ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রেজা সেলিম

সামনে আমাদের মানবিক বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৬:৪৬, ৬ জানুয়ারি ২০১৯

সামনে আমাদের মানবিক বাংলাদেশ

এ কথা সবাই স্বীকার করবেন ২০১৯ সাল থেকে নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ এক নতুন উন্নয়ন ইতিহাস নির্মাণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এসডিজি অর্জনের মাত্র এক দশক আগে আমাদের সামনে মানবিক বাংলাদেশ নির্মাণের জন্য একদিকে যেমন চ্যালেঞ্জ, অপরদিকে মুক্তিযুদ্ধের শক্তির চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনেরও এক সুবর্ণ সময় উপস্থিত হয়েছে। পদ্মা সেতুসহ সরকারের চলমান উন্নয়ন কার্যক্রমগুলোর অধিকাংশই আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে শেষ হবে। আর সবচেয়ে লক্ষণীয় আবেগ-উত্তেজনার মধ্যে উৎসবমুখর পরিবেশে বাংলাদেশের মানুষ ‘মুজিববর্ষ’ (২০২০ সালে) উদযাপন করবে বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মদিন ও মুক্তিযুদ্ধের পঞ্চাশ বছরের সুবর্ণ জয়ন্তী (২০২১ সালে)। তাহলে আমাদের সামনে সবচেয়ে অগ্রণী কাজগুলো কি এই নিয়ে এখন সরকারের নীতি নির্ধারকদের ভাবনা চিন্তার শেষ নেই। এই অগ্রণী নির্ধারণে আমরা কিছু সুপারিশ রাখতে চাই। আশা করি সদাশয় সরকার সেগুলো ভেবে দেখবে। ডিজিটাল বাংলাদেশের জন্য আমাদের যেসব লক্ষ্য সেসবের মধ্যে বেশ কিছু কাজ বাকি রয়ে গেছে। এর মধ্যে অন্যতম উচ্চগতির ইন্টারনেট। থ্রি ও ফোর-জি শহরের জন্য যতটা জরুরী গ্রামের জন্য নয়। আয়-রোজগারের জন্য গ্রামে যারা ইন্টারনেট ব্যবহার করেন তারা আলাদাভাবে শুধু মোবাইল ফোনের ইন্টারনেট ব্যবহার করেন না, বিশেষ করে তরুণ সমাজের জন্য আয়মুখী কাজের সুযোগ তৈরি করতে গ্রামাঞ্চলে সম্মিলিত ব্যবস্থায় ব্রডব্যান্ড বা উচ্চগতির ইন্টারনেট ব্যবস্থা সম্প্রসারণ হওয়া দরকার। আমরা জানি, সরকারের সদিচ্ছায় ইউনিয়ন পর্যায়ে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পৌঁছে দেয়ার প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে ও ইতোমধ্যে প্রায় ১০০০ ইউনিয়নে গ্রাহক পর্যায়ে লিজ লাইন দেয়ার ব্যবস্থাও প্রায় সম্পন্ন হয়েছে। এর প্রতি এমবিপিএস গতির মূল্য ধরা হয়েছে নানা পর্যায়ে ৩২৪ থেকে ৯৬০ টাকার মধ্যে। সরকারী-বেসরকারী খাতে যেভাবেই হোক এই ইন্টারনেট যদি নিরবচ্ছিন্ন গতিতে সমুন্নত রাখা যায় তাহলে নানারকম প্রশিক্ষণ ও জ্ঞানচর্চার ফলে গত এক দশকে গ্রামে গ্রামে আইটি খাতে নতুন ও উদ্ভাবনী কাজের যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে সে সবের একটি বাস্তব প্রতিফলন আমরা আগামী পাঁচ বছরেই দেখতে পাব। ডিজিটাল বাংলাদেশের আয়োজনে উদ্বুদ্ধ হয়ে কেমন করে গ্রামে কাজের সুযোগ হবে এই নিয়ে অনেকে বিতর্ক করেন ও কূল-কিনারা খুঁজে পান না। দায়ী করেন কম শিক্ষা, ইংরেজী না জানা ও স্মার্ট ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাকে। আমরা যদি সহজ করে ভেবে দেখি অন্তত দুই-একটি খাতে সীমাবদ্ধ না রেখে, যেমন শিক্ষা (যে খাতে ইন্টারনেট ও তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইতোমধ্যে অনেক কাজ হয়েছে), স্বাস্থ্য (সেবা উন্নয়নে ইতোমধ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে) ছাড়াও সব ক’টি উন্নয়ন খাতের পরিকল্পনার জন্য স্থানীয় পর্যায়ে আর যা-ই হোক প্রতিটি গ্রামে একটি করে তথ্যভা-ার গড়ে তোলা হলে তাহলেই সরকারের সব উন্নয়ন সূচক এক লহমায় হাতের মুঠোয় চলে আসবে। আর এই কাজে যুক্ত হতে পারে