরাজিত করে এক এসিড টেস্টে উত্তীর্ণ হয়েছে বাংলাদেশ। যারা মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করে, তার বিরোধী রাজনীতি করে, তাদের সেই রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করেছে বাংলাদেশ। এবারের নির্বাচনের আগে বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই’এর সঙ্গে যোগসাজশের অভিযোগ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে বিএনপি যে প্রার্থী তালিকা দিয়েছিল, তা আইএসআই মনোনীত ও লন্ডন থেকে অনুমোদিত। ২৮৮টি আসনে বিশাল জয়ে ‘আত্মতৃপ্তির সুযোগ নেই’ জানিয়ে তিনি সতর্ক করে দেন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারকে। তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের পঁচাত্তরের কথা ভুলে গেলে চলবে না। দেশী-বিদেশী চক্রান্তকারীরা, ষড়যন্ত্রকারী যে কোন সময় আঘাত হানতে পারে। পঁচাত্তরের পর এরা বাংলাদেশে কলুষিত রাজনীতি শুরু করেছিল। আমাদের চ্যালেঞ্জ হল, এদের কবল থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করা।’ সাবেক রাষ্ট্রদূত এ কে এম আতিকুর রহমান বলেন, ‘দুর্নীতি হয়ত পুরোপুরিভাবে সমূলে উৎপাটন করা সম্ভব হবে না। তবে এটাকে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে হবে। না হলে সুশাসন নিশ্চিত করা যাবে না। সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ, মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনার পাশাপাশি নতুন সরকারকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে হবে।
×