ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নীতিহীন আঁতাতের জন্য ড. কামালের সঙ্গ ত্যাগ ॥ বিএনপি জামায়াতের সঙ্গে

প্রকাশিত: ০৬:১৩, ৭ ডিসেম্বর ২০১৮

নীতিহীন আঁতাতের জন্য ড. কামালের সঙ্গ ত্যাগ ॥ বিএনপি জামায়াতের সঙ্গে

রাজন ভট্টাচার্য ॥ ড. কামালের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে জামায়াত-বিএনপির নীতিহীন আঁতাতের অভিযোগ আসল খোদ জোটের ভেতর থেকেই। নীতিহীন আঁতাত ও আদর্শচ্যুতির প্রতিবাদে জোট থেকে বেরিয়ে গেলেন কামাল হোসেনের ঘনিষ্ঠজন হিসিবে পরিচিত ও জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার মূল উদ্যোক্তা আ. ব. ম মোস্তাফা আমীন। তিনি বলছেন, বিএনপির ধানের শীষ নিয়ে জামায়াত চলতে পারলেও আদর্শগত কারণে আমরা একই যাত্রায় শামিল হতে পারি না। জামায়াতকে ২০ দলীয় জোটে রেখেই বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলকে নিয়ে গণফোরামের নেতৃত্বে ১৩ অক্টোবর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের যাত্রা শুরু হয়। এই প্রেক্ষাপটে ২০ অক্টোবর জোট থেকে পদত্যাগ করেন তিনি। প্রায় দেড়মাস বিষয়টি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর দমিয়ে রাখা যায়নি। জামায়াতের সঙ্গে ঐক্য গড়ার অভিযোগে অনেক আগেই বি চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টও কামাল হোসেনের সঙ্গ ত্যাগ করার ঘোষণা দেয়। ফরওয়ার্ড পার্টির আহ্বায়ক ছিলেন মোস্তাফা আমীন। ২০০২ সালে দলের যাত্রা শুরু করেন সাবেক এই ছাত্রনেতা। ২০১৬ সালে দেশে বিদ্যমান অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি থেকে মুক্তির লক্ষ্যে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াসে গঠিত জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সদস্য সচিব হন তিনি। এরপর থেকে সমমনা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু হয়। আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে অনানুষ্ঠানিক বৈঠকও হয় বিভিন্ন দলের সঙ্গে। শেষ পর্যন্ত বিকল্পধারা, নাগরিক ঐক্য, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) সহ সমমনা বিভিন্ন সেক্টরের পেশাজীবীদের সমন্বয়ে যুক্তফ্রন্টের যাত্রা হয়। কামাল হোসেন এতে সরাসরি যোগ দেননি। তিনি পৃথক প্লাটফর্ম থেকে যুক্তফ্রন্টকে সঙ্গে নিয়ে জাতীয় ঐক্যপ্রক্রিয়ার বৃহৎ পরিসর গঠন করেন। শেষ পর্যন্ত বিকল্পধারাকে বাদ দিয়ে অন্য দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপির সঙ্গে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ঘোষণা দেন কামাল হোসেন। এরপর যুক্তফ্রন্ট নিজের দাবি করে এই প্রক্রিয়া থেকে সরে দাঁড়ান বি চৌধুরী। যদিও বিএনপির সঙ্গে তিনি কোন ঐক্য করবেন না একথা বারবার বলে আসছিলেন। এর যুক্তিতে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও অন্যতম সংবিধান প্রণেতা কামাল হোসেন বলেছিলেন, জামায়াতের সঙ্গ না ছাড়লে বিএনপির সঙ্গে কোন ঐক্য হতে পারে না। কামাল হোসেনের সঙ্গে একমত ছিল শরিক দলগুলোও। কিন্তু পর্দার অন্তরালে ঘটেছে অনেক কিছুই। হঠাৎ করেই পাল্টে যান কামাল হোসেন। রাজনীতির মাঠে চরমভাবে বেকায়দায় থাকা বিএনপির সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেন তিনি। অনেকটা একক সিদ্ধান্তেই জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের সিদ্ধান্ত নেন কামাল হোসেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে বি চৌধুরী যুক্তফ্রন্টের ব্যানারে আলাদা চলতে শুরু করেন। ফলে ফ্রন্ট থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন মোস্তাফা আমিন। ড. কামাল হোসেন তার নীতি ও আদর্শের পথে নেই জানিয়ে তার সঙ্গ ত্যাগ করেছেন মোস্তাফা আমীন। তিনি বলেন, বিএনপির প্রতীক ধানের শীষে ভোট করার সিদ্ধান্ত