গ্রামের যুব সমাজ, যারা এসএসসি পাস করে মাস্টার্স পর্যন্ত পড়েছে, তারা সার্টিফিকেট পাক বা না পাক। বাংলাদেশ সরকারের পরিসংখ্যান বিভাগ এই কাজের উদ্যোগ নিতে পারে। একই সঙ্গে সারাদেশের জন্যও। প্রতি গ্রামের জন্য যদি গড়ে ৪ জন কর্মী (নারী-পুরুষ সমান অনুপাতে) নিয়োজিত করা হয় তাহলেও ৩ থেকে ৪ লাখ যুবশক্তির কর্মসংস্থান হবে। মনে রাখতে হবে বাংলাদেশ এখন এমন এক মানবিক ভাবাদর্শের আলোকে আলোকিত সেখানে আর ভুল পদক্ষেপের কোনই সুযোগ নেই। সমাজের সব মানুষকে তাই এখন কাজের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে সেই মানবিক বাংলাদেশ দর্শন বাস্তবায়নের জন্যই। পরিকল্পনা কমিশনের সর্বশেষ সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০১৬-২০২১) মতে মোট ২৪টি খাতের সূচকে উন্নয়ন ঘটলে আমাদের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৮% হিসেবে ধরে ঠিকভাবে এগুলে তাহলেই গড় অর্জন হবে ৭.৪%। তার জন্য যে ২৪টি উন্নয়ন সূচকের চিন্তা করা হয়েছে সেগুলো হলো- শিল্প, সেবা, কৃষিসহ দারিদ্র্যের হার, অতি দারিদ্র্যের হার, জনসংখ্যা, মূল্যস্ফীতি, জাতীয় সঞ্চয়, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, রফতানি, শিশু মৃত্যুর হার, বিদ্যুত উৎপাদন, বিদ্যুত সেবার আওতা বাড়ানো, বনাঞ্চল বৃদ্ধি, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা, দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষা, উচ্চশিক্ষা, নতুন রেলপথ নির্মাণ, প্রবাসী আয়, গবেষণা ও উন্নয়নে সরকারী ব্যয়, পদ্মা সেতু ও ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ, শহর ও গ্রামগুলোকে শতভাগ স্যানেটারি ল্যাট্রিনের আওতায় আনা, শিক্ষায় তথ্যপ্রযুক্তি বা আইসিটির ব্যবহার। বাংলাদেশ এখন যে যে উন্নয়ন পরিকল্পনা চিন্তা মাথায় রেখে এগুচ্ছে, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তার কারণে, তাঁর সব কর্মচিন্তার মূলে রয়েছে গ্রাম ও গ্রামের মানুষ। ফলে এখন সময় হয়েছে এই পরিণত উন্নয়ন সমাজের সব তথ্য হাতের কাছে রাখা। যার ফলে সম্ভব হবে যখন যেখানে যে কাজ করা দরকার তার পরিকল্পনা বাস্তবমুখী রাখা ও সমাজের সব প্রান্তের মানুষকে এসব লক্ষ্য অর্জনে সম্পৃক্ত করা। আর এতে সহায়ক হবে ভিত্তিমূলের সর্বমুখ উপাত্ত। প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সভাসদগণ যদি এই তথ্যভা-ার বিনির্মাণে বছরের শুরুতেই হাত দেন তাহলে অন্তত ৫টি যে যে ক্ষেত্রে বিপ্লব সংঘটিত হবে তার সংক্ষিপ্ত তালিকাটি এরকম হবে- ১. সব ক’টি গ্রামে গড়ে ৪ জন করে ‘স্মার্ট’ তথ্য সংগ্রাহক কর্মী তৈরি হবে, সারাদেশে যার সর্বমোট সংখ্যা হবে আনুমানিক ৩ থেকে ৪ লাখ। এরা সকলেই হবে ডিজিটাল বাংলাদেশের অগ্রণী কর্মী। সরকারের প্রথম বছরেই এই কর্মসংস্থান সম্ভব শুধু সব ক’টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রকল্পগুলো থেকে ‘কখন কার কি তথ্য প্রয়োজন হয় বা হবে’ সেরকম সম্মিলিত একটি পরিকল্পনা করে নিলে। এর জন্য আলাদা করে কোন অর্থ বরাদ্দের আপাতত দরকার হবে না। ২. সব ক’টি গ্রামে তথ্য সংগ্রাহক সব কর্মীর কাছেই ১টি করে মোবাইল ফোন বা স্মার্ট ট্যাবলেট থাকবে যাতে পূর্ব নির্ধারিত সফটওয়্যার দেয়া থাকবে। যার ফলে সম্ভব হবে নিয়মিত ‘চাহিবা মাত্র’ গ্রামের তথ্য নির্দিষ্ট সার্ভারে পাঠিয়ে দেয়া। এর ফলে বাংলাদেশের গ্রামে স্মার্ট ফোন বা ট্যাবলেটের প্রবেশ ঘটবে, যা প্রতিটি গ্রামকে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারে উৎসাহিত ও সমৃদ্ধ করবে। ৩. তথ্য সংগ্রহ, তথ্য ব্যবস্থাপনা ও কর্মী