ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

একমাত্র জীবিত বীরপ্রতীক নারী মুক্তিযোদ্ধা সিতারার আক্ষেপ

প্রকাশিত: ০৪:৩১, ৮ ডিসেম্বর ২০১৮

 একমাত্র জীবিত  বীরপ্রতীক নারী  মুক্তিযোদ্ধা  সিতারার  আক্ষেপ

বিডিনিউজ ॥ তারামন বিবি মারা যাওয়ার পর বীরপ্রতীক খেতাব পাওয়া জীবিত একমাত্র নারী মুক্তিযোদ্ধা অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন সিতারা বেগম (৭৩)। বৈবাহিক সূত্রে তিনি সিতারা রহমান নামে পরিচিত। কিশোরগঞ্জের সন্তান সিতারা বর্তমানে সপরিবারে বাস করছেন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান অঙ্গরাজ্যের কালামাজো নগরীতে। ৪৮তম বিজয় দিবস উপলক্ষে তিনি বাংলাদেশের সম্প্রতি নানা ঘটনা নিয়ে কথা বলেন বিডিনিউজের সঙ্গে। আলোচনার শুরুতে ঢাকার যানজট নিয়ে আক্ষেপ করে সিতারা রহমান বলেন, ‘আমি সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই ঢাকায় যানজট অবসানে বিকল্প সড়ক নির্মাণে। একইসঙ্গে সচিবালয়সহ কয়েকটি অফিস সরিয়ে নেয়ার জন্যও সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। তাহলেই বিজয়ের প্রত্যাশা পূরণ হওয়ার পথ আরও সুগম হবে।’ বিজয় দিবসে দেশ ও প্রবাসের সবাইকে অভিনন্দন জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ অনেক উন্নতি করেছে ও করছে, তা জেনে এবং দেখে খুবই ভাল লাগে। তবে সবাই রাজধানীমুখী হওয়ায় যানজটে দৈনন্দিন কর্মঘণ্টার বড় একটি অংশ অপচয় হচ্ছে, এটি অবসানে সবার মনোযোগী হওয়া দরকার। গাড়িতে বসে অলস সময় পার করার মধ্য দিয়ে মানুষের আয়ুও কমছে, অর্থাৎ মানবকল্যাণে অঙ্গিকারাবদ্ধরাও অনেক কিছু করতে পারছেন না। সিতারা রহমান আক্ষেপ করে বলেন, একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর রমনার সেই রেসকোর্সে পাক হায়েনাদের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন আমার ভাই লেফটেন্যান্ট কর্নেল এটিএম হায়দার বীর উত্তম। অথচ ইতিহাসের কোথাও তার নাম নেই। এমনকি ঢাকা সেনানিবাসেও দেখিনি। বিজয় দিবস এলেই এটি আমাকে খুবই পীড়া দেয়। সিতারা রহমান বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা এখন কিছুটা হলেও সম্মান পাচ্ছেন, ভাতাও পাচ্ছেন নিয়মিত। এসব জেনে খুবই ভাল লাগে। নিজেকে সম্মানিত বোধ করি। সে কারণেই আশা করছি যে, সঠিক ইতিহাসের স্বার্থেই কর্নেল হায়দারের নাম আত্মসমর্পণের সেই ঐতিহাসিক দলিলে লিপিবদ্ধ করা হবে। তাহলেই কর্নেল হায়দারের আত্মা শান্তি পাবে। সিতারা রহমানের জন্ম ১৯৪৫ সালে কলকাতায়। দুই ভাই আর তিন বোনের মেঝো তিনি। তার বাবা কিশোরগঞ্জে আইনজীবী ছিলেন। সে সুবাদে সেখানেই বসবাস করেছেন। কিশোরগঞ্জ থেকে ম্যাট্রিক পাসের পর ঢাকায় হলিক্রস কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন সিতারা। তিনি লেখাপড়া করেন মেডিসিনে। সেখানে এমবিবিএস করার পর ১৯৭০ সালে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেডিক্যাল কোরে যোগ দেন লেফটেন্যান্ট হিসেবে। তাকে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে পোস্টিং দেয়া