এবং স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতের একই প্রতীকে ভোট করার সিদ্ধান্ত তিনি মানতে পারছেন না। তিনি বলেন, ড. কামাল হোসেন বরাবর ঐক্যের কথা বলেন। আর এ বিষয়ে তার একটি উদ্যোগ ছিল জাতীয় ঐক্যপ্রক্রিয়া নামে। মোস্তাফা আমীন বলেন, ‘আমি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে আর নাই। কারণ আমি নীতি-আদর্শ বর্জন করে রাজনীতি করতে পারব না। আমি ড. কামাল হোসেনকে চিঠি দিয়ে বিষয়টি জানিয়েছি এবং সরাসরি তাকে আমার অবস্থান জানিয়েছি। উনি এখন যে রাজনীতি করছেন সেই রাজনীতি আমার পক্ষে করা সম্ভব নয় বলে জানান মুক্তিযোদ্ধা মোস্তাফা। মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকেই রাজনীতির মাঠে তিনি। তবে কখনও নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। ২০০৮ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ফেরদৌস আহমেদ কোরেশীর নেতৃত্বে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দলে যোগ দেন। সে উদ্যোগ ব্যর্থ হওয়ার পর ভেড়েন ড. কামালের সঙ্গে। গণফোরামের সভাপতি এবং ঐক্যফ্রন্টের প্রধান নেতার প্রতি কেন আপত্তি এ প্রসঙ্গে মোস্তাফা আমীন বলেন, তার আপত্তির বিষয়ে ড. কামালের সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন। কিন্তু সন্তোষজনক জবাব পাননি। এর পরই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তার সঙ্গে আর নয়। তিনি বলেন, ৪৭ বছর যারা দেশ শাসন করছে তাদের বিপক্ষে আমাদের অবস্থান, এখন যদি সেই (ড. কামাল) বিএনপি-জামায়াতের ধানের শীষে উঠে যান, তাহলে জনগণকে কী জবাব দেব? এ জন্যই আমি এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে নাই। ঐক্যপ্রক্রিয়ার সাবেক সদস্য সচিব বলেন, ড. কামাল যখন একটা প্রজেকশনে আসলেন, তাকে কেন্দ্র করে যখন জনগণ চিন্তা শুরু করলেন, তখন ওনাকে বললাম, ’৯০- এর আদলে একটি আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য। আমাদের লক্ষ্য জনগণ যেন অবাধে ভোট দিতে পারে। আমরা কোন অবস্থায় জোট করব না, যুগপৎ আন্দোলন গড়ে তুলব। আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপির সঙ্গে আমরা নেই। আমাদের লক্ষ্য ছিল বড় দুই দলের বাইরে গিয়ে নতুন রাজনৈতিক ধারা প্রচলনের মাধ্যমে একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু তারা সেই জোটেই গেলেন। এতে করে দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি থেকে বের হওয়া সম্ভব নয়। নীতি-আদর্শ বিসর্জন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তিনি বলেন, আমাদের কথা ছিল জনে জনে জনতার ঐক্য। এখন যা হয়েছে, দলে দলে ঐক্য। দলের সঙ্গে তারা বিলীন হয়ে গেছে। যাদের নিয়ে ড. কামাল দেশ পাল্টানোর কথা বলছেন, সেটা সম্ভব নয় বলেও মনে করেন তার সাবেক সঙ্গী। বলেন, ‘বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে আগে যে কর্মকা- করেছে, তাতে তারা গ্রহণযোগ্য নয়। এখন তাদের সঙ্গে জোট করে পরিবর্তন সম্ভব নয়।’ মুক্তিযোদ্ধা মোস্তাফা অমীন বিশেষভাবে ক্ষেপেছেন স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামী এবং ঐক্যফ্রন্টের শরিকদের একই প্রতীকে ভোট করার সিদ্ধান্তে। বলেন, ‘কামাল হোসেন সাহেব, আ স ম আবদুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্না, কাদের সিদ্দিকী সব সময় বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে বলে আসছেন। অথচ তারা সবাই তাদের সঙ্গে যোগ দিল। এটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ড. কামাল জোট করার আগে বলেছিলেন, জামায়াতের সঙ্গে থাকলে বিএনপির সঙ্গে জোট করা সম্ভব নয়। ১১ সেপ্টেম্বরও তিনি বলেন, ‘জামায়াত থাকলে আমার দল কোন ঐক্য প্রক্রিয়ায় যাবে না। তবে অন্য দলগুলো কী করবে তা বলতে পারি না।...