ব্যবস্থাপনা সবই হবে কেন্দ্রীয় স্মার্ট ব্যবস্থাপনার অধীনে। আমাদের দেশে অনেক টাকা দিয়ে ডেটা সেন্টার করা হয়েছে, কিছু ক্ষেত্রে বেসরকারী কিছু ডেটা সেন্টারও তৈরি করা হয়েছে কিন্তু কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার অভাবে ব্যান্ডউইথ নিরাপত্তার সুব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। ফলে বিদেশী ডেটা সেন্টার ব্যবসা যারা করে তাদের আমরা আকৃষ্ট করতে পারছি না। স্মার্ট ব্যবস্থাপনা গড়ে আমরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ‘বিগ ডেটা’ ব্যবস্থাপনার নজির তৈরি করতে পারি, যা আমার জানামতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে ভারত ছাড়া আর কেউ তেমন কিছু করে উঠতে পারেনি। ৪. ডিজিটাল বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় যে ঘটনা ঘটবে তা হলো এই ডেটা সংগ্রহ, বিন্যাস ও কেন্দ্রীয় সার্ভারে প্রেরণের জন্য গ্রামে গ্রামে উচ্চগতির ইন্টারনেটের এক্সেস বা অভিগম্যতা বাড়বে, যা এক সময় শুধু এই একটি সরকারী সহায়ক কাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। তখন নতুন নতুন বুদ্ধির জন্ম হবে, যেসব বুদ্ধি আমাদের দেশের তরুণদের আন্তর্জাতিক পরিসরে কাজ খুঁজতে, পেতে ও পাইয়ে দিতে সহায়ক হবে। আমার ধারণা তখন ‘ঘরে বসে কাজ ও আয়’ কথাটির বাস্তব প্রতিফলন ঘটবে। ৫. গত এক দশকে ডিজিটাল বাংলাদেশের যেসব কাজ হয়েছে তার বেশিরভাগই সরকারী উদ্ভাবনী কাজ, যার সেবা সুবিধাগুলো শহর থেকে গ্রাম পর্যায়ে পৌঁছেছে। কিন্তু গ্রামে গ্রামে তথ্যভা-ার তৈরি হলে তার ফলাফল ও সুবিধাগুলো গ্রাম থেকে শহরে যাবে। ফলে প্রধানমন্ত্রীর যে মুখ্য বিবেচনা ‘গ্রামের সমৃদ্ধি অর্জন’ তার এক বিশাল কর্মযজ্ঞের সফল পরিণতি ঘটবে, যা বাংলাদেশকে ২০৩০ সালেই পৌঁছে দেবে এসডিজি অর্জনের প্রধান কাতারের দেশগুলোর মধ্যে। ফলে আমরা দেখতে পাচ্ছি আমাদের সামনে এক মানবিক বাংলাদেশের আহ্বান, যে কাঠামোয় বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতার সুবর্ণ সময়ের উৎসবে দেখতে পাবে তার নিজেকেই। দেখবে ’৭১ সালের যুদ্ধের পরে যে ধ্বংসস্তূপ থেকে সে উঠে দাঁড়াতে চেয়েছে আর বারবার হোঁচট খেয়েছে এখন সে কোথায় এসে পৌঁছেছে। কী তার জীবন এখন! যে নিরন্ন বাংলাদেশ বলে ক্ষুধার সামনে পরিবারের নতজানু পিতা এখন সে কেমন আছে! যে মা একটি কাপড় আছে বলে তা-ই স্নান শেষে ভেজা শাড়ি গায়ে জড়িয়েই শুকাত সে মা এখন রূপকথার গল্পের মতো! কেউ আর তা বিশ্বাসই করতে চাইবে না। ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখতে এখন স্কুল-কলেজে যায়, গ্রামে সবাই তাদের খবর জানে। কারণ সব তথ্য এখন হাতে আছে। চাইলে ইন্টারনেটেও পাওয়া যায়। কারও বাড়িতে কোন কিছুর অভাব হলে, কোন কৃষকের বাড়তি সামান্য কিছু বীজ বা পাড়ার দোকানির সামান্য কিছু বাড়তি পুঁজির দরকার হলে গ্রামের সেই খবর অবশ্যই জানবে কোথায় গেলে সেসব সমস্যার সমাধান তখনই হবে। এর জন্য দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হবে না, আর দাদনের শোষণও ঘটবে না। গ্রামগুলো হয়ে উঠবে শহরের মতো কয়েক শ’ বছরের উল্টো পথ ঠিক সোজা হয়ে ঘুরে দাঁড়াবে, মানুষ আরও মানবিক হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ তখন মানবিক বাংলাদেশ হবে। এমন একটি দেশই বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন। তাঁর এক শ’ বছরের জন্মদিনে সেটাই হবে জাতির পিতাকে বাঙালীর দেয়া সবচেয়ে বড় উপহার। লেখক : পরিচালক, আমাদের গ্রাম উন্নয়নের জন্য তথ্য-প্রযুক্তি প্রকল্প [email protected]
×