হয়। একই সময়ে তার বড় ভাই মেজর হায়দারকে পাকিস্তান থেকে বদলি করা হয় কুমিল্লায়। মেজর হায়দার কুমিল্লায় থার্ড ব্যাটেলিয়ন কমান্ডোতে যোগ দেন। সিতারা জানান, একাত্তরের ফেব্রুয়ারিতে ঈদ করতে ভাই-বোন মিলে কিশোরগঞ্জে গ্রামের বাড়িতে যান তারা। সে সময়ে সারাদেশে অসহযোগ আন্দোলন চলছিল। যানবাহন চলাচল বন্ধ। থমথমে ভাব সব জায়গায়। কর্মস্থল থেকে সবাই হেঁটে বাড়িতে ফিরছেন। ভাই-বোনের ছুটি শেষ হয়নি। তেমনি অবস্থায় মেজর হায়দার বোনকে নির্দেশ দিলেন কর্মস্থলে না ফিরতে। পাক হানাদারেরা বাঙালীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার পরই হায়দারসহ অনেকেই বিদ্রোহ করেন। গেরিলা দল গঠন করেন ভারতে গিয়ে। সেই দলের কয়েকজনকে পাঠান নিজ বাড়িতে মা-বাবা-ভাই- বোনদের পার্শ্ববর্তী মেঘালয় রাজ্যে নেয়ার জন্য। কিশোরগঞ্জ থেকে হেঁটে ভারতের মেঘালয়ে পৌঁছতে দুদিন সময় লেগেছে তাদের। মেঘালয়ে স্থাপন করা হয় ‘বাংলাদেশ হাসপাতাল’। সেটি ছিল টিনের ঘর, মেঝে পাকা ছিল না। ৪০০ বিছানা পাতা হয়। এর কমান্ডিং অফিসার নিযুক্ত হন চিকিৎসক সিতারা। তার অধীনে ছিলেন বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজের শেষ বর্ষের ছাত্র-ছাত্রীরা। যুক্তরাজ্য থেকে আসা কয়েকজন চিকিৎসকও সেই হাসপাতালে যোগ দেন। সিতারা এ হাসপাতালের ওষুধ-পত্র, সাজ-সরঞ্জাম আনতে মাঝে মধ্যেই আগরতলায় যাতায়াত করেন। হাসপাতালে একটি অপারেশন থিয়েটারও ছিল। এর মেঝে ঢাকা হয় প্লাস্টিক দিয়ে। সেখানে শুধু বাঙালী মুক্তিবাহিনীকেই চিকিৎসা করা হয়নি, একইসঙ্গে মিত্রবাহিনীর আহতরাও চিকিৎসা নেন। হতাহতদের চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত থাকা অবস্থায় সিতারা আকাশবাণী কলকাতা রেডিওর মাধ্যমে বিজয়ের খবর জানতে পারেন। তারা সবাই ফেরেন স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়। অসাধারণ এ বীরত্বের জন্য সিতারাকে বীরপ্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। তবে তিনি স্বাধীন দেশে বেশি দিন থাকেননি। স্বামী ও নিজের পেশাগত কারণে ১৯৭৩ সালেই পাড়ি দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে, প্রথমে উঠেছিলেন মিজৌরিতে। এরপর সিনসিনাটি, ওহাইয়ো এবং সর্বশেষ মিশিগানে বসতি গড়েছেন। তার দুই ছেলে ও এক মেয়ের সবাই যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নিয়েছেন, তারা বর্তমানে ফেডারেল প্রশাসনে কাজ করছেন। সিতারা বলেন, ‘একটি কিডনি ফেলে দিয়েছি। এখন একটি কিডনি নিয়েই বেঁচে আছি। বয়সের কারণে মাঝে মধ্যেই চেকআপ করাতে হচ্ছে। তবে সবকিছু নিয়ে ভালই কাটছে দিনকাল। প্রতি বছরই বাংলাদেশে যাই চিকিৎসক স্বামীকে নিয়ে। বিনামূল্যে চিকিৎসা দেই এলাকার মানুষদের।’ বীরপ্রতীক তারামন বিবির মৃত্যু সংবাদে সিতারা দুঃখ প্রকাশ করেন। বাংলাদেশের সব মুক্তিযোদ্ধাকে ঐক্যবদ্ধ থাকার অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, সবারই এখন চিরবিদায়ের পালা। তাই স্বপ্নের মতো বাংলাদেশ গড়তে ঐক্যের বিকল্প নেই। তাহলেই জীবনবাজি রেখে করা মুক্তিযুদ্ধের সার্থকতা আসবে।
×