ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পাহাড়ে মাচাং ঘর

প্রকাশিত: ০৪:২৪, ৫ জানুয়ারি ২০১৯

 পাহাড়ে মাচাং ঘর

তিন পার্বত্য জেলায় বসবাসকারী আদিবাসীরা যেন নানাভাবেই শিল্পী। তারা নিজেদের পোশাক নিজেরাই তৈরি করেন। খাবার তৈরিতেও তাদের রয়েছে নিজস্বতা। তবে সব পাহাড়ির একটি জিনিসে মিল খুব বেশি, তা হলো তাদের তৈরি ঘর। যেগুলোকে তারা মাচাং ঘর বলে। আর এ ঘরগুলো তৈরি হয় ছন (এক ধরনের খড়) দিয়ে। ছনের মাচাংগুলো দেখতে যেমন সুন্দর, তেমনি শীতল, আকর্ষণীয় ও আরামদায়ক। যদিও আধুনিকতার ছোঁয়ায় ছনের তৈরি ঘরের প্রবণতা একটু কমে গেছে। তবে পার্বত্যাঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলো পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে ছন দিয়ে মাচাং তৈরি করে এখনো বসবাস করছে। জানা গেছে, আদিকাল থেকে পাহাড়ি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলো বন্যপশু ও জীবজন্তুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে মাচাং ঘরে বসবাস করত। মাচাংগুলো সাধারণত মাটি থেকে ৫-৬ ফুট উঁচু করে তৈরি হতো। আর মাচাং তৈরির একমাত্র উপকরণ ছিল পাহাড়ি ছন ও বাঁশ। তাই একসময় তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে ব্যাপক ছনের কদর ছিল। কিন্তু কালের বিবর্তন ও জুম চাষের কারণে ছনের উৎপাদন কমে যাবার কারণে হুমকিতে পড়েছে পাহাড়ি ছনের ঘর। জেলার ক্রাক্ষ্যং পাড়ার বাসিন্দা মংসা প্রু মারমার সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, আজকাল জঙ্গলে বাঁশ-গাছ পাওয়া যায় না। বাজারে কিনতে পাওয়া বাঁশের দাম অনেক বেশি, তাই এখন আর মাচাং ঘরের দেখা মেলে না। সম্পূর্ণ বাঁশ, গাছ আর ছন দিয়েই তৈরি হতো মাচাং ঘর। ঘরের মূল খুঁটিগুলো হয় গাছ দিয়ে। আবার অনেক ক্ষেত্রে বড় বড় বাঁশের খুঁটি দিয়েও তৈরি হয়ে থাকে। মাচাংয়ের সঙ্গে খুঁটির যে সন্ধি বা সংযোগ রয়েছে, সেগুলো বাধাই করা হতো বাঁশের বেত দিয়ে। অল্প বয়সী কঁচি বাঁশ হতে তৈরি করা হয় এই বেত। বাড়ির মাচাংকে ধরে রাখতে মাচাংয়ের সমান্তরাল বাঁশের সঙ্গে খুঁটির প্রত্যেকটি সন্ধিতে মাটি থেকে দেওয়া হতো ঠেঁস। কাঠ, বাঁশ আর ছন দিয়ে তৈরি মাচাং ঘরের তেমন দেখা মেলে না। বাঁশ, বেত আর খুঁটির দাম বেশি হওয়ায় মাচাং ঘরের প্রতি তেমন আগ্রহ নেই আদিবাসীদের। যার কারণে হারিয়ে যেতে বসেছে ঐতিহ্যবাহী এই ঘর। এ ব্যাপারে বান্দরবান সরকারী কলেজে অধ্যয়নরত ক্যসিংমং মারমা বলেন, সামর্থ্য থাকলেও সচ্ছল ব্যক্তিরা মাচাং ঘর তৈরি করে না। কারণ তিন থেকে চার বছরের বেশি টিকে না। তাছাড়া বন-জঙ্গলে প্রতিনিয়ত উজাড় হচ্ছে প্রচুর গাছ-বাঁশ। তাই খরচ একটু বেশি হলেও স্থায়িত্বের কথা ভেবে অনেকেই ইট-পাথরের ঘর তুলতে আগ্রহী। বান্দরবান শহর থেকে ৮কিমি দূরে রোয়াংছড়ি সড়কের পাশে ক্রাক্ষ্যং মারমা পাড়ায় গেলে দেখা মিলে মাচাং ঘরের। কিন্তু সেখানেও আধুনিকতার ছোঁয়া, কিছু জায়গা জুড়ে গড়ে উঠেছে ইট-পাথরের ঘর, দূর পাহাড়ে জুম মৌসুমে কেবল দেখা মেলে এই মাচাং ঘরের। এদিকে বান্দরবানের ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের গবেষণা কর্মকর্তা উচনু বলেন, অবস্থানগত পরির্বতন কারণে আদিবাসীদের মাচাং ঘর বিলুপ্তির পথে। তাছাড়া বন উজাড়ের কারণে আগের মতো তেমন কাঠ-বাঁশও পাওয়া যায় না। ঐতিহ্যবাহী মাচাং ঘরকে টিকে রাখতে হলে সরকারী-বেসরকারীভাবে সমন্বিত উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। -এস বাসু দাশ, বান্দরবান থেকে
×