ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

সায়েম খান

বেদনামথিত হৃদয়ের আখ্যান

প্রকাশিত: ০৬:২৬, ২ ডিসেম্বর ২০১৮

বেদনামথিত হৃদয়ের আখ্যান

আমার অগ্রজ, এক তরুণ কবি বলেছিলেন, ‘শিল্প-সাহিত্য চর্চার জন্য মৌলিক বিষয়ের প্রয়োজন।’ আর রাজনৈতিক শিল্পের ক্ষেত্রে সেটা আরও গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দুর্ভাগ্য আর সৌভাগ্য যেটাই বলি না কেন? আমাদের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মৌলিক বিষয় নিতান্তই কম। তার মধ্যে মোটা দাগে বলতে গেলে স্পষ্টতই ধরা পড়ে দুটি বিষয়। প্রথমটি হলো মুক্তিযুদ্ধ আর দ্বিতীয়টি হলো বঙ্গবন্ধু। এটা দীর্ঘদিন ধরে বর্তমান ছিল বলে অভিমত দিয়ে তিনি বলেছিলেন, এখন আরেকটি বিষয় সেখানে যুক্ত হয়েছে। বিষয়টি হলো শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা তার কর্ম আর দর্শন দিয়ে নিজেকে এমন এক স্তরে নিয়ে গেছেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কবিতা, গল্প, উপন্যাস অনেক হয়েছে। নাটক এবং চলচ্চিত্রও যে কম হয়েছে সেটা নয়। তবে মানের হিসাব করতে গেলে মান উত্তীর্ণ কাজের সংখ্যা অতি নগণ্য। বঙ্গবন্ধুকে নিয়েও কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক রচিত হয়েছে। তার মধ্যে হাতেগোনা দুই একটি কাজ মানোত্তীর্ণ ও পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। শেখ হাসিনাকে নিয়ে কিছু কবিতা লেখা হয়েছে। গল্প, উপন্যাস আমার চোখে পড়েনি। যে কোন বিষয় উপস্থাপনার জন্য শিল্পের যে মাধ্যমটি সব থেকে বেশি শক্তিশালী সেটি হলো চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্র হলো সপ্তকলার সমাহার। এখানে যোগাযোগ স্থাপনের হাতিয়ার হিসেবে সাতটি কলা একসঙ্গে কাজ করে। তাই শিল্পের অন্যান্য মাধ্যমের ভিন্ন ভিন্ন অনুরাগী সকলে একযোগে চলচ্চিত্রের দর্শক বা পাঠক। আবার সত্তা বিচারে চলচ্চিত্র ত্রিমাত্রিক, তা কাজ করে বিজ্ঞান, শিল্প ও নান্দনিকতা নিয়ে। চলচ্চিত্রের রাজনীতি আছে, কিন্তু সব চলচ্চিত্র রাজনীতি নয়। আবার কিছু কিছু চলচ্চিত্রের ভিত্তি হয়ে ওঠে রাজনৈতিক বিষয়। চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে বিষয়টি রাজনৈতিক হলেও তাকে শিল্প (আর্ট) হয়ে ওঠাটা বেশি জরুরী। গত ১৬ নবেম্বর মুক্তি পেয়েছে শেখ হাসিনার জীবনের ওপর নির্মিত ‘ডকুড্রামা’ চলচ্চিত্র ‘হাসিনা এ্যা ডটার’স টেল। চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেছেন রেজাউর রহমান খান পিপলু। যৌথভাবে প্রযোজনা করেছে সেন্টার ফর রিসার্চ এ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই) এবং এ্যাপেলবক্স ফিল্মস। প্রধান চরিত্রে শেখ হাসিনা নিজেই উপস্থিত ছিলেন। আর পার্শ্বচরিত্রে ছিল তাঁর বোন শেখ রেহানা। প্রামাণ্যচিত্র সাধারণ দর্শকদের কাছে একঘেয়ে মনে হয়ে থাকে। কারণ, অধিকাংশ প্রামাণ্যচিত্রে গল্পটা সরলরৈখিকভাবে বলা হয়ে থাকে। প্রামাণ্যচিত্রতে দর্শকের আকর্ষণ ধরে রাখার জন্য গল্পের বয়ান নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষাটা জরুরী। সেদিক থেকে এই প্রামাণ্যচিত্রটি বয়ানে সরলরৈখিক না হয়ে আগপিছ করার মধ্য দিয়ে গেছে। চরিত্রের বয়ানের প্রেক্ষাপটে বাঁকে বাঁকে মোড় নিয়েছে চলচ্চিত্রের ভিজ্যুয়াল। চলচ্চিত্রের চরিত্র সময়কে ধারণ করে যে গল্প বলেছে পর্দায় সেই স্থানের চিত্র দর্শকের সামনে উপস্থিত হয়। যেমন- বেলজিয়ামে রাস্তার পার্শ্বচিত্র, দিল্লীতে পুরনো বাড়ি বা বাড়ির জানালা। ফ্রেমে চরিত্রের উপস্থিত না থাকার পরেও চিত্রের গতিময়তা দর্শককে গভীরভাবে অনুভূত করতে সক্ষম হয়েছে। চলচ্চিত্র তৈরিতে শটের পর শট জুড়ে দিয়ে গল্প তৈরিতে মুনশিয়ানা দেখাতে পারাটাই পরিচালকের সার্থকতা। প্রামাণ্যচিত্রের বেলা সেটা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। আর গল্পটা যদি জানাশোনা বা অধিক পরিচিত মানুষের হয় সেটা আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। এই ফিল্মটির পরিচালক সেখানে সফল। জানা গল্পটাকে অজানা করে উপস্থাপন করতে তিনি সক্ষম হয়েছেন। তাই দেখার সময় দর্শকের বিরক্ত বা একঘেয়েমি লাগেনি। শটের মধ্যে বৈচিত্র্য ছিল। চরিত্রের মুখয়বে ক্যামেরা নির্দিষ্ট না থেকে ছোট ছোট শট সন্নিবেশিত করে অন্যান্য কার্যক্রম তুলে ধরা। যেমন- শেখ হাসিনা বা শেখ রেহানা কথা বলার মধ্যে তাদের হাতের শট, পার্শ্ববর্তী কিছুর দৃশ্যায়ন। গল্পের পরিবর্তনকালীন (ট্রান্সিশনাল) সময়গুলোতে পরিচালক খুব সতর্ক ছিলেন বোঝা যায়। এসব জায়গায় আবহ সঙ্গীত ও শটের যুগলবন্দী মনে দাগ কাটার মতো। যেমন- একটা শিশু চরিত্র থেকে শেখ রাসেলের দৃশ্যায়ন। ক্যামেরায় কাজ করেছেন সাদিক আহমেদ। সম্পাদনায় ছিলেন নবনীতা সেন। নান্দনিকতার কথা যদি ধরা হয়, তাহলে আমার কাছে যে জিনিসটা আলংকারিক হিসেবে সব থেকে বেশি ভাল লেগেছে তা হলো ধানম-ির ৩২ নম্বরের সিঁড়িতে ক্যামেরা ট্র্যাক অন করে ওপরের দিকে উঠে বঙ্গবন্ধুর দেয়ালচিত্রে ধরে। আলো-আঁধারি পরিবেশ। সেখান থেকে পুনরায় ট্র্যাক অন হয়ে জানালায় প্রস্ফুটিত আলোক রশ্মি (যেখানে দর্শকের ভাবনার জায়গা রয়েছে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন এদেশের মানুষের আলোর দিশারী।) এবং গুলির শব্দের সঙ্গে সঙ্গে শটের পরিবর্তন (যেন হারিয়ে গেল সে আলো)। পরবর্তী শটে উঠে আসছেন নতুন আলোর দিশারী শেখ হাসিনা। তিনটি শটের মাধ্যমে বাঙালীর রাজনৈতিক অভিভাবকত্বের যে মেলবন্ধন ঘটানো হয়েছে। এক কথায় সেটা ছিল দারুণ। তবে কিছু কিছু জায়গায় দৃশ্য ঝুলে গেছে বা কিছু শট অপ্রয়োজনীয় মনে হয়েছে। কিছু জায়গায় ফোকাসিংয়ের দুর্বলতা ছিল। আবহ সঙ্গীতে কাজ করেছেন দেবজ্যোতি মিশ্র। আবহ সঙ্গীতে ‘আমার সাধ না মিটিল, আশা না ফুরিল’ গানটার ব্যবহার ঐতিহাসিক কারণে থাকলেও এটাকে চিত্রায়ণের সঙ্গে উপযোগী করে ব্যবহার করাটাই ছিল চ্যালেঞ্জ। সেটাতে তিনি সফল হয়েছেন বলে মনে করি। তবে কিছু জায়গায় আবহ সঙ্গীতটা একটু বেশি কর্কশ বলে মনে হয়েছে। শেখ হাসিনাকে একটি সংলাপে বলতে শুনি, ‘বাংলার মানুষের যে ভালবাসা সেটা তো অতুলনীয়।’ বাঙালীর ভালবাসার স্বীকৃতি দিতে যেন বঙ্গবন্ধুর জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। সর্বশেষ বলতে চাই, এই ডকু ফিল্মটিই এখন একটি ডকুমেন্ট। এটি ইতিহাসের আকরে ডকুমেন্ট হিসেবে থাকবে। যেখানে একটি জানা গল্পকে ঐতিহাসিক তথ্যপ্রমাণ দিয়ে নতুনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। লেখক : রাজনৈতিক কর্মী
×