ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রতিবন্ধী ও অনগ্রসররা যাতে চাকরি পায় সেই নীতিমালা হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ৪ ডিসেম্বর ২০১৮

প্রতিবন্ধী ও অনগ্রসররা যাতে চাকরি পায় সেই নীতিমালা হচ্ছে

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ দুই হাতবিহীন প্রতিবন্ধী এক নারীর পা দিয়ে তৈরি ‘নৌকা’ উপহার পেয়ে প্রতিবন্ধীদের সুপ্ত প্রতিভা দেখে বিস্মিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, কোটা পদ্ধতি বাতিল হলেও সরকারী চাকরিতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, সংখ্যালঘু নৃগোষ্ঠীসহ অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর অধিকার নিশ্চিত করতে তাঁর সরকার নীতিমালা প্রণয়ন করছে। আমাদের কোন শ্রেণীর মানুষ অবহেলিত থাকবে না। সকলকেই মনে করতে হবে, সকলেই আমাদের আপনজন। তাদের কীভাবে আপন করে নেয়া যায়, সেই মানসিকতা যেন সকলের মাঝে গড়ে ওঠে, সেটাই আমরা চাই। সোমবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ২৭তম আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস এবং ২০তম জাতীয় প্রতিবন্ধী দিবস-২০১৮ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছিল। কিছুদিন পর পরই এই আন্দোলন হয়। সেজন্য আমরা কোটা পদ্ধতি বাতিল করে দিয়েছি এটা ঠিক। তবে একটা নীতিমালা তৈরি করছি। প্রতিবন্ধী, সংখ্যালঘু নৃগোষ্ঠী বা অনগ্রসর জাতি- তারা যেন যথাযথভাবে চাকরি পায় এবং চাকরিতে তাদের অধিকার নিশ্চিত হয় নীতিমালায় সেই ব্যবস্থাটা অবশ্যই করা হবে। ১৯৯৬ সালে সরকারে আসার পর থেকেই প্রতিবন্ধীদের অধিকার সুরক্ষায় তাঁর সরকার কাজ করে যাচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানুষ হিসেবে তাদের প্রাপ্য অধিকারটা আমরা যেন দিতে পারি এবং তাদের ভেতরে যে শক্তি আছে সেটাকে আমরা যেন কাজে লাগাতে পারি, সেটাই আমাদের লক্ষ্য। তিনি বলেন, প্রতিবন্ধীদের জন্য কল্যাণ ফাউন্ডেশন তৈরি এবং তাদের মধ্যে যারা খেলাধুলায় সম্পৃক্ত তাদের বিশেষ অলিম্পিকে সম্পৃক্ত করাসহ নানা ধরনের সুযোগ আওয়ামী লীগ সরকারই করে দিয়েছিল। তারাই আমাদের স্বর্ণ জয় করে আনছে। এর মাধ্যমেই বোঝা যায় তাদের সুপ্ত প্রতিভাটা। কাজেই আমাদের দেশের কাজেও তারা লাগতে পারে। ‘সাম্য ও অভীন্ন যাত্রায় প্রতিবন্ধী মানুষের ক্ষমতায়ন’ শীর্ষক প্রতিপাদ্য েিয় সরকারের সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রী রাশেদ খান মেননের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব জিল্লার রহমান এবং জাতীয় প্রতিবন্ধী ফোরামের সভাপতি সায়েদুল হক বক্তব্য রাখেন। সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ডা. মোজাম্মেল হোসেন মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফল হওয়া প্রতিবন্ধী ও সংগঠনকদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অনুষ্ঠানের শুরুতে প্রধানমন্ত্রীকে এক প্রতিবন্ধী নিজ হাতের তৈরি প্রীতি উপহার ‘নৌকা’ তুলে দেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রীও একান্ত মনে ওই প্রতিবন্ধী নারীর কথা শোনেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগ যখনই সরকার গঠন করেছে তখনই আমরা চেষ্টা করেছি, আমাদের দেশের অবহেলিত জনগোষ্ঠী যারা, তাদের কিভাবে ভাগ্য পরিবর্তন করা যায়। আর তাদের ভিতর যে মেধা ও শক্তি রয়েছে সেগুলোকে কিভাবে কাজে লাগানো যায়। সব থেকে বড় কথা যে, আমাদের সমাজের সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতিবন্ধীদেরও একই সঙ্গে চলাফেরা ও তাদের অধিকার যেন প্রতিষ্ঠা হয় সেদিকে লক্ষ্য রেখে আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছি এবং কাজ করে যাচ্ছি। প্রতিবন্ধী দিবসে এবারের প্রতিপাদ্যের গুরুত্ব তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, প্রত্যেকটি এলাকায় আমাদের প্রতিবন্ধী যারা, যাদের একসময় অবহেলা করা হতো, যাদের মানুষ দূর দূর ছেই ছেই করত, তাদের মানুষ হিসাবেই গণ্য করা হতো না। তাদের আমরা যেন আর অবহেলা না করি। তাদের যেন আমাদের সমাজেরই একটা অংশ হিসাবে যেন আমরা তাদের পাই। মানুষ হিসাবে তাদের যে একটা অধিকার; সেই অধিকারটা আমরা যেন তাদের দিতে পারি এবং তাদের ভিতরে যে শক্তি ও মেধা আছে সেটাও যেন কাজে লাগাতে পারি। আবেগ জড়িত কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সবাই লক্ষ্য করেছেন আমাদের এক বোন, তার দুটি হাত নাই। কিন্তু পা দিয়েই কি চমৎকার একটা নৌকা তৈরি করেছে এবং আমাকে উপহার দিয়ে গেল। এই যে তার দুটি হাত নাই, তারপরও তার যে মেধা আর শক্তি; সে পা দিয়ে এই (নৌকা) জিনিসটা তৈরি করেছে। কাজেই এক্ষেত্রে আমি মনে করি তাদের অবহেলা করার সুযোগ নেই। তাই অভিন্ন যাত্রায় যেন তারা শামিল হতে পারে সেটাই আমরা করতে চাই। ১৯৯৬ সালে সরকারে আসার পর থেকে বর্তমান পর্যন্ত প্রতিবন্ধীদের অধিকার সুরক্ষায় তাঁর সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রতিবন্ধীদের সুরক্ষায় আমরা আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি। আমি দেখেছি এই প্রতিবন্ধীরাই বিভিন্ন ক্রীড়ায় অংশ নিয়ে আমাদের জন্য স্বর্ণ নিয়ে আসে। আমাদের প্রতিবন্ধী খেলোয়াড় যারা তারা সবসময় আমাদের দেশের জন্য স্বর্ণ অর্জন করে। এর থেকে বোঝা যায় তাদের ভিতরে যে সুপ্ত ক্ষমতা আছে। কাজেই তাদের আমাদের প্রস্তুত করতে হবে, যেন আমাদের দেশের কাজেও তারা লাগতে পারে। চলতি বছরে কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রসঙ্গ তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবে বারবার কিছুদিন পরপরেই আন্দোলন হয়। সেজন্য আমরা কোটা পদ্ধতি বাতিল করে দিয়েছি এটা ঠিক। তবে একটা নীতিমালা আমরা তৈরি করছি। তবে সেখানে অবশ্যই প্রতিবন্ধী, নৃগোষ্ঠী বা অনগ্রসর জাতি, তাদের সকলের যেন একটা অধিকার থাকে, তারা যেন যথাযথভাবে চাকরি পায় এবং চাকরিতে যেন তাদের একটা অধিকার বা জায়গা করে দেয়া হয়, সে ব্যবস্থাটা অবশ্যই করা হবে। সেই নীতিমালাও আমরা প্রস্তুত করে দিচ্ছি। এখন থেকে আমাদের নির্দেশ হচ্ছে যত স্থাপনা হবে প্রতিটি জায়গায় প্রতিবন্ধীদের যাতায়াতের জন্য সুযোগ-সুবিধা থাকে সেই ব্যবস্থা অবশ্যই থাকতে হবে। বিশেষ টয়লেটের ব্যবস্থাসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও অন্য সব স্থানে তাদের জন্য যেন সুযোগ-সুবিধা থাকে সেই নির্দেশনা দেয়া আছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা জানি প্রতিবন্ধীদের মধ্যে অনেক শক্তি মেধা; যেটা আমরা কাজে লাগাতে চাই। এক্ষেত্রে দুই ঈদ এবং বাংলা ও ইংরেজী নববর্ষে এবং বড়দিন উপলক্ষে তাঁর শুভেচ্ছা কার্ডে প্রতিবন্ধীদের আঁকা ছবি ব্যবহার করার বিষয়টির উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, প্রায় ১৬ লাখের ওপর প্রতিবন্ধীদের ভাতা দেয়া হচ্ছে। প্রতিবন্ধীদের যারা দেখাশোনা করে তারাও যেন আরও যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ পায় সেই ব্যবস্থাটাও করে দেয়া হচ্ছে। প্রাথমিক স্তরে ৭০০ টাকা, মাধ্যমিক স্তরে ৭৫০ টাকা এবং উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ৮৫০ টাকা আর উচ্চস্তরে যে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করছেন তাদের ১২শ’ টাকা করে ভাতা দেয়া হচ্ছে। প্রায় ২ কোটি ৪ লাখ শিক্ষার্থীকে ভাতা দেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩’ এবং ‘নিউরো ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট আইন, ২০১৩’ নামে পৃথক দুটি আইন পাস করে। ইতোমধ্যে এর বিধিমালাও প্রণয়ন করা হয়েছে। এছাড়া দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশুদের বিনামূল্যে ব্রেইল বই দেয়া হচ্ছে। জুলাই মাস থেকে প্রতিবন্ধীদের ভাতা ইলেক্ট্রনিক পদ্ধতিতে দেয়া হবে। যারা প্রতিবন্ধীদের দেখাশোনা করে, তাদের যুযোপযোগী প্রশিক্ষণ দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হবে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে জনগণকে সচেতন করা হবে। প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ ও গৃহীত কর্মসূচীর কথা তুলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা কাজ করে যাচ্ছি দেশের মানুষের কল্যাণে। আমি এইটুকু বলতে পারি যে, আমাদের কোন শ্রেণীর মানুষ অবহেলিত থাকবে না। সকলকেই মনে করতে হবে, আমাদেরই আপনজন। আমাদের অনেক বিত্তশালী মানুষ আছেন। তারাও যদি এভাবেই দেখেন। প্রতিবন্ধীদের সেবায় এগিয়ে আসেন। এই প্রতিবন্ধীদের অবহেলা করা না, বরং তাদের কিভাবে আপন করে নেয়া যায়, সেই মানসিকতা যেন সকলের মাঝে গড়ে ওঠে; সেটাই চাই।
×