‘দশে মিলে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ’-প্রবাদটি সর্বকালে সর্বদেশে জীবনের অনষঙ্গ বলা যায়। সমন্বিত প্রচেষ্টা যে কোন কঠিন বা ভারি কাজকেও করে দেয় সহজ। একক প্রচেষ্টায় যা সম্ভব নয়, সম্মিলিত উদ্যোগে তা অনায়াসে করা যায়। সমন্বিত এই প্রচেষ্টার ভিত্তি হচ্ছে সমবায়। বাংলাদেশে সমবায় আন্দোলন দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে। প্রাতিষ্ঠানিক রূপও লাভ করেছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি সাফল্য এনে দিয়েছে। কৃষি ক্ষেত্রে সমবায় পদ্ধতি ব্যাপক প্রচলিত বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে। দেশের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে সমবায় একটি পরীক্ষিত কৌশল। বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রচেষ্টায় সমবায়ের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য এই পদ্ধতি দেশের কৃষিক্ষেত্রে সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়া গেলে তার সুফল মিলবে অনায়াসে। দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হলে সমবায় পদ্ধতি গুরুত্বপূর্ণ। নেতৃত্ব সৃষ্টি, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সমবায়ের গুরুত্ব অপরিসীম। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং নারীর ক্ষমতায়নের জন্য সমবায়ের সঙ্গে অধিক হারে তাই নারীদের সম্পৃক্ত করা সঙ্গত। সমবায় প্রথার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তোলা, কৃষিখাত ও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার জন্য তিনি সমবায় প্রথাকে সামনে তুলে আনেন। সত্তরের নির্বাচনী ইশতেহারেও সমবায় পদ্ধতি চালুর উদ্যোগের কথা বলা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর বাকশাল কর্মসূচীর গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল এই সমবায়। সমবায়ের ভিত্তিতে চাষাবাদের জন্য জমির ‘সিলিং’ নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশের জমি এত উর্বর যে বীজ ফেললেই গাছ হয়। গাছ হলে ফল হয়। সে দেশের মানুষ কেন ক্ষুধার জ্বালায় কষ্ট পাবে?’ তাই তিনি এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদী না রাখার ঘোষণা দিয়েছিলেন। একালে তার সুযোগ্য কন্যা চাইছেন, দেশের মানুষকে যেহেতু খাদ্য নিরাপত্তা দিতে হবে, তাই লক্ষ্য রাখতে হবে জমি যেন অনাবাদী না থাকে। যারা গ্রামে থাকেন না, সেই জমিগুলো উৎপাদনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য শেখ হাসিনা পরামর্শ দিয়েছেন। এতে মালিক যেমন তার অংশ পাবেন, তেমনি বেশি অংশ পাবেন যারা শ্রম দিচ্ছে তারা। আর রক্ষণাবেক্ষণ এবং কৃষি উপকরণ সরবরাহকারী সমবায় পাবে একটি অংশ। এভাবে একটি নীতিমালা তৈরি করে সমস্ত জমি চাষ বা উৎপাদন বাড়ানো গেলে দেশে আর খাদ্যাভাব হবে না। একমাত্র সমবায়ের মাধ্যমে দ্রুত উন্নয়ন করা সম্ভব বলেই বঙ্গবন্ধু সমবায়কে সংবিধানের অর্থনৈতিক নীতিমালায় সংযুক্ত করেছেন ১৩ অনুচ্ছেদে। অনুরূপ বাকশালের অর্থনৈতিক কার্যসূচীতেও বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করেন। সমবায় ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন পূরণের হাতিয়ার। কৃষি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, শিল্পোদ্যোগ, কৃষি ঋণসহ সবক্ষেত্রেই সমবায়ভিত্তিক উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থাপনা প্রসারিত করতে চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু মালিকানার দ্বিতীয় খাত হিসেবে সমবায়কে স্থান দিয়েছিলেন সংবিধানের ১৩ অনুচ্ছেদে। তিনি কৃষি সমবায় সমিতি, মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি, তাঁতি সমবায় সমিতি ও শিল্প সমবায় সমিতি গড়ে তুলেছিলেন। দেশের অন্যতম সমবায়ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান মিল্কভিটা বঙ্গবন্ধুর হাতেই গড়া। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় এক লাখ ৭৪ হাজার সমবায় সমিতি রয়েছে। যার সদস্য সংখ্যা এক কোটি নয় লাখ এবং মোট কার্যকরী মূলধনের পরিমাণ ১৩ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা। ২০২১ সালে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে যাচ্ছে। এই উন্নয়নের যাত্রায় সমবায় পদ্ধতি সুফল এনে দিতে পারে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে ও খাতে সমবায় পদ্ধতি চালু করা গেলে মানবসম্পদকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো সম্ভব হবে। তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়ন ও বিস্তারের এই কালে সমন্বিত উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা যুগান্তকারী ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে। সমবায়ভিত্তিক চাষাবাদ শুধু নয়, কুটির শিল্প, কারিগরি শিল্প, হস্ত ও বুনন শিল্পকেও করা যায় সমৃদ্ধতর। সমবায়ভিত্তিক নীতিমালাকে যুগোপযোগী করা গেলে দেশ উন্নতির ক্ষেত্রে আরও অনেক ধাপ এগিয়ে যেতে পারে।
শীর্ষ সংবাদ: