ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

পুলিশের ওপর হামলার পরিকল্পনা হয় লন্ডনে

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ১৮ নভেম্বর ২০১৮

পুলিশের ওপর হামলার পরিকল্পনা হয় লন্ডনে

শংকর কুমার দে ॥ রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের আশপাশে ১৪ নবেম্বর সহিংস সন্ত্রাসের তা-ব চালিয়ে কর্তব্যরত পুলিশের ওপর হামলা করে হত্যাকা- ঘটিয়ে দেশে অস্থিতিশীল ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টির মাধ্যমে নির্বাচন বানচাল করাই ছিল সহিংস বিএনপি নেতা কর্মীদের উদ্দেশ্য বা মোটিভ। এই ঘটনায় গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে এই ধরনের তথ্য মিলেছে বলে তদন্তকারী পুলিশের দাবি। এই সহিংস সন্ত্রাসের ঘটনার পরিকল্পনা হয় লন্ডনে এবং লন্ডনে স্বেচ্ছা নির্বাসনে থেকে নির্দেশদান ও মদদদান করার মাস্টারমাইন্ড হচ্ছেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সাজাপ্রাপ্ত তারেক রহমান। তারেক রহমানের নির্দেশে ও মদদে বিএনপির যেসব নেতা সহিংস সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটিয়েছেন তারা হচ্ছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা মির্জা আব্বাস উদ্দিন আহমেদ, রুহুল কবির রিজভী, আফরোজা আব্বাস, নবীউল্লাহ নবী, মেজর (অব) আক্তারুজ্জামান ও কফিল উদ্দিন এই ৬ জনসহ গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। বিএনপির সিনিয়র এই ৬ নেতা পলাতক। মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়েছে, পরিকল্পিতভাবে মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে রাস্তায় দাঙ্গা করে পুলিশকে হত্যার উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে পুলিশের সরকারী কাজে বাধা দিয়ে আক্রমণ করে পুলিশের ওপর ইটপাটকেল, ককটেল, বোমা নিক্ষেপ করে মারাত্মক জখম করে পুলিশের গাড়িতে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ক্ষতি সাধন করার অপরাধ করা হয়েছে। পুলিশের দায়ের করা মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কোটি টাকার বেশি। ঢাকা মহানগর পুলিশ ও পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) সূত্রে এ খবর জানা গেছে। ঢাকা মহানগর পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর পল্টন থানায় দায়ের করা তিনটি মামলাই তদন্তের জন্য তদন্তভার ন্যস্ত করা হয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখায় (ডিবি)। পল্টন থানায় এই ঘটনায় দায়ের করা তিনটি মামলায় গ্রেফতার হওয়া ৭২ জনের মধ্যে ৪৫ জনকে ৫ দিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। পাঁচ দিনের রিমান্ডে এনে যাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে তাদের মধ্যে রয়েছেন, নিপুন রায় চৌধুরী, সাবেক ছাত্রদল নেতা মনোজ সরকার, নেত্রকোনা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট খালিদ সাইফুল্লাহ, ছাত্রদল নেতা ফাহিম হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদল নেতা মশিউর রহমান, ছাত্রদল নেতা উৎপল সরকার, বিএনপি নেতা সুফিয়ান, জাকির হোসেন, হানিফ উদ্দিন ওরফে রানা, ঢাবির মহসিন হল শাখা ছাত্রদল নেতা মাহবুব মিয়া, আনিসুর রহমান, ছাত্রদলের সহ-স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডাঃ আতিকুর রহমান তালুকদার, মাইনুল হাসান মোহন, আনোয়ারুল হক ও মোহাম্মদ সুরুজ ম-ল। এ ছাড়া ২৭ জনকে জেল গেটে ৩ কার্যদিবস জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ভিডিও ফুটেজ দেখে গ্রেফতার করা হয় সাতজনকে। বিএনপি অফিসের এলাকায় যত সিসি ক্যামেরা আছে তার সবগুলোরই ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করেছে পুলিশ। এ ছাড়াও টিভি চ্যানেল ও সংবাদ মাধ্যমে যেসব ভিডিও ফুটেজ ও ছবি প্রকাশ করা হয়েছে পুলিশ তা সংগ্রহ করে গ্রেফতারকৃতদের ও পলাতকদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য, প্রমাণ, আলামত সংগ্রহ করা হচ্ছে। মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়েছে, নির্বাচন কমিশন কর্তৃক জারিকৃত নির্র্বাচন আচরণবিধিতে ব্যান্ডপার্টি, ব্যানার, ফেস্টুন নিয়ে শোডাউন করার নিষেধাজ্ঞা আছে। নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও প্রথম বিএনপি নেত্রী আফরোজা আব্বাসের নেতৃত্বে একটি মিছিল ফকিরাপুল দিক থেকে ব্যান্ডপার্টি ব্যানার ফেস্টুন নিয়ে শোডাউন করে বিএনপি কার্যালয়ে আসে। অতঃপর নবীউল্লাহ নবী ও কফিল উদ্দিনের নেতৃত্বে অপর দুটি মিছিল শোডাউন করে ব্যানার, ফেস্টুন, ব্যান্ডপার্টি নিয়ে পল্টনের বিএনপির কার্যালয়ে আসতে থাকে। সর্বশেষ মির্জা আব্বাসের নেতৃত্বে আট থেকে দশ হাজার জনের একটি মিছিল ব্যানার, ফেস্টুন, ব্যান্ডপার্টি নিয়ে শোডাউন করে নয়াপল্টনের বিএনপি অফিসে আসে। তারা নয়াপল্টনের ভিআইপি রোড বন্ধ করে মিছিল, শোডাউন করে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দিয়ে জনদুর্ভোগের সৃষ্টি করলে রাস্তার এক লেন ব্যবহার করে যানবাহন চলাচল স্বাভবিক ও জনদুর্ভোগ লাঘবের জন্য অনুরোধ করে পুলিশ। এতে পুলিশের প্রতি ক্ষিপ্ত হয় বিএনপির নেতা-কর্মীরা। বিএনপির অফিসে অবস্থারত রুহুল কবীর রিজভীসহ সিনিয়র নেতৃবৃন্দকে পুলিশের পক্ষ থেকে অবহিত করে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের জন্য অনুরোধ জানানো হয়। মামলার এজাহারে বলা হয়, পুলিশের অনুরোধ জানানো সত্ত্বেও পূর্বপরিকল্পিতভাবে মির্জা আব্বাসের নেতৃত্বে বিএনপির পার্টি অফিস থেকে লাঠিসোটা নিয়ে পুলিশের ওপর হামলা গাড়ি ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ করে সরকারী ও মানুষজনের সম্পদের ক্ষতি সাধন করা হয়। তারা সরকার বিরোধী বিভিন্ন সেøাগান দিয়ে পুলিশের ওপর হামলা ছাড়াও পুলিশে গাড়ি পুড়িয়ে দেয়। কর্তব্যরত পুলিশ দলকে অবরুদ্ধ করে ফেলার পর আত্মরক্ষার্থে বেতার যন্ত্রের মাধ্যমে আরও পুলিশ দল মোতায়েনের বার্তা পাঠানোর সময়ে বিএনপির নেতা-কর্মীরা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে হামলা চালায়। পুলিশ আত্মরক্ষার্থে লাঠিচার্জ, টিয়ারগ্যাস ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে অবৈধ সমাবেশ ছত্র ভঙ্গ করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, পুলিশের ওপর হামলায় জড়িত বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের পুত্রবধূ বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা নিপুন রায় চৌধুরীসহ যে ৭২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। রাজধানীর পল্টন থানায় দায়ের করা তিনটি মামলায় বিএনপির সিনিয়র নেতাসহ আসামি করা হয়েছে ৪৮৮ জনকে। গ্রেফতারকৃতদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ জানতে পেরেছে, লন্ডনে স্বেচ্ছা নির্বাচনে সাজাপ্রাপ্ত আসামি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানই মূলত লন্ডনে বসে পুলিশের ওপর হামলার পরিকল্পনা করেন। তারেক রহমানের নির্দেশে মির্জা আব্বাস উদ্দিন আহমেদ, রুহুর কবির রিজভী, আফরোজা আব্বাস, নবীউল্লাহ নবী, মেজর (অব) আক্তারুজ্জামান, কফিল উদ্দিন এই ৬ জনসহ সিনিয়র নেতাদের নেতৃত্বে পুলিশের ওপর হামলা, পুলিশের গাড়িতে আগুন, ভাংচুর করে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানো হয়। পুলিশের ওপর হামলার সময়ে পুলিশ হত্যা করে