ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

খাশোগি হত্যার শিকড় সৌদি রাজ পরিবারের দ্বন্দ্বে

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ৪ ডিসেম্বর ২০১৮

খাশোগি হত্যার শিকড় সৌদি রাজ পরিবারের দ্বন্দ্বে

ওয়াশিংটন পোস্টের সাংবাদিক জামাল খাশোগির নৃশংস হত্যাকা-ের পেছনে রয়েছে সৌদি রাজ পরিবারের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও ক্ষমতার লড়াই। সে লড়াইয়ে এত হিংসা, এত দ্বেষ, এত হিংস্রতা মিশে আছে যে, ভাবলে অবাক হতে হয়। এই ক্ষমতার লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে উত্থান ঘটে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের। ক্ষমতার দম্ভ তাঁকে বিকারগ্রস্ত ও বেপরোয়া করে তোলে। তাঁরই রোষানলে পড়ে প্রাণ দিতে হয়েছে খাশোগিকে। তার দেহ খ--বিখ- করে গায়েব করে দেয়া হয়েছে। রাজ পরিবারের এই ক্ষমতার লড়াইয়ের সূচনা ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে রিয়াদে এক ভিআইপি হাসপাতালের সুইটে। বাদশাহ আবদুল্লাহ সেখানে তখন মৃত্যুশয্যায়। আবদুল্লাহর পুত্ররা ও তাদের পারিষদরা বাদশাহর শেষ নিশ্বাস ত্যাগের পর মৃত্যু সংবাদটা সিংহাসনের উত্তরাধিকারী সালমানকে জানাতে একটু দেরি করেছিল। কারণটা সম্ভবত রাজ দরবারের বিপুল অর্থবিত্ত নিয়ন্ত্রণে নেয়া ও রাজ পরিবারে আবদুল্লাহ ক্লানের শক্তিশালী অবস্থান অক্ষুণœ রাখতে পারার আশায়। সৌদ রাজবংশের অভ্যন্তরে এই চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র পরবর্তী বছরগুলোতে যে কি হিংস্র রূপ ধারণ করেছিল, তার তুলনা একমাত্র গল্প-উপন্যাসেই সম্ভব। রাজ পরিবারের দুই সর্বাধিক শক্তিধর ক্লান ক্ষমতার জন্য লোলুপ হয়ে উঠে পরস্পরের ওপর যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তার ঢেউ সুদূর যুক্তরাষ্ট্র, চীন, সুইজারল্যান্ড ও অন্যান্য দেশেও পৌঁছেছিল। দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পাওয়ায় নতুন বাদশাহ সালমানের প্রিয় পুত্র মোহম্মদ বিন সালমানের পারিষদরা আবদুল্লাহ ক্লানের এক সদস্যকে বেজিংয়ে অপহরণ চেষ্টার মতো এক দুঃসাহসিক কাজও করে বসে। তার নাম ওবায়েদ। ২০১৬ সালের আগস্ট মাসে অপহরণ চেষ্টার এই নগ্ন অভিযানটি ছিল রীতিমতো স্পাই থ্রিলার কাহিনীর মতো। সফল হলে ওবায়েদের পরিণতিও হয়ত খাশোগির মতোই হতো। মোহম্মদ বিন সালমান যাদের শত্রু বলে ভাবতেন তাদের প্রতি উত্তরোত্তর আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠেন। তিনি তার নামের সংক্ষেপ এমবিএস হিসেবেই সমধিক পরিচিত। ২০১৭ সালের বসন্ত