সারা জীবনে কখনও জামায়াতের সঙ্গে যাইনি, শেষ জীবনে এসে সেটা করতে যাব কেন?’ এই বক্তব্যে গণমাধ্যমের শিরোনাম ছিল ‘জামায়াত সঙ্গে থাকলে বিএনপির সঙ্গে ঐক্য নয়: ড. কামাল’। তবে বিএনপি জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ থাকা অবস্থাতেই এই জোট করেছেন ড. কামাল আর এখন ২০ দলের সঙ্গে সমন্বয় করেই নির্বাচনে যাচ্ছে ঐক্যফ্রন্ট। ফ্রন্টের সূত্রগুলো বলছে, জামায়াতকে ধানের শীষ দেয়া নিয়ে জোটে প্রতিক্রিয়া হয়েছে। কারণ, এখন ড. কামাল ধানের শীষে ভোট চাইলে সেটা জামায়াত নেতাদের পক্ষেও যাবে। এ জন্য বিএনপিকে এই সিদ্ধান্ত না নেয়ার অনুরোধ করেছিলেন নেতারা। কিন্তু বিএনপি শোনেনি। জামায়াতকে বিএনপির ধানের শীষ নেয়া নিয়ে অস্বস্তি থাকলেও ধানের শীষ পেতে ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের চেষ্টার অবশ্য কমতি নেই। এরই মধ্যে আ স ম রব, মাহমুদুর রহমান মান্না, আবদুল কাদের সিদ্দিকী অথবা মেয়ে কুড়ি সিদ্দিকী, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর, আবু সাইয়িদের মনোনয়ন নিশ্চিত হয়েছে। গণফোরাম নেতা সুব্রত চৌধুরী এবং মোস্তফা মহসিন মন্টু, আসন নিশ্চিত না হলেও তারা আশাবাদী। বিএনপি তার দুই জোট ২০ দল এবং ঐক্যফ্রন্টকে মিলিয়ে ৬০টি আসনে ছাড় দেয়ার কথা বলেছে। বিএনপির কাছে ছাড় পেতে ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের এই চেষ্টারও তীব্র সমালোচনা করেছেন আ ব ম মোস্তাফা আমীন। বলেছেন, নেতাদের এই দেখেন মনোনয়নের জন্য কীভাবে পাগলা ঘোড়ার মতো দৌড়াচ্ছে একেকজন। আমি তাদের সঙ্গে একমত নই, আমি এর মধ্যে নাই। মোস্তাফা আমীন বলেন, আমার হাতে গড়া জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া একটি নীতি আদর্শ নিয়ে পথচলা শুরু করেছিল। আমাদের কথা ছিল স্বাধীনভাবে পথ চলতে চাই। কিন্তু কামাল হোসেনের বিএনপি-জামায়াত ঐক্যকে নীতিহীন মনে হয়েছে। তিনি বলেন, এই প্লাটফর্মকে দাঁড় করানোর জন্য অনেক অর্থ গেছে। আমি নানাদিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। তবুও চিন্তা করেছিলাম দেশের জন্য একটা ভাল কিছু করতে যাচ্ছি। আমার মনে মনে ভয় ছিল কামাল হোসেন হয়ত জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সবাইকে নিয়ে আওয়ামী লীগে যাবে। কিন্তু সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা ও বঙ্গবন্ধু সরকারের মন্ত্রী গেল বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে। আর সাবেক বিএনপি সরকারের রাষ্ট্রপতি বি চৌধুরী গেল আওয়ামী লীগের ঘরে। আমি মন থেকে এ ধরনের বাস্তবতা মেনে নিতে পারিনি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে নীতি আদর্শ বলতে কিছু নেই এমন মন্তব্য করে মোস্তাফা বলেন, ক্ষমতার জন্য নেতারা আদর্শ বিসর্জন দিতে পিছ পা হন না। ভুলে যান প্রতিশ্রুতির কথাও। আমি মনে করি, কামাল হোসেন বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে গিয়ে নীতি বিসর্জন দিয়েছেন। তিনি বলেন, আমি কামাল হোসেনের প্রতি সম্মান দেখাতে গিয়ে তার কাছে পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছি। এরপর কামাল হোসেনের পক্ষ থেকে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার নীতিগত সিদ্ধান্ত হলো নীতিহীন রাজনীতিতে নেই। তাই যোগাযোগ নিয়ে ভাবনা নেই। তবে যুক্তফ্রন্টের পক্ষ থেকে আমার কাছে ফেনী-১ আসনে প্রার্থী হওয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। আমি সম্মতি দেইনি। এখন একা আছি, ভাল আছি। তিনি বলেন, ২০২৩ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আমি নিজেই এখন থেকে কাজ শুরু করেছি। ফরওয়ার্ড পার্টিকে শক্তিশালী করব। শুক্রবার বিকেল পাঁচটায় দলের কার্যালয়ে বৈঠক ডাকা হয়েছে। এই বৈঠক থেকেই পার্টির নতুন করে যাত্রা শুরু হবে বলে যোগ করেন তিনি।
×