ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আজীবন ব্যবহারের দুটি ওষুধের ওপর থেকে আমদানি কর প্রত্যাহার দাবি বিশেষজ্ঞদের

কিডনি বিকল রোগীদের নিয়ে অসাধু চক্রের ডায়ালাইসিস ব্যবসা!

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ২২ ডিসেম্বর ২০১৮

  কিডনি বিকল রোগীদের নিয়ে অসাধু চক্রের ডায়ালাইসিস ব্যবসা!

নিখিল মানখিন ॥ কিডনি বিকল রোগীদের নিয়ে কিছুসংখ্যক অসাধু ব্যবসায়ী নিম্নমানের ডায়ালাইসিস ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে বিপুলসংখ্যক কিডনি রোগীর তুলনায় ডায়ালাইসিস সেন্টার খুবই কম। মাত্র ৯৬ এবং ১৮ হাজার রোগী এসব সেন্টারে সপ্তাহে দু’বার করে ডায়ালাইসিস করাতে পারেন। বেসরকারী সেন্টারগুলোয় সাড়ে তিন হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত ডায়ালাইসিসের মূল্য রাখা হয়। সপ্তাহে প্রতি রোগীকে দুই থেকে তিনবার ডায়ালাইসিস করাতে ৬ থেকে ১০ হাজার টাকা খরচ করতে হয়। সাউথ এশিয়াতে মোট কিডনি রোগীর তুলনায় মাত্র ১৫ শতাংশ রোগী ডায়ালাইসিসের সুযোগ পায়। বাকি বিপুলসংখ্যক রোগী অর্থাভাবে ডায়ালাইসিস নিতে পারে না। এ সুযোগে কিডনি বিকল রোগীদের কাছ থেকে নানা কৌশলে অর্থ হাতিয়ে নেয় একটি চক্র। মফস্বল থেকে আগত রোগীরাই এমন ফাঁদে বেশি পড়ছে। বাংলাদেশ রেনাল এসোসিয়েশন সূত্র জানায়, দেশে প্রায় ২ কোটি লোক কোন না কোন ধরনের কিডনি রোগে ভুগছে। আক্রান্তের শতকরা ৭৫ ভাগ রোগী কিডনি নষ্ট হওয়ার আগে এ মরণব্যাধির অস্তিত্ব ধরতে পারে না। কিডনি বিকল রোগীর চিকিৎসা এত ব্যয়বহুল যে, মাত্র শতকরা ৭ থেকে ১০ ভাগ লোকের পক্ষে চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব। দেশে প্রতি বছর ২৫ হাজার লোকের কিডনি নানা কারণে হঠাৎ অকেজো হয়ে যায়। প্রতি বছর কিডনি রোগে প্রায় ৪০ হাজার লোক মারা যায়। দেশে কিডনি বিকল রোগীদের জন্য কিডনিদাতার সঙ্কট প্রকট। কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য অপেক্ষমাণ মোট রোগীর মাত্র শতকরা ২ ভাগের পাক্ষে কিডনি প্রতিস্থাপন করানো সম্ভব হয়। অন্যরা নিজেদের মতো চেষ্টা করে রোগী নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমায়। বাকিরা ডায়ালাইসিস দিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে থাকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টাকা দিয়েও কিডনি সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে না। কিডনি দেয়ার পর ফলোআপ চিকিৎসা ও বিভিন্ন কারণে নানা শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন জীবিত কিডনিদাতারা। পাশাপাশি রয়েছে কিডনি সার্জনের সংকট, আইনী জটিলতাসহ নানা অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা। দেশে কিডনি রোগ চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকলেও খুবই ব্যয়বহুল। প্রতিস্থাপন কার্যক্রম চালু থাকলেও সাফল্যের হার খুব বেশি সন্তোষজনক নয়। দেশের সব চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে কিডনি প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা নেই। সীমিত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে ডায়ালাইসিস ও প্রতিস্থাপন কার্যক্রম চালু রয়েছে। কিডনি রোগের উপসর্গ ও চিকিৎসা সম্পর্কে অধ্যাপক ডাঃ শহিদুল ইসলাম সেলিম দীর্ঘদিন ধরে কিডনি রোগ ও প্রতিকার নিয়ে গবেষণা চালিয়ে আসছেন। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, নানা কারণে কিডনি অকেজো হয়ে পড়ে। কারো কারো কিডনি হঠাৎ করেই অকেজো হয়ে যায়। বাংলাদেশে ডায়রিয়া, অতিরিক্ত বমি, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, বিভিন্ন রকম ইনফেকশন, ম্যালেরিয়া, প্রসবকালীন জটিলতা, সাংঘাতিক ধরনের নেফ্রাটাইটিস, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও কিডনিতে পাথর হওয়ায় হঠাৎ করেও কিডনি অকেজো হয়ে যায়। এ ধরনের কিডনি অকেজো হয়ে যাওয়ার অবশ্য ভাল দিক আছে, অনেক ক্ষেত্রেই এগুলো প্রতিরোধ করা যায়। সময়মতো সঠিক চিকিৎসা দিতে পারলে অনেকের কিডনি পুনরায় স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা ফিরে পায়। এদেশে প্রতি বছর প্রায় ২৫ হাজার লোকের কিডনি বিভিন্ন কারণে অকেজো হয়ে যায়। সঠিক চিকিৎসা করলে প্রায় শতকরা ৭০ ভাগ রোগীর কিডনি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। অধ্যাপক ডাঃ শহিদুল ইসলাম সেলিম জানান, কিডনি প্রতিস্থাপনের দুই দিন আগে থেকে পরবর্তী সারাজীবন ধরে রোগীকে নিউরাল ও সেলসেপ্ট নামে দুটি ওষুধ খেয়ে যেতে হয়। ওই দুটি ওষুধ বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়ে থাকে। কিডনি প্রতিস্থাপন ভালভাবে সম্পন্ন হলেও ওই দুটি ওষুধ নিয়মিত না খেলে রোগীর মৃত্যু অনিবার্য হয়ে পড়ে। আর প্রতিটি নিউরাল (১০০ এমজি) দাম ১৫০ টাকা এবং প্রতিটি সেলসেপ্টের দাম ১১০ টাকা। এছাড়া কিডনি ভালভাবে মিল না হলে সাইমুলেট নামে দুটি ইনজেকশন দিতে হয়। প্রতিটি ইনজেকশনের দাম পড়ে দেড় লাখ টাকা। সারাজীবন ব্যবহারের ওই দুটি ওষুধ নিয়মিত খেতে পারে না অনেক দরিদ্র পরিবার। ওই দুটি ওষুধের ওপর থেকে এ কারণেই আমদানি কর উঠিয়ে দিলে কিডনি প্রতিস্থাপন করা অনেক রোগী উপকৃত হবে। কিডনিরোগ বিশেষজ্ঞরা বলেন, দেশে প্রয়োজনের মাত্র ১ থেকে ২ শতাংশ কিডনি প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে। কিডনি দানে রয়েছে আইনী জটিলতা এবং আগ্রহী ব্যক্তি স্বল্পতায় তা প্রতিস্থাপন অনেকাংশে আটকে যায়। ’৮২ সালে দেশে প্রথম কিডনি প্রতিস্থাপিত হলেও নিয়মিত কিডনি প্রতিস্থাপন শুরু হয় ’৮৮ সাল থেকে। এ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫০৫ কিডনি প্রতিস্থাপনে অস্ত্রোপচার হয়েছে, এর মধ্যে ১১ শিশু। ২৯ বছরের হিসেবে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবছর মাত্র ১৭ বা প্রতি দুই মাসে তিনটি কিডনি প্রতিস্থাপন হচ্ছে। কিডনিরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম এ ওহাব দেশে প্রথম কিডনি প্রতিস্থাপন উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি বলেন, দেশে কিডনি প্রতিস্থাপন অব্যাহত রাখতে হবে। কিন্তু দেশে কিডনিদাতার সঙ্কট প্রকট হয়ে উঠেছে। কিডনি দাতা ও গ্রহীতার ওষুধের মূল্যহ্রাস এবং মস্তিষ্কের মৃত্যুর (ব্রেন ডেথ) পর তার বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অসুস্থ ব্যক্তির দেহে সংযোজনের সুযোগ রেখে আইন তৈরি করা দরকার। কিডনি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডাঃ এম এ সামাদ বলেন, বিশ্বব্যাপী কিডনি রোগের হার অত্যন্ত ব্যাপক। বাংলাদেশে প্রায় ২ কোটি লোক কোন না কোনভাবে কিডনি রোগে আক্রান্ত। কিডনি বিকলের চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল, এ কারণে এদেশের শতকরা ১০ রোগীও চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারে না। অর্থাভাবে অকালে প্রাণ হারায় বেশিরভাগ। পক্ষান্তরে, একটু সচেতন হলে ৫০ থেকে ৬০ ভাগ ক্ষেত্রে কিডনি বিকল প্রতিরোধ সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন প্রাথমিক অবস্থায় কিডনি রোগের উপস্থিতি ও এর কারণ শনাক্ত করে তার চিকিৎসা। কিডনি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডাঃ হারুন অর রশিদ বলেন, দেশে বিপুুলসংখ্যক কিডনি রোগীর তুলনায় ডায়ালাইসিস সেন্টার খুবই কম, মাত্র ৯৬ এবং ১৮ হাজার রোগী এসব সেন্টারে সপ্তাহে দুই বার করে ডায়ালাইসিস পায়। বেসরকারী সেন্টারগুলোয় সাড়ে তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত ডায়ালাইসিসের মূল্য বাবদ রাখা হয়। তিনি বলেন, সাউথ এশিয়ায় মোট কিডনি রোগীর মাত্র ১৫ শতাংশ রোগী ডায়ালাইসিসের সুযোগ পায়, বাকি বিপুলসংখ্যক রোগী অর্থাভাবে ডায়ালাইসিস নিতে পারে না। এ জন্য বাংলাদেশে ডায়ালাইসিস খরচ কমাতে সরকারী-বেসরকারী বাস্তব উদ্যোগ নিতে হবে।
×