ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১

আলী যাকের

মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ!

প্রকাশিত: ০৭:০৪, ২১ ডিসেম্বর ২০১৮

 মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ!

পর্ব-২৪ এই যে সাত দশক ধরে নানাবিধ বিচিত্র অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হয়েছে জীবন, সেই সময়ে নিতান্ত জাগতিক খাওয়া-পরার জন্য আমাকে সাহিত্য, সংস্কৃতি, দর্শনকে অতিক্রম করে অতি আপাত নগণ্য বিষয়েও মনোযোগী হতে হয়েছে। না হলে, সেই সব দিনের সেই অভাবি দেশে জীবনযাপন করা বেশ কঠিন হয়ে পড়ত। আমি আমার জীবনের প্রথম পর্ব নিয়ে লেখা গ্রন্থে বলেছিলাম আমার পেশার কথা। এশিয়াটিক বলে একটি বিজ্ঞাপন এজেন্সিতে চাকরি করতাম তখন। আমাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকদের আনুকুল্যে অল্প দিনের মেেধ্যই আমি এশিয়াটিকের শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিলাম। তখন এই প্রতিষ্ঠানটির নাম ছিল ইস্ট এশিয়াটিক। সেই সময় আমার সামনে এক কঠিন চ্যালেঞ্জ হাজির হয়। দুটি পথ খোলা ছিল আমার সামনে। এক, আমার পেশায় নিয়োজিত থেকে অন্য সব রকম চিন্তা পরিহার করে কাজ করে যাওয়া এবং দুই, দেশের টানে, দেশের প্রয়োজনে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা। আমার মধ্যে কোন রাজনৈতিক অভিলাষ ছিল না, এখনও নেই, কিন্তু বিষয়টাকে আমি এইভাবে দেখলাম আমার মা যখন বহিরাগতদের দ্বারা আক্রান্ত হয় তখন আমি আমার বোধ বুদ্ধিকে সংযত রেখে নিজের কাজ চালিয়ে যেতে পারি না। যুদ্ধে যাওয়াই তখন আমার জন্য একমাত্র পথ। এই ভেবে ’৭১-এর ২৯ মার্চ আমি গৃহত্যাগ করি। এরপরের বর্ণনাগুলো আমার পূর্ববর্তী গ্রন্থে বিস্তারিত লেখা হয়েছে। অতএব, সেই সম্বন্ধে আমি আবারও লিখতে চাই না। তবে একটি কথা বলে রাখা ভাল যে যুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে এসে আমি সরকারী কোন কাজের সঙ্গে সংযুক্ত না হয়ে আমার পুরনো কর্মক্ষেত্রেই ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। মাকে মুক্ত করার যে যুদ্ধ তা সফলভাবে শেষ করে এসে, মায়ের কাছে যুদ্ধ শেষের পাওনা তো চাওয়া যায় না? অতএব, ফিরে এলাম আমার পুরনো কর্মস্থল এশিয়াটিকে। এ পর্যায়ে এশিয়াটিক সম্বন্ধে দু-একটি কথা না বললেই নয়। স্বাধীনতার পরে প্রথম বছর পাঁচেক আমার যথেষ্ট কষ্ট করতে হয়েছে এশিয়াটিকে দাঁড় করাতে। বাংলাদেশ তখন এক ধ্বংসস্তূপ। রাস্তাঘাট বিধ্বস্ত। যুদ্ধে রেললাইন উপড়ে ফেলা হয়েছে। অর্থনীতি অচল। রাষ্ট্রীয় কোষাগারে কোন অর্থ নেই। এইরকম একটি পরিস্থিতি তো রয়েছেই উপরন্তু আমাদের পথ চলাকে আরও দুঃসাধ্য করে তোলার জন্য পশ্চিমা দেশগুলো তাদের সাহায্য সহযোগিতার হাত গুটিয়ে নিয়েছে। এর কারণ আমরা তাদের নির্দেশ অনুযায়ী পাকিস্তানের সঙ্গে আপোস মীমাংসায় না এসে যুদ্ধ করেছিলাম। সেই দিনগুলোর কথা ভাবলে এখনও শিউরে উঠি। আমাদের সন্তানরা কল্পনাও করতে পারবে না কি কষ্টের দিন ছিল সেই সব। তবে বাংলার সাধারণ মানুষ সকল সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে সবসময়। রাষ্ট্রীয় কোষাগারে অর্থাভাব থাকায় আমাদের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সিদ্ধান্ত নিলেন যে কিছুদিনের জন্য সকল সরকারী দফতরে সর্বোচ্চ বেতন হবে মাসে ১০০০ টাকা। পরে অবশ্য এটা বাড়িয়ে আরও কিছুদিনের জন্য মাসে ২০০০ টাকা করা হয়েছিল। ব্যক্তি মালিকানায় পরিচালিত প্রতিষ্ঠানসমূহে এই ধরনের কোন নিয়ম আরোপ করা হয়নি। কিন্তু আমরা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ মেনে নিয়েছিলাম। ওই সময় ভোগ্যপণ্য থেকে শুরু করে বাড়িভাড়া পর্যন্ত সবকিছুই আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কমিয়ে আনা হয়েছিল। আমার মনে আছে, যুদ্ধের পূর্বে যে বাড়ির ভাড়া ছিল মাসে ৫০০ টাকা সে বাড়ির মালিককে গিয়ে যখন বললাম আমার আয় এখন যা দাঁড়িয়েছে তাতে করে ৫০০ টাকা দেয়া অসম্ভব। তিনি আমার বাড়িভাড়া কমিয়ে মাসে ৩০০ টাকা করে দিয়েছিলেন। ঠিক এইভাবে জীবনের সর্বক্ষেত্রে সব মানুষেরা সমান সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল আমাদের। এই পর্যন্ত লিখে ভাবছি যে আজকে স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরে হঠাৎ করে কেন সেই সব দিনে ফিরে যাচ্ছি আবার। তারপর মনে হলো ডিসেম্বরের বিজয় দিবস যখন দোরগোড়ায় তখন আমাদের মতো সৌভাগ্যবানদের ’৭১ এর ডিসেম্বরে ফিরে যাওয়াই তো অত্যন্ত স্বাভাবিক। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, অপরাহ্ণ। বড্ড ঠান্ডা পড়েছিল সেই দিন। আমার হাতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের একটি ছোট টেপ রেকর্ডার আর পিঠে ঝুলছে ছোট্ট ব্যাগ যাতে রাত্রি যাপন করার মতো কাপড়। আনমনে হাঁটছি যশোর রোড দিয়ে। ইচ্ছে যশোর হয়ে খুলনার দিকে যাওয়ার, বেতারের জন্য সংবাদ সংগ্রহ করতে। কয়েক ঘণ্টা আগেই মুক্তি এবং মিত্র বাহিনীর হাতে যশোরের পতন ঘটেছে। সেনানিবাসে অবস্থান নিয়েছে পাকিস্তানী বাহিনী। ওই সেনানিবাস ঘিরে রেখেছে মুক্তি বাহিনী এবং বাকিরা এগিয়ে চলেছে খুলনার দিকে। আমি যখন ওই পথে হাঁটছি তখন কচিৎ কদাচিৎ এক দুইজন মানুষের দেখা মিলছিল। কোন যানবাহনও পাচ্ছিলাম না যশোরের দিকে যাওয়ার। এমন সময় দূর থেকে একটা ভারতীয় বাহিনীর জিপকে আসতে দেখলাম। যশোর থেকে ফিরতি পথে চলেছে সীমান্তের দিকে। আমাকে দেখে গাড়িটির গতি শ্লথ হয়ে এলো। জিপ থেকে একজন সামরিক অফিসার চিৎকার করে বল্লেন, ‘Rejoyce. You are free.’ অর্থাৎ তোমরা স্বাধীন। আনন্দ কর। কলকাতা থেকে শুনে বেরিয়েছিলাম যে ওই দিনই পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে পারে। শেষ পর্যন্ত তাই ঘটল। এই বাক্য উচ্চারণে, You are free আমার দেহ-মন অসার হয়ে গেল। হাত থেকে টেপ রেকর্ডারটা খসে পড়ল রাস্তায়। আমি রাস্তার ওপরে বসে পড়লাম। তারপর হাপুস নয়নে কাঁদলাম। এ জীবনে আবার দেশে ফিরতে পারব এ আশা ক্রমেই স্তিমিত হয়ে যাচ্ছিল। সেটাই সম্ভব হলো আজ। ’৭১-এর ২৯ মার্চ দেশ ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধে চলে যাওয়ার পরে এশিয়াটিকের পাকিস্তানী কর্ণধাররা কিছুদিন এই কোম্পানিটিকে চালাতে চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করায় খুব সহজে তা সম্ভব হচ্ছিল না। ক্রমে ইস্ট এশিয়াটিকের ব্যবসা স্তিমিত হয়ে আসে। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের নিযুক্ত একজন হিসাব রক্ষক এখানে ছিলেন যিনি পাকিস্তান বাহিনীর সঙ্গে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরে। আমি ফিরে আসবার পর ইতস্তত করছিলাম আমার ভবিষ্যত কর্মপন্থা নিয়ে। যেহেতু আমি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ইংরেজী বিভাগের অনুষ্ঠান প্রযোজক ছিলাম সেই জন্য সম্ভাবনা ছিল যে ফিরে এসে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারের জন্যই কাজ করব। এই সময় আমার কয়েকজন পুরনো সহকর্মী আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং বলেন যে তারা প্রতীক্ষায় ছিলেন আমার ফিরে আসার এবং বড় আশায় আছেন যে আমি ফিরে এসে এশিয়াটিককে আবার নেতৃত্ব দেব। বস্তুতপক্ষে, তাঁদের কথা মনে করেই আমি সিদ্ধান্ত নিই যে এশিয়াটিকে ফিরে আসাই উচিত হবে। কিন্তু তখনকার পরিস্থিতিতে আমি কি করে এশিয়াটিকের ভার গ্রহণ করব তা বুঝে উঠতে পারছিলাম না। অবশেষে, আমি আমাদের বাংলাদেশ সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি লিখি। তাতে ইস্ট এশিয়াটিকের সেই সময়ের অবস্থা জানিয়ে তাদের নির্দেশ চাওয়া হয়। মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয় যে ইস্ট এশিয়াটিকের মালিকানা তখন থেকে বাংলাদেশ সরকারের ওপরে বর্তাবে এবং আমি সরকার নিয়োজিত প্রশাসক হিসেবে ইস্ট এশিয়াটিকের ব্যবসা পরিচালনা করব। তারিখটি এখনও স্পষ্ট মনে আছে। ৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২। ওই দিন আমি ইস্ট এশিয়াটিকের অফিসের তালা ভেঙে আমার পুরনো কর্মস্থলে পুনঃপ্রবেশ করি। ভেতরে সবকিছু দেখেশুনে মনটা বড় খারাপ হয়ে যায়। ধুলোর আস্তরণে ঢাকা আসবাব পত্রগুলো, যেন কত কিছু বলবার অপেক্ষায় ছিল। মনে হচ্ছিল কোন একদিন কর্মযজ্ঞ শেষে হঠাৎ করেই সব মানুষগুলো কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। চেয়ার, টেবিল, ফাইল, কাগজ এবং কলম যেখানে যেটি ছিল সেইভাবেই পড়ে আছে, ধুলোয় আকীর্ণ অবস্থায়। আমি গোটা অফিস সাফ-সুতরো করে ইস্ট এশিয়াটিককে আবার চালু করার দিকে মনোযোগ দিলাম। কিন্তু তখন হাতে কোন ব্যবসা ছিল না এবং আমরা সবাই জানি যে প্রতিযোগিতামূলক বাজারজাতকরণ ব্যবস্থা না থাকলে বিজ্ঞাপনের কোন প্রয়োজন থাকে না। যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ তখন বিক্রেতার স্বর্গরাজ্য। ক্রেতার কোন চাহিদা নেই। অতএব, বিজ্ঞাপনের প্রয়োজনীয়তাও নেই। আমি বিজ্ঞাপনের প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টির কাজে নিজেকে নিয়োজিত করলাম। বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের দ্বারে দ্বারে ঘুরে তাদের বোঝাতে চেষ্টা করলাম যে একটি সদ্য স্বাধীন দেশের মানুষকে দেশপ্রেমে অটুট রাখার জন্য জাতীয় দিবসগুলোতে দেশাত্মবোধক বিজ্ঞাপন পত্র-পত্রিকায় দেয়া দরকার যেন তারা হতদ্যোম না হয়ে আশায় বুক বেঁধে দাঁড়াতে পারে। ১৯৭২ এর ২১ ফেব্রুয়ারি এক অসাধারণ বিজ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে ইস্ট এশিয়াটিকের পুনর্জন্ম হলো। পত্রিকায় এ বিজ্ঞাপনটির ইলাস্ট্রেশনে দেখা যাচ্ছিল কলাপাতার উপরে একটি বাচ্চার হাতে খাগের কলমে লেখা ‘অ’ অক্ষরটি। ক্যাপশন ছিল, ‘আহা, আমার দুঃখীনি বর্ণমালা।’ এই অসাধারণ বিজ্ঞাপনের কপিটি লিখেছিলেন বাংলাদেশের প্রধান কবি শামসুর রাহমান। এই কথাগুলো এখনও মনে পড়লে গায়ে কাঁটা দেয়। কী এক অসাধারণ সময় গিয়েছে তখন!
×