থেকে রাজ দরবারের নিয়ন্ত্রণাধীন সৌদি গোয়েন্দা এজেন্টদের একটি দল দেশে ও বিদেশে বিরুদ্ধবাদীদের অপহরণ সংঘটিত করতে শুরু করে। অপহৃতদের গোপন স্থানে আটকে রাখা হতো। তাদের এমন কৌশলে নির্যাতন করা হতো যে, যাতে তারা কথা বলতে বাধ্য হয়। তাদের শপথনামায় সই করিয়ে নেয়া হতো যে, যা কিছু ঘটেছে তার কোন কিছু প্রকাশ করা হলে চরম মূল্য দিতে হবে। খাশোগির মৃত্যুর পর থেকে বিভিন্ন সূত্র হতে এ ধরনের নানা বাস্তব কাহিনী বেরিয়ে আসে। সেগুলো জ্ঞাত সূত্রে যাচাইও করে দেখা হয়। সে সময় ক্রোধ, হিংসা, বিদ্বেষের উন্মাদনা এবং আইন ভঙ্গ ও অনিয়মের এমন এক ঘূর্ণাবর্ত সৃষ্টি হয়েছিল যে, শেষ পর্যন্ত তা খাশোগিকেও টেনে নেয়। তাই ২ অক্টোবর ইস্তানবুুলে সৌদি কনস্যুলেটে ঢোকার পর তিনি আর জীবন্ত বেরিয়ে আসতে পারেননি। অনুসন্ধানী গোয়েন্দা তথ্যে জানা যায় যে, রিয়াদের রাজ দরবার থেকে পাঠানো একটি টিম খাশোগিকে হত্যা করেছিল। এটা ছিল র‌্যাপিড এ্যাকশন বাহিনীর অংশ, যে বাহিনীকে ১৮ মাস আগে গড়ে তোলা হয়। খাশোগির উত্তেজক সাংবাদিকতা এবং কাতার ও তুরস্কের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ক্রমাবগত স্বৈরাচারী হয়ে ওঠা যুবরাজ এমবিএসকে এতই ক্ষিপ্ত করে তোলে যে, ২০১৮ সালের জুলাই মাসে তিনি ‘ওকে ফেরত নিয়ে আসো’ এমন এক নির্দেশ জারি করেন। তখন মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা বা অন্য কেউ তা বুঝতে পারেনি। সৌদি আরবে হিংস্র প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জামাতা জাবেড় কুশনারও জড়িত ছিলেন। তিনি হয়ে দাঁড়ান যুবরাজ মোহম্মদের ঘনিষ্ঠ পরামর্শক। প্রাসাদ অভ্যুত্থ্যানের আগে কুশনার ২০১৭ সালের অক্টোবরের শেষ দিকে এক বেসরকারী সফরে সৌদি আরবে গিয়ে এমবিএসের সঙ্গে দেখা করেন। কি নিয়ে তাদের আলোচনা হয়েছে কেউ তা বিশদে কিছু না বললেও ধরেই নেয়া যায় যে, রাজ পরিবারের নানা চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র নিয়ে তারা কথা বলেছেন। কুশনারের সফরের এক সপ্তাহ পর এমবিএস প্রাসাদ অভ্যুত্থান ঘটান। ২শ’রও বেশি সৌদি শাহজাদা ও ব্যবসায়ী নেতাকে কিভাবে গ্রেফতার করে রিয়াদের রিজ কার্লটন হোটেলে আটকে রাখা হয়, সে কাহিনী তো সবারই জানা। রিজ-কার্লটন হোটেলে আটকে রাখা যুবরাজ মোহম্মদের শত্রুদের তালিকার শীর্ষে ছিলেন প্রিন্স তুর্কি বিন আবদুল্লাহ। তিনি প্রয়াত বাদশাহ আবদুল্লাহর উচ্চাভিলাষী পুত্র, যিনি এর আগে এমবিএসের ত্রুটিপূর্ণ সিদ্ধান্তের ব্যাপারে তার উদ্বেগের কথা মার্কিন ও চীনা কনট্যাক্টদের কাছে জানিয়ে দিয়েছিলেন। তুর্কি এখনও