ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

অপপ্রচারে এবার ব্যবহার হলো হাউস অব কমন্সের নাম

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ৪ ডিসেম্বর ২০১৮

অপপ্রচারে এবার ব্যবহার হলো হাউস অব কমন্সের নাম

স্টাফ রিপোর্টার ॥ আসন্ন নির্বাচন পরিস্থিতি নিয়ে এবার শুরু হয়েছে খোদ ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ‘হাউস অব কমন্স’র নামে অপপ্রচার! ‘নির্বাচন পরিস্থিতি পরিস্থিতি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড এর ধারে কাছেও নেই’-হাউস অব কমন্সে’র বরাত দিয়ে প্রকাশিত এমন এক অসত্য প্রতিবেদন নিয়ে শুরু হয়েছে তোলপাড়। হাউস অব কমন্সে‘র নামে নির্বাচন পরিস্থিতি নিয়ে সংবাদ প্রকাশের পর বিএনপি-জামায়াতপন্থীদের সন্তোষ প্রকাশের মধ্যেই বেরিয়ে এলো, হাউস অব কমন্স এমন কোন প্রতিবেদনই দেয়নি। অথচ এটাকেই ইস্যু বানিয়ে টকশো থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও চলছে অপপ্রচার। এদিকে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের হাউস অব কমন্স’র নামে চালানো এ তৎপরতাকে বাংলাদেশের সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ বানচাল ও প্রভাবিত করার ষড়যন্ত্র হিসেবে অভিহিত করেছেন নির্বাচন পর্যবেক্ষকসহ রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলেছেন, একটি পত্রিকা তাদের ভুল সংবাদের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন, তবে যারা কোন ভুলও স্বীকার করেনি তাদের তৎপরতা উদ্বেগজনক। নির্বাচন বানচালে বিএনপি-জামায়াতের আশির্বাদে ড. কামাল হোসেনসহ তার রাজনৈতিক বন্ধুরা যে নানামুখী ষড়যন্ত্র করছেন এ অপপ্রচার তারই অংশ। একে হালকাভাবে নিলে ভাল হবে না উল্লেখ করে এ ধরনের কর্মকা- বন্ধে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করারও সুপারিশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। জানা গেছে, গত ১ ডিসেম্বর দেশের কয়েকটি পত্রিকায় এই বলে প্রতিবেদন প্রকাশ করে যে,‘বাংলাদেশের নির্বাচন পরিস্থিতি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড এর ধারেকাছেও নেই বলে মন্তব্য করেছে যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ হাউস অব কমন্স।’ হাউস অব কমন্সের ‘রিসার্চ ব্রিফিং’ প্রতিবেদনে এই মন্তব্য করা হয়েছে বলেও দু’একটি গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ করা হয়। জামায়াতের নিজস্ব মিডিয়া হিসেবে পরিচিত গণমাধ্যমে বলা হয়, ‘হাউস অব কমন্সের ১৩ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সুযোগ নিচ্ছে। অন্যদিকে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর দমনপীড়নের মাত্রা এখনও তীব্র। নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণকে অপ্রত্যাশিত বলছে হাউস অব কমন্স। এবারের নির্বাচনে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে কোন পর্যবেক্ষক দল না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আন্তর্জাতিক মহলে এই নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ আছে। খালেদা জিয়ার মুক্তি, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের আয়োজনসহ কোন দাবি পূরণ না হওয়া সত্ত্বেও বিএনপি অপ্রত্যাশিতভাবে নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, এর ফলে নির্বাচন তুলনামূলক বিশ্বাসযোগ্য হবে। কিন্তু ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ বা সমান সুযোগ নিশ্চিতের বিষয়টি অনেক দূরে।’ হাউস অব কমন্সের প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে প্রকাশিত সংবাদে আরও বলা হয়, ‘নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে বহু আগ থেকেই যে বিরোধীদের পক্ষ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে, সেই প্রসঙ্গটিও বাদ যায়নি প্রতিবেদনে। প্রতিদ্বন্দ্বিতার নিয়মের প্রতি (রুলস অব গেম) সার্বিক আস্থার মাত্রা তলানিতে রয়ে গেছে। এর ফলে নির্বাচনী প্রচারকালে বা নির্বাচনের ফল ঘোষণার পরপর সংঘাত ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে।’ একই সঙ্গে লেখা হয়েছে, ‘হাউস অব কমন্সের এই প্রতিবেদনে বিএনপির দাবি-দাওয়া, খালেদার মামলা ও সাজা, সংলাপের আয়োজনসহ সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি সবিস্তারে তুলে ধরা হয়েছে। সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের মাধ্যমে বিএনপি ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিকে স্বাগত জানিয়েছে। এর বিপরীতে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির জোরালো দাবিদার আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোট সম্প্রতি রক্ষণশীল ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো, হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সখ্য। এ অবস্থা উল্টো পথে মোড় নেয়ার মতো।’ হাউস অব কমন্সের মতো প্রভাবশালী প্ল্যাটফর্মের পক্ষে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যে কোন প্রতিবেদনই সর্বস্তরেরর মানুষের মাঝে আলোড়ন তোলে। এক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম হয়নি। বরং একে ইস্যু বানিয়ে নতুন করে সরকারবিরোধী প্রচার শুরু করেছে । বিশেষ করে জামায়াত-শিবিরের বাঁশের কেল্লা থেকে শুরু করে সরকারবিরোধী ও উগ্রবাদী সকল ফেসবুক পেজে চলছে এটাকে ইস্যু বানানোর অপচেষ্টা। বিএনপি-জামায়াতপন্থীদের মিত্র হিসেবে পরিচিত কয়েকজনও হাউস অব কমন্সের প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে সরকারবিরোধী বক্তব্য নিয়ে হাজির হয়েছেন টকশোতে। তবে এরই মধ্যে জানা গেল, হাউস অব কমন্স এমন কোন প্রতিবেদনই দেয়নি। হাউস অব কমন্স লাইব্রেরির একজন রিসার্চ এ্যানালিস্টের রচিত ব্রিফিং পেপারকে যুক্তরাজ্যের হাউস অব কমন্সের প্রতিবেদন হিসেবে উল্লেখ করে সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে নিজের লেখায় কথাগুলো বলেছেন, জন লান নামে একজন। যিনি ‘হাউস অব কমন্স লাইব্রেরি’র একজন সিনিয়র রিসার্চ এ্যানালিস্ট হিসেবে কাজ করেন। তার হাউস অব কমন্সের বক্তব্য হিসেবে চালিয়ে দেয়া হয়েছে সংবাদে। একটি গণমাধ্যম অবশ্য ইতোমধ্যেই বিষয়টি তুলে ধরে নিজেদের সংবাদেন জন্য দুঃখ প্রকাশসহ সংশোধনী দিয়েছে। তবে বাকিরা তাদের অবস্থান পরিবর্তন করেনি। জানা গেছে, হাউস অব কমন্সের প্রতিবেদন ‘রিসার্চ ব্রিফিং’ নামে পরিচিত। দেশটির এমপিদের অবগতির জন্য এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। তবে হাউস অব কমন্স কোন ‘রিসার্চ ব্রিফিং’ প্রকাশ করেনি। গত ২৯ নবেম্বর ইধহমষধফবংয: ঘড়াবসনবৎ ২০১৮ ঁঢ়ফধঃব শিরোনামে লেখা ব্রিফিং পেপারটি হাউস অব কমন্স রচনা করেনি, এমনকি হাউস অব কমন্স-এর কোন সংসদ সদস্যও রচনা করেননি। ব্রিফিং পেপারটি রচনা করেছেন জন লান, যিনি হাউস অব কমন্স লাইব্রেরির একজন সিনিয়র রিসার্চ এ্যানালিস্ট। এরকম অসংখ্য ব্রিফিং পেপার বা রিসার্চ ব্রিফ যুক্তরাজ্যের হাউস অফ কমন্স লাইব্রেরি, হাউস অব লর্ডস লাইব্রেরি ও পার্লামেন্টারি অফিস অব সায়েন্স এ্যান্ড টেকনোলজির কর্মকর্তারা নিয়মিত ভিত্তিতে রচনা ও প্রকাশ করে থাকেন। ২৯ তারিখ এমন মোট ৫টি ব্রিফিং পেপার প্রকাশিত হয়েছে হাউস অব কমন্স লাইব্রেরি থেকে। বাকি ব্রিফিং পেপারগুলোর বিষয়বস্তু ছিল উত্তর আফ্রিকা, জলবায়ু পরিবর্তন, যুক্তরাজ্যের গৃহায়ন প্রকল্প ও উইল লেখকদের বিধিনিয়ম। হাউস অব কমন্স লাইব্রেরির সিনিয়র রিসার্চ এ্যানালিস্ট জন লান রচিত ব্রিফিং পেপার কখনই যুক্তরাজ্যের হাউস অব কমন্সের প্রতিবেদন হিসেবে বিবেচিত নয়। তাহলে কেন প্রকাশ করা হলো এমন সংবাদ। কি ভাবছেন বিশেষজ্ঞরা? অনেকেই বিষয়টিকে দেখছেন দুটি ভিন্ন দিক থেকে। যার একটি হচ্ছে না জেনে ভুল তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই সংবাদ লেখা হয়েছে। আরেকটি হচ্ছে উদ্দেশ্যমূলক অপপ্রচার। একটি পত্রিকার সংশোধনীর দিকে তাহলে বিষয়টি ভুল বলেই মনে হয় কিন্তু অন্যরাতো ভুল বলছেনা কিংবা দুঃখও প্রকাশ করেনি। এই শ্রেণীর অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিভিশন, চলচ্চিত্র ও ফটোগ্রাফি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ড. এ জে এম শফিউল আলম ভূঁইয়া বলছিলেন, বিষয়টিকে দেখা যায় দুইভাবে। যদি নির্মোহভাবে দেখা হয় তাহলে এটা একটি ভুল। সাংবাদিকতার জন্য একটি তথ্য যাচাইবাছাই পরীক্ষা নিরীক্ষা করার যে বিষয়টি আছে তা না করেই সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে। আরেকটি উদ্দেশ্যমূলক। কোন দলের বা পক্ষের হয়ে সংবাদ প্রকাশ করা। কারও কারও দুঃখ প্রকাশের দিক তাকলে ভুলই মনে হবে। কিন্তু যারা দুঃখ প্রকাশ করেনি তারা যে পলিটিক্যালি মটিভেটেড এটাতো মনে হবেই। এটা তাহলে উদ্দেশ্য নিয়ে করা হয়েছে। যা উদ্বেগজনক। নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা জানিপপের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ‘হাউস অব কমন্স’র নামে এ ধরনের তৎপরতায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, এটা মনেই হবে নির্বাচনের বিরুদ্ধে একটি ষড়যন্ত্র।
×