ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নৌকার ছবিতে বাংলাদেশ

ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দিব রে...

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ৫ ডিসেম্বর ২০১৮

ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দিব রে...

মোরসালিন মিজান ॥ অনেকদিন পর একসঙ্গে এত নৌকা দেখা। হ্যাঁ, ছবিতে। তবে মনে হচ্ছিল না, ছবি। যেন চোখের সামনে পাল তুলে এগিয়ে চলেছে নৌকা। খুব বেশি গতি নেই। অথচ কী অনায়াসে দূর থেকে দূরে, আরও দূরে চলে যাচ্ছে! নৌকা দেখতে গিয়ে দেখা হচ্ছে নদী। ঢেউ। সাদা কাশবন। নদী তীরের জীবন, ফেলে আসা গ্রাম দেখা হচ্ছে নতুন করে। দেখা হয়ে যাচ্ছে অপরূপ বাংলাদেশটা! মুক্তিযুদ্ধের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। ‘তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর,/পাড়ি দিব রে/আমরা ক’জন নবীন মাঝি/হাল ধরেছি শক্ত করে রে...। আবারও শক্ত হাতে বাংলাদেশের হাল ধরার সময় এসেছে। ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দিতে হবে। জরুরী এ বার্তাটিও দিচ্ছে বিশেষ প্রদর্শনী। গ্যালারির প্রতি দেয়ালে নৌকা। মোট ১০০ ছবি। নৌকা সুন্দর। ছবিগুলোও। দেশের নানা প্রান্ত ঘুরে এসব ছবি তুলেছেন আলোকচিত্রী এম এ তাহের। বিষয় ভিত্তিক কাজের জন্য আলাদা পরিচিতি আছে তার। এবার নৌকা নিয়ে সামনে এসেছেন। মূল প্রয়াসটিকে সাম্প্রতিক বলা যাবে না। বহু বছর আগে থেকেই নৌকার ছবি তুলছিলেন। এভাবে বড় সংগ্রহ। সংগ্রহ থেকে পছন্দেরগুলো নিয়ে প্রদর্শনীর আয়োজন। ‘বাংলাদেশের নৌকা’ শিরোনামে শিল্পকলা একাডেমি এ প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে। জাতীয় চিত্রশালা প্লাজায় শনিবার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। ১ নম্বর গ্যালারিতে নৌকা আর নৌকা শুধু। কত নামের কত জাত পাতের নৌকা! দেখে শেষ করা যায় না। তাল গাছের কাÐ দিয়ে তৈরি করা নৌকার কথাই ধরা যাক। এক পায়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাছের শক্ত বহির্কাঠামো কেটে মাঝখানে গর্তের মতো করে নেয়া হয়েছে। এটাই পরে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে জলে। কোন জোড়া নেই। তক্তা পেরেকের ব্যাপার নেই। দিব্যি চলছে। তাল গাছ কেটে বানানো বলে নৌকার নাম ‘তালের ডোঙা।’ আলোকচিত্রী নৌকাটির ছবি তুলেছেন খুলনা থেকে। সমুদ্রের বিশাল বিশাল ঢেউ ভেঙে চলা নৌকাগুলো থেকে তো চোখ সরানো যায় না। একেবারেই অন্যরকম। সেন্টমার্টিন থেকে তাহেরের তোলা ছবিতে দেখা যায়, নৌকার দুই প্রান্ত সরু ও বাঁকা হয়ে উপরের দিকে ওঠে গিয়েছে। অর্ধচন্দ্রের মতো দেখায়। এ কারণেই স্থানীয় নাম ‘চান্দের নৌকা।’ সমুদ্রের উত্তাল জলরাশি, বিশাল খোলা আকাশের মাঝখান থেকে তুলে আনা ফর্ম দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পানের মোটিফটাও ভীষণ আকর্ষণ করে। ওরে সাম্পানওয়ালা তুই আমারে করলি দেওয়ানা...। দেওয়ানা শুধু সাম্পানওয়ালা করে না। কাপ্তাই থেকে কালুরঘাট থেকে তোলা ছবিও দেওয়ানা করে ছাড়ে। মনে হয় পেইন্টিং। ঐতিহ্যের পাশাপাশি বিশেষ নির্মাণ বৈশিষ্ট্যের কারণে সহজেই দৃষ্টি কাড়ে সাম্পান। সামনের অংশ সরু হতে হতে উপরের দিকে উঠে গেছে। পেছনটা দেখতে ইংরেজী ‘ইউ’ বর্ণের মতো। চমৎকার ফ্রেমে ধারণ করেছেন এম এ তাহের। ছোট ছোট নদী পারাপারে নৌকার ব্যবহার অনেক পুরনো। গ্রামে নয় শুধু, শহরেও দেখা যায় এমন দৃশ্য। আলোকচিত্রী পারাপারের চিরচেনা ছবি তুলেছেন ঢাকার সদরঘাট থেকে। বুড়িগঙ্গায় ভাসানো নৌকা সবাই দেখেছেন বটে। আলোকচিত্র জানাচ্ছে, এর আলাদা নাম আছে। নামটি কোষা। মাছ ধরার নৌকাগুলো একেক এলাকায় একেক রকম দেখতে। এসব নৌকা গরিব জেলেদের প্রধান অবলম্বন। একইসঙ্গে নদীপ্রধান অঞ্চলে পণ্য পরিবহনে বড় ভূমিকা রাখছে নৌকা। সচেতন কিংবা অসচেতনভাবে আলোকচিত্রী সে জায়গাটি ফোকাস করেছেন। কিংবা, বলা চলে, অনিবার্য হয়েই এসেছে নৌ পরিবহন। সিলেটের তামাবিল থেকে ক্যামেরাবন্দী করা হয়েছে বারকি নৌকা। ভারতের পাহাড় বেয়ে নেমে আসা ঝর্ণার জলে নদী। নদী থেকে তোলা পাথর পরিবহনের কাজ করছে ছোট ছোট বারকি নৌকা। নৌকার সঙ্গে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যোগ করে নতুন মাত্রা দেন আলোকচিত্রী। অন্যান্য এলাকা থেকে খুঁজে নেয়া হয়েছে ধান বাঁশ পাট ইত্যাদি বোঝাই করা নৌকা। ছবিগুলো বদলে যাওয়া সমৃদ্ধ গ্রামীণ অর্থনীতি সম্পর্কে একটি ধারণা দেয় বৈকি। আলাদা করে বলতে হয় পাল তোলা নৌকার কথা। মাঝ নদীতে পাল বা বাদাম তোলা নৌকা। দূর থেকে কী যে সুন্দর দেখায়! অকৃত্রিম রূপটি আলোকচিত্রী তার ক্যামেরায় ধারণ করেছেন। দেখে মন গুনগুন করে ওঠেÑ বাদাম দেইখা চাইয়া থাকি/আমার নি কেউ আসে রে...। প্রদর্শনীকে সমৃদ্ধ করে বিলুপ্ত প্রায় গ্রামীণ সংস্কৃতি। নৌকা বাইচের ছবিগুলো এ সংস্কৃতির উদাহরণ। নদীর বুকে চলমান যে নৌকা, তার এক সৌন্দর্য। গতিটা ধরার চেষ্টা করেন এম এ তাহের। আবার ঘাটে নোঙর করা নৌকার আলাদা সৌন্দর্য। এ সৌন্দর্য থেকেও দর্শককে বঞ্চিত করেন না তিনি। তার ছবিতে ঘাটে বাধা সারি সারি নৌকা যেন ভাষা পায়। আমি অপার হয়ে বসে আছি...। বসে থাকা নৌকা চির চাওয়ার কাছে একদিন নিশ্চয়ই পৌঁছে দেবে মানুষকে। দেবে তো? এখানেই শেষ নয়, শুকনো মৌসুমে ডাঙায় পড়ে থাকা যৌবনহীন নৌকোর ছবি তুলেন তাহের। একেবারেই স্থির। বিধ্বস্ত। কিন্তু ভরা মৌসুমের জন্য যে অপেক্ষা, তা ঠিক বোঝা যায়। এখানেই বিশিষ্টার্থক হয়ে ওঠে ছবিগুলো। এসবের বাইরে নৌকা বানানোর বিভিন্ন পর্যায়, নৌকা বেচা কেনার ছবি রাখা হয়েছে প্রদর্শনীতে। তবে ইঞ্জিন চালিত স্টিলের নৌকা, লোহার কাঠামো প্রদর্শনীতে দেখা যায় না। এ ধরনের ছবি রাখা হয়নি প্রদর্শনীতে। ঐতিহ্যবাহী রূপটিকে বাঁচিয়ে রাখতে, সামনে রাখতে এমন প্রয়াস বলেই মনে হয়। সব মিলিয়ে চমৎকার। নৌকার ছবিতে বাংলাদেশ দেখার সুযোগ থাকছে আগামী ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
×