বন্দী আছেন। তবে তার শীর্ষ সামরিক সহকর্মী মেজর জেনারেল আলী আল-কাহতানি গত বছর রিজ কার্লটনে আটক থাকার পর মারা যান। যুবরাজ কেন ভয় পেতেন খাশোগিকে যুবরাজ মোহম্মদ কেন খাশোগিকে এত ভয় পেতেন, যে কারণে তিনি তাকে সৌদি আরবে ফিরিয়ে আনার জন্য নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন গত গ্রীষ্মে? তার প্রতি খাশোগি এমন কি হুমকি ছিলেন, যে কারণে তাঁকে চিরতরে স্তব্ধ করে দিতে হয়েছিল? সমস্ত তদন্ত শেষ না হওয়া এবং অপরাধীদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত সে প্রশ্নের উত্তর মিলবে না। এক বিশ্লেষকের মতে, খাশোগিকে হুমকি দেয়া বা ভয়ভীতি দেখানো যেত না কিংবা নিয়ন্ত্রণ করা যেত না। স্রেফ এ কারণেই তাঁকে বিপজ্জনক হিসেবে দেখা হয়েছিল। তাঁর মন ও হৃদয় বিধিনিষেধের বেড়াজালে আবদ্ধ থাকত না। তিনি রাজতন্ত্রের নিষেধের রেখা মানতেন না। তিনি ছিলেন এক অদম্য অনুসন্ধিৎসু সাংবাদিক। এমবিএস সৌদি আরবের ব্যাপক আধুনিকায়ন ঘটাতে চাইছেন এবং সেটা করার পথে কোন রকম বিরোধিতা বা সমালোচনা বরদাশত করতে প্রস্তুত নন। খাশোগি তার এই আধুনিকায়নের উদ্যোগকে সাংবাদিকসুলভ সমালোচনার চোখে দেখতেন। খাশোগি ছিলেন আরব সাংবাদিকতার দীর্ঘ ও সাহসী ঐতিহ্যের অংশ। তিনি আরব সংবাদপত্রের স্বাধীনতার সর্বশেষ শহীদ। তুর্কি ফয়সলের সঙ্গে খাশোগির ঘনিষ্ঠতা খাশোগি হত্যায় সৌদি রাজ পরিবারের মধ্যে যারা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে, তাদের একজন শাহজাদা তুর্কি আল-ফয়সল। সৌদি এস্টাবলিশমেন্টের অন্যতম স্তম্ভ এই মানুষটি খাশোগির দীর্ঘদিনের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। সাবেক গোয়েন্দা প্রধান তুর্কি লন্ডন ও ওয়াশিংটনে রাষ্ট্রদূতও ছিলেন। তিনি রাজ পরিবারে মধ্যপন্থী অংশের অভিমত তুলে ধরে থাকতেন। খাশোগি ১৯৮৮ সালে রিয়াদভিত্তিক ‘এরাব নিউজ’-এর পক্ষে রিপোর্টিং করতে আফগানিস্তান ঘুরে আসার পর শাহজাদা তুর্কির নজরে পড়েন। তুর্কির ভাষায়, তখন নিম্ন পর্যায়েও সৌদি গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে তাঁর কোন যোগাযোগ ছিল না। খাশোগি ১৯৯০ এর দশকে ‘এরাব নিউজ’-এর সম্পাদক হলে দুজনের দেখা হয়। পরবর্তীকালে তুর্কি খাশোগির হিতকারী ও পৃষ্ঠপোষক হন। তাঁকে তিনি দুবার তার পারিবারিক মালিকানাধীন পত্রিকা ‘আল-ওয়াতান’-এর সম্পাদক পদে নিয়ে আসেন। নিজে লন্ডন ও ওয়াশিংটনে রাষ্ট্রদূত থাকাকালে খাশোগিকে মিডিয়া এডভাইজার হিসেবে নিয়ে যান। তুর্কির ভাষায়, খাশোগি সদালাপি, চমৎকার রসবোধসম্পন্ন এবং রুচিবাগীশ। চার বছর আগে ঘনিষ্ঠতায় ছেদ পড়ে দুজনের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। শোনা যায়, এর কারণ ছিল মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতি দুজনের ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি। তুর্কি বলেন, এ প্রশ্নে তিনি সর্বদা খাশোগিকে ভর্ৎসনা করে বলতেন যে, ব্রাদারহুড হলো এক অন্ধ বিশ্বাস যা উদারতাবাদের ছদ্মাবরণে আপন মতবাদ প্রচারে সন্ত্রাসী কার্যকলাপকে কাজে লাগাচ্ছে। খাশোগি সর্বদাই জবাব দিতেন যে, সে জন্যই তো আমরা ওদের সমালোচনা করি এবং পুনরুজ্জীবিত হতে বলি। উত্তরাধিকারের লড়াই সৌদি প্রাসাদ ষড়যন্ত্র ঘূর্ণিপাকের রূপ নিতে শুরু করে ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে। আগের বছর বাদশাহ আবদুল্লাহর ফুসফুসের ক্যান্সার ধরা পড়েছিল। অবস্থার অবনতি ঘটলে তাঁকে হেলিকপ্টারযোগে রিয়াদে সৌদি ন্যাশনাল গার্ড হাসপাতালে নেয়া হয় জানুয়ারিতে। চারপাশে ছিল তার পুত্র-সন্তানরা ও প্রাসাদ সহকর্মীরা। বাদশাহ কমায় চলে গেলে রাজ দরবার ব্যাপারটা চেপে যাওয়ার চেষ্টা করে। কারণ তার উত্তরসূরি কে হবেন তা নিয়ে জল্পনা চলতে থাকে। একটা সম্ভাবনা ছিল এই যে, আবদুল্লাহর পুত্র ন্যাশনাল গার্ডের প্রধান মুতাইব হবেন পরবর্তী বাদশাহ। বর্তমান বাদশাহ সালমান তখন ছিলেন যুবরাজ। তিনি হাসপাতালে আসেন ২৩ জানুয়ারি। এসেই জানতে চান ‘আমার ভাই কোথায়?’ রাজ দরবারের প্রধান ও পারিবারিক তহবিলের অভিভাবক খালেদ আল-তুওয়াইজি বলেন, ‘উনি বিশ্রাম করছেন।’ বস্তুতপক্ষে আবদুল্লাহ তার আগেই মারা গেছেন। সালমান প্রকৃত সত্যটা জানতে পেরে তুওয়াইজিকে প্রচ- চপেটাঘাত করেন। সেই শব্দ হাসপাতালের করিডরে প্রতিধ্বনিত হয়। তুওয়াইজিকে পরে ২০১৭ সালের নবেম্বরে গ্রেফতার করে রিজ কার্লটনে নেয়া হয়। আবদুল্লাহর শাসনামলে নিয়মবহির্ভূতভাবে তিনি যে অর্থ আত্মসাত করেছিলেন, তার বিরাট অংশ তার কাছ থেকে আদায় করা হয়। বর্তমানে তিনি গৃহবন্দী। যাই হোক, ২৩ জানুয়ারি ২০১৫ বাদশাহ আবদুল্লাহ মারা গেলে নতুন বাদশাহ হন সালমান। যুবরাজ করা হয় তার ভাই মুবকিন বিন আবদুল আজিজকে। কিন্তু উত্তরাধিকারের লড়াই থেমে যায়নি। তা চলতে থাকে। রাজ পরিবারের সদস্যরা একে অন্যের ওপর গুপ্তচরবৃত্তিতে লেগে যান। আবদুল্লাহর এক ছেলে অনেক সিনিয়র শাহজাদার টেলিফোনে আড়ি পাতার বিবরণ দেয়। আবদুল্লাহ শিবির চীনের তৈরি এমন এক ডিভাইস ব্যবহার করেছিল, যা দিয়ে একশ’ গজ রেডিয়াসের মধ্যে সব টেলিফোনের নম্বর শনাক্ত করা যেত। রাজনৈতিক চক্রান্ত ও আলাপ-আলোচনা জেনে নেয়ার জন্য প্রাসাদের চারদিকে ছড়ানো এ্যাসট্রে ও অন্যান্য সামগ্রীর মধ্যে নজরদারি ও আড়িপাতার যন্ত্র লুকিয়ে রাখা ছিল। রাজসভার এক পরিষদ ক্ষমতার লড়াইয়ের প্রথমদিকে বাদশাহ সালমান ও তার পুত্র মোহম্মদ বিন সালমানকে ক্ষমতা সংহত করতে সাহায্য করেছিলেন। তিনি একজন আইনজীবী ও বিমানবাহিনীর সাবেক সদস্য সৌদি আল-কাহতানি। সোশ্যাল মিডিয়া হ্যাকিংয়ে তার বেশ ঝোঁক ছিল। সালমান শিবির গোড়ার দিকে কাহতানির ব্যাপারে সন্দিগ্ধ ছিল। কারণ ২০০০ দশকের প্রথম দিক থেকে তিনি রাজ দরবারে তুওয়াইজির অন্যতম সহযোগী হিসেবে কাজ করেছিলেন। সালমানের সিংহাসন আরোহণের প্রথমদিকে কাহতানিকে জিজ্ঞাসাবাদ ও নির্যাতন করা হয়। কিন্তু পরে তিনি মোহম্মদের (এমবিএস) প্রতি নিজের আনুগত্যের প্রমাণ দেন। এর পেছনে প্রতিহিংসাও কাজ করেছিল। রাজসভার সেন্টার ফর স্টাডিজ এ্যান্ড মিডিয়া এ্যাফেয়ার্সের পরিচালক হিসেবে কাহতানি সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী ও অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্রকারীদের সম্পর্কে মোহম্মদের সন্দেহে ইন্ধন যোগাতেন। এ কাজে তিনি মোহম্মদের পক্ষে সাইবার অস্ত্রও ব্যবহার করতেন। সৌদি ও মার্কিন তদন্তকারীদের উপসংহার হলো, এমবিএসের তথ্য সম্পর্কিত কার্যক্রমের অধিনায়ক হিসেবে এই কাহতানি খাশোগি হত্যার আয়োজনে সাহায্য করেছিলেন। বাদশাহ সালমান ক্ষমতায় আসার প্রথম সপ্তাহ থেকেই কঠিন মনোভাব নিয়ে পারিবারিক রাজনীতির খেলায় নেমে পড়ে। ২০১৫ সালের জানুয়ারির শেষ দিকে রাজকীয় ফরমান বলে আবদুল্লাহর দুই পুত্র রিয়াদের গবর্নর তুর্কি ও মক্কার গবর্নর মিশালকে অপসারণ করা হয়। ঘটনাটা এমন এক ক্ষত রেখে গেছে, যা কখনই সারেনি। মোহম্মদের বয়স তখন ২৯ বছর। তাকে করা হয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী। ক্ষমতাধর সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নমনীয় স্বভাবের পুত্র মোহম্মদ বিন নায়েফকে করা হয় উপ যুবরাজ। বাদশাহ সালমান ও তদীয় পুত্র মোহম্মদ ২০১৫ সালের এপ্রিলে ক্ষমতার ওপর নিয়ন্ত্রণ আরও মজবুত করেন। মুকবিনকে সরিয়ে মোহম্মদ বিন নায়েফকে যুবরাজ করা হয়। মোহম্মদকে করা হয় উপ-যুবরাজ। এভাবে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তরাধিকারের পথে আসেন। ইতোমধ্যে মোহম্মদ ম্যাকিয়াভেলির ‘প্রিন্স’ চরিত্রে আবির্ভূত হয়েছেন। এতে তাঁকে উৎসাহ যুগিয়েছেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের উপ-যুবরাজ মোহম্মদ বিন জায়েদ এবং সে দেশের সিনিয়র গোয়েন্দা অফিসার শেখ তাহনুন। এরই মধ্যে মোহম্মদ বিন সালমান বদমেজাজি হিসেবে রিয়াদে যথেষ্ট বদনাম কুড়িয়েছিলেন। মোহম্মদ বিন সালমান সৌদি আরবকে আধুনিকায়নের আগ্রহ ব্যক্ত করে বসেন। তবে তার ভয় ছিল প্রতিদ্বন্দ্বীদের নিয়ে। যেমন আবদুল্লাহর পুত্ররা, মোহম্মদ বিন নায়েফ এবং পরবর্তীকালে অদম্য সাংবাদিক খাশোগি। আবদুল্লাহ ক্লানের সদস্যরা লক্ষ্য করছিলেন, মোহম্মদ ধীরে ধীরে ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণগুলো তাদের হাত থেকে নিয়ে নিচ্ছেন। তাই দেখা যায় ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে রিয়াদে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত জোসেফ ওয়েস্টফাল জেদ্দায় মোহম্মদ বিন নায়েফের সঙ্গে দেখা করতে গেলে এয়ারপোর্ট থেকে তাকে নায়েফের পরিবর্তে মোহম্মদের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। একই মাসে সাদ আল জাবরি নামে এক ঝানু সৌদি গোয়েন্দা কর্মকর্তা এবং নায়েফের ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা বাদশাহ সালমানকে না জানিয়ে ওয়াশিংটনে সিআইএ ডিরেক্টর জন ব্রিনানের সঙ্গে দেখা করতে যান। দেশে ফিরে এলে তাকে বরখাস্ত করা হয়। বর্তমানে তিনি প্রবাস জীবন যাপন করছেন। ২০১৬ সালের মে মাসে প্রিন্স তুর্কি বিন আবদুল্লাহ ও তার ঘনিষ্ঠতম উপদেষ্টা সৌদি ব্যবসায়ী ওবায়েদ আমেরিকায় গিয়ে সিআইএ ও পররাষ্ট্র দফতরের বেশ কয়েকজন প্রাক্তন কর্মকর্তার সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেন। তাদের সঙ্গে মেজর জেনারেল আলী আল-কাহতানিও ছিলেন। কাহতানি ছিলেন প্রিন্স তুর্কি বিন আবদুল্লাহসহ প্রয়াত বাদশাহ আবদুল্লাহর অন্যান্য পুত্রের সামরিক উপদেষ্টা ও রক্ষাকর্তা। পরের বছর প্রাসাদ অভ্যুত্থানে কাহতানি গ্রেফতার হয়ে রিজ কার্লটন হোটেলে বন্দী থাকা অবস্থায় মারা যান। যাই হোক, তাদের আমেরিকা সফরের উদ্দেশ ছিল সৌদি-মার্কিন সম্পর্কের নতুন গতি প্রকৃতি এবং সেই সঙ্গে মার্কিন প্রশাসনের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করা এবং এর পাশাপাশি তাদের পক্ষে লবিং করা। পরের মাসে অর্থাৎ জুন ২০১৬তে মোহম্মদ বিন সালমান প্রেসিডেন্ট ওবামার সঙ্গে দেখা করার জন্য ওয়াশিংটনে যান। এ সময় সৌদি রাজ পরিবারে উত্তেজনা ও টানাপোড়েন বাড়তে বাড়তে প্রবল আকার ধারণ করেছিল। এমনকি যুবরাজ নায়েফ ও উপ-যুবরাজ এমবিএস বাহ্যত এক সংঘাতের দিকে যাচ্ছিলেন। মোহম্মদ ওয়াশিংটন সফরে আসার আগ পর্যন্ত মার্কিন প্রশাসন সৌদি রাজ পরিবারের দ্বন্দ্বের প্রতি নিরপেক্ষ ভূমিকা নিয়েছিল। এরপর সেই ভূমিকা পাল্টে যায়। মোহম্মদের সংস্কার পরিকল্পনায় সন্তুষ্ট হয়ে ওবামা সরকার তার দিকে ঝুঁকে পড়ে। চলবে...
×