ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আবৃত্তি প্রযোজনা- ঘুম নেই অতঃপর

রণাঙ্গন থেকে দেখা মুক্তিযুদ্ধ, অশ্রুসজল সমকাল

প্রকাশিত: ০৬:১৩, ২ ডিসেম্বর ২০১৮

রণাঙ্গন থেকে দেখা মুক্তিযুদ্ধ, অশ্রুসজল সমকাল

মোরসালিন মিজান ॥ সেই পুরনো ক্ষত। প্রাচীন বেদনা। বোবা কান্না। অপ্রাপ্তি। বার বার ফেলা সেই দীর্ঘশ্বাস। নতুন করে সামনে এলো। কী দরকার ছিল? বুকের ভেতরে যে হাহাকার, কবে থেকেই তো আছে। থাক না। আবার কেন জাগিয়ে তোলার চেষ্টা? স্বরব্যঞ্জন ঠিক তা-ই করল। আবৃত্তি সংগঠনটির নতুন প্রযোজনা ‘ঘুম নেই অতঃপর’ দেখে আবারও হাহাকার করে উঠল বুক। শনিবার শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটার হলে মঞ্চস্থ হওয়া আবৃত্তি প্রযোজনা ফিরিয়ে নিয়ে গেল একাত্তরে। জীবন বাজি রেখে লড়াই করা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চাওয়া এবং পাওয়ার হিসাবটি মেলানোর চেষ্টা হলো। এ হিসাব কোনদিন মেলেনি। এবারও মিলল না। তবে মেলাতে যে হবে। হবেই। এ প্রত্যয়ের কথা জানিয়ে দিয়ে গেল। অপেক্ষাকৃত নবীনদের একটি দল ছিল মঞ্চে। সে তুলনায় চমৎকার আবৃত্তি। আর নেপথ্যের মানুষটি হাসান আরিফ। দুটি সময়কে মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন নির্দেশক। একাত্তর খুঁজে নিয়েছেন শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ডায়েরির পাতা থেকে। রিয়ালিস্টিক করতেই হয়ত ‘একাত্তরের দিনগুলি।’ অভিন্ন ভাবনা থেকে বেছে নিয়েছেন গেরিলা যোদ্ধা নাসির উদ্দীন ইউসুফের ‘ঘুম নেই অতঃপর’ বইটি। দুই বইয়ের আশ্রয়ে একাত্তরকে তুলে ধরা হয়েছে। এসবের মধ্য দিয়ে যে চাওয়ার সৃষ্টি হয় তার সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে সমকালকে। তখনই সংঘাতগুলো বড় দাগে সামনে আসে। হাসান আরিফ নিজের ভেতরে যে আবেগ, যে আগুন পুষে রাখেন তার পুরোটাই ঢেলে দিয়েছেন। চোখ তাই ভিজে ওঠে। প্রযোজনাটি নিয়ে মঞ্চে ছিলেন সাত আবৃত্তিশিল্পী। দীপক ঘোষ, মনিরুল ইসলাম, সাবিহা সেতু, তন্ময় করিম, সৈয়দ আশিক, পংকজ পা-ে ও কানিজ হৃদি। সবাই মিলে গল্প এগিয়ে নিয়ে যান। গল্প বলা হচ্ছে বটে। গল্প এটি নয়। বস্তুত ইতিহাস থেকে পাঠ। বর্ণনা। মঞ্চের আলোয় নিজস্ব রঙটি অবিকৃত ছিল। এতকাল পরও তাই মুক্তিযুদ্ধকে ফিল করা গেছে। সাধারণত রণাঙ্গন থেকে মুক্তিযুদ্ধকে দেখানো হয় না। সে সক্ষমতা আমরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অর্জন করতে পারিনি। কারা যুদ্ধ করেছিলেন? কেমন ছিল আসলে যুদ্ধটা? দক্ষ-প্রশিক্ষিত পাকিস্তানী আর্মির সামনে অস্ত্র হাতে লড়াই। এ সাহস কী করে অর্জন করেছিল বাঙালী? বিজয় এলো কীভাবে? অনেক প্রশ্ন। আজকের বাংলাদেশে এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজাকে পরিশ্রমের মনে হয়। সেদিকে যায় না। বৃত্তবন্দী অবস্থা থেকে দর্শককে টেনে বের করে আনে ‘ঘুম নেই অতঃপর।’ রণাঙ্গনে নিয়ে যায়। তখন চোখের সামনেই যেন ভেসে ওঠে যুদ্ধটা। দেশকে শত্রুমুক্ত করার লক্ষ্যে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়ে যান মুক্তিযোদ্ধারা। পাকিস্তানী বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ে। আবার পাল্টা আঘাতে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায় শরীর। বাংলা মায়ের সবুজে মিশে যায় মুক্তিযোদ্ধার লাল রক্ত। শহর ঢাকার দুর্ধর্ষ গেরিলা রুমি ধরা পড়ে যায় পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে। আহা! সেই মুহূর্তটি যেন চোখের সামনে দৃশ্যমান করেন আবৃত্তি শিল্পীরা। বুক ধক্ করে ওঠে। মনে মনে দর্শক প্রার্থনা করতে থাকেন, এই বীর তরুণকে বর্বরদের হাত থেকে রক্ষা করো। নাসির উদ্দীন ইউসুফের বর্ণনা থেকে পাওয়া হয় গুলি চালাতে চালাতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া একাধিক মুক্তিযোদ্ধাকে। মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সুনির্দিষ্ট দাবি তুলে ধরা হয়েছিল। বাঙালীর মনের চাওয়াগুলো পরিষ্কার করা হয়েছিল। সুদীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পাওয়া রাষ্ট্রীয় কাঠামোটি কেমন হবে? কোন্ চেতনার হবে? কার পাশে দাঁড়াবে রাষ্ট্র? সব চূড়ান্ত হবার পরই যুদ্ধে যাওয়া। অথচ পরবর্তিতে সবই কেমন যেন উল্টে গেল। উল্টে যেতে লাগল। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ হলো না। মুক্তিযোদ্ধাদের বাংলাদেশ হলো না। অর্জনগুলো ব্যর্থ হতে লাগল। এ অবস্থায় নতুন যুদ্ধ শুরু করেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। শেষদিন পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে এক থাকার আহ্বান জানান তিনি। মঞ্চ থেকে শোনানো হয় সে আহ্বান। স্বাধীনতা বিরোধীদের গাড়ি থেকে পতাকা খসে পড়েছে। বিচার হয়েছে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের। এর পরও ঘুম নেই। কারণ মুক্তিযুদ্ধকে সূচক ধরলে এখনও অনেক কিছু অর্জন করা বাকি। ভুল পথে চলা রাষ্ট্রটি এখনও মূল ট্যাকে ওঠেনি। অযুত বাধা। বাধা ডিঙিয়ে মুক্তিযুদ্ধের হতে হবে বাংলাদেশকে। এ কথাই বলে যায় ‘ঘুম নেই অতঃপর।’
×