ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ ইসলামের নিরিখে বিজয় বৈভব

প্রকাশিত: ০৪:৪৭, ২১ ডিসেম্বর ২০১৮

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ ইসলামের নিরিখে বিজয় বৈভব

(গত শুক্রবারের পর) বদর যুদ্ধের পরও প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামকে আরও বেশ কয়েকটি যুদ্ধ মোকাবেলা করতে হয়। তৃতীয় হিজরীর ১২ শাওয়াল মক্কার কাফির-মুশরিকরা মদিনা মনওয়ারা দখল করার মতলব এঁটে মদিনা মনওয়ারা থেকে দুই মাইল উত্তরে উহুদ পাহাড়ের পাদদেশে এসে আক্রমণ পরিচালনা করে। উহুদ যুদ্ধে শত্রুসৈন্য সংখ্যা ছিল তিন হাজার। মাত্র সাত শ’ মুজাহিদ নিয়ে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম এই আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। প্রাথমিক পর্যায়ে এ যুদ্ধে বিপর্যয় দেখা দিলেও এবং প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লামের দান্দান (দাঁত) মুবারক শত্রু সেনার ছুড়ে মারা পাথরের আঘাতে শহীদ হলেও কাফির-মুশরিকরা মদিনা মনওয়ারা দখল করতে পারেনি, তারা পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে মক্কায় ফিরে যেতে বাধ্য হয়। উহুদ যুদ্ধে বিখ্যাত বীর হযরত হামযা রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহুসহ প্রায় ৭০ জন সাহাবি জান কোরবান করে দিয়ে বিজয়ের পতাকা সমুন্নত রাখেন। এই যুদ্ধে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের ওপর মক্কার কাফির-মুশরিকদের আক্রমণের সময় সাহাবায়ে কেরাম শৌর্য-বীর্য, ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং রসুল প্রেমের যে অপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন তা ইতিহাসে সমুজ্জ্বল হয়ে রয়েছে এবং তা অনুসরণীয় আদর্শ হিসাবে যুগ যুগ ধরে গণ্য হয়ে আসছে। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : আন্্নাবীউ আওলা বিল্্ মু’মিনীনা মিন্্্ আন্্ফুসিহিম্্Ñ নবী মুমিনদের নিকট তাদের আত্মার চেয়েও অধিকতর ঘনিষ্ঠ (সূরা আহযাব : আয়াত ৬)। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, কেউ মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ না সে তার পিতা-পুত্র ও সব মানুষের চেয়ে আমাকে ভালবাসে (বুখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফ)। তার জ্বলন্ত প্রমাণ মেলে উহুদের যুদ্ধে। এক সাহাবি এই যুদ্ধে প্রিয় নবীকে (সা.) পাহারারত অবস্থায় নিজ বক্ষে শত্রু দ্বারা নিক্ষিপ্ত ৮০টি তীরের আঘাত সহ্য করেন এবং শহীদ হন। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে আমাকে ভালবাসে সে আমার সঙ্গে জান্নাতে প্রবেশ করবে (তিরমিজী শরীফ)। ইসলামের বিজয় প্রতিটি যুদ্ধে এসেছে। আবার শত্রুরা যখন সন্ধি করতে চেয়েছে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আল্লায়হি ও সাল্লাম শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সন্ধির শর্ত নিজেদের বিপক্ষে গেলেও তা সম্পাদন করেছেন। ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে এমন এক সন্ধিপত্রে তিনি স্বাক্ষর করেন যা হুদায়বিয়ার সন্ধি নামে পরিচিত। এই সন্ধিটিকে আল্লাহু জাল্লা শানুহু সুস্পষ্ট বিজয় হিসেবে অভিহিত করে ইরশাদ করেন : ইন্না ফাতাহ্না লাকা ফাত্্হাম্্ মুবীনা- নিশ্চয়ই আমি আপনাকে দিয়েছি সুস্পষ্ট বিজয় (সূরা ফাত্্হ : আয়াত ১)। হুদায়বিয়ার সন্ধির ফলে ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে দুর্বার গতি সঞ্চারিত হলো। বাস্তবেই এই সন্ধি ফতহুম মুবীন অর্থাৎ সুস্পষ্ট বিজয়ে পরিণত হলো। দলে দলে লোক ইসলামের ছায়াতলে এসে আশ্রয় গ্রহণ করতে লাগল। ইসলামের দাওয়াত ছড়িয়ে পড়তে লাগল তদানীন্তন পৃথিবীর সবখানে। ৬৩০ খ্রিস্টাব্দের রমাদান মাসে মক্কা বিজয় হলো। বিজয়ের সেই দিনে প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহ আলায়হি ওয়া সাল্লাম দশ হাজার সাহাবায়ে কেরাম নিয়ে তাঁর জন্মনগরী মক্কা মুকাররমায় বিজয়ীবেশে প্রবেশ করলেন। তিনি তখন বার বার উচ্চারণ করছিলেন : ওয়া কুল জাআল হাক্কু ওয়া জাহাকাল বাতিল, ইন্নালবাতিলা কানা যাহুকা এবং বলো, সত্য এসেছে, মিথ্যা দূর হয়েছে, নিশ্চয়ই মিথ্যা দূর হবার (সূরা বনী ইসরাঈল : আয়াত ৮১)। ঐতিহাসিক গিবন মক্কা বিজয়ের ইতিহাস তুলে ধরে বলেন : In the long long history of the world there is no instance of magnamity and forfineness which can approch those of Muhammad when all his enemies lay at his feet and he forgave them one and all. -হযরত মুহম্মদ (সা) নিজের পদতলে শত্রুদের পেয়েও একে একে সব শত্রুকে ক্ষমা করে দিয়ে যে নজির স্থাপন করলেন পৃথিবীর সুদীর্ঘ ইতিহাসে সেই ঔদার্য ও ক্ষমাশীলতার দ্বিতীয় কোন নজির আর নেই।... আর্থার গিলম্যান বলেন : Muhammad’s victory was in very truth of religion and not of politics... হযরত মুহম্মদ (সা)-এর এই বিজয় দীন (religion)-এর বিজয় ছিল, এটা কোন রাজনৈতিক বিজয় ছিল না। মক্কা বিজয়ের প্রায় আড়াই বছর পর প্রিয় নবী (সা.) তাঁর শ্রেষ্ঠ বন্ধু আল্লাহর কাছে চলে যান। চলে যাবার প্রায় নব্বই দিন পূর্বে আরাফাত ময়দানে তিনি ৯ জিলহজ বিদায় হজের ভাষণ দেয়া শেষ করলে আল্লাহ জাল্লা শানুহু ইসলামের পরিপূর্ণতার ঘোষণা দিয়ে ইরশাদ করেন : আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দিনকে পরিপূর্ণ করলাম, আমার নিয়ামত তোমাদের প্রতি পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম এবং তোমাদের দীন ইসলামকে সানন্দ অনুমোদন দান করলাম (সূরা মায়িদা : আয়াত-৩)। তাঁর চলে যাবার পর ইসলামের বিজয়ের বেগবান প্রবাহ অব্যাহত রয়েছে। তদানীন্তন বিশ্বের দুই পরাশক্তি পারস্য ও প্রাচ্যের রোমান সাম্রাজ্যের সর্বত্র ইসলামের ঝান্ডা উড্ডীন হয়েছে, এমনকি একাদশ থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত সমগ্র খ্রীস্টান জগতে ক্রুসেড নামে ক্রস চিহ্নিত পতাকা নিয়ে মুসলিম শক্তিকে ক্রুস রক্ষার যুদ্ধ বা ক্রুসেড চালিয়ে মুসলিমদের বিজয়ের গতিকে রোধ করতে পারেনি। ৭১০ খ্রিস্টাব্দে মুহম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয় এবং ১১৯২ খ্রিস্টাব্দে শিহাবুদ্দীন মুহম্মদ ঘুরীর হিন্দুস্থান বিজয় ইতিহাসে জ্বল জ্বল করছে। ১২০১ খ্রিস্টাব্দে ইখতিয়ারউদ্দীন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী বাংলাদেশে বিজয়ের যে পতাকা উড্ডীন করেন সেই বিজয় বাংলাদেশের মানুষকে সত্যিকার স্বাধীনতার আস্বাদ দান করল। শাহে বাঙ্গালা বা সুলতানে বাঙ্গালার সুশাসন কায়েম হলো। বাঙ্গালিয়ানদের বাঙ্গালিয়ানার সৌরভ স্ফুরিত হলো। বর্ণবাদ ও কৌলীন্য প্রথার শেকড় উৎপাটিত হলো। এখানে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পূর্বে বাঙ্গালিয়ানদের মুখের ভাষা বাংলাকে পূর্ববর্তী রাজারা ইতরজনের ভাষা, চাষা- ভূষার ভাষা, পক্ষীর ভাষা বলে যে দূরে ঠেলে দিয়েছিল, এই ভাষা চর্চা করলে রৌরব নামক নরকে যেতে হবে এমন অধ্যাদেশ পর্যন্ত যে জারি করেছিলে সেই অবহেলিত, অস্পৃশ্য ভাষাকে সুলতানে বাঙ্গালাগণ শাহী মর্যাদা দিয়ে এই ভাষায় সাহিত্য চর্চায় পৃষ্ঠপোষকতা দান করলেন। সবার জন্য শিক্ষার দ্বার উন্মোচিত করলেন। বাংলার মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে প্রভূত অবদান রাখলেন। বাংলার সোনালি যুগ বলতে সেই যুগকেই বোঝানো হয়। কিন্তু ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুন পলাশী প্রান্তরে জগত শেঠ আর মীর জাফরদের সঙ্গে আঁতাত করে ব্রিটিশ বেনিয়া ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজুদ্দৌলার কাছ থেকে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য লুট করে নিল। সেই স্বাধীনতাকে উদ্ধার করার লড়াই তখন থেকেই শুরু হলো। আন্দোলন আর সংগ্রামের নানা অধ্যায় সৃষ্টি করল এ দেশের মানুষ। এক পর্যায়ে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটানো সম্ভব হলেও বাংলার স্বাধীনতা যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটল না। সংগ্রাম এগিয়ে চলল। অতঃপর ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে দীর্ঘ নয় মাস হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই করে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে সেই স্বাধীনতা অর্জিত হলো। বিজয় এলো। আল্লাহর অশেষ রহমতে এই স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। এ বিজয় আল্লাহরই নিয়ামত। (সমাপ্ত) লেখক : পীর সাহেব, দ্বারিয়াপুর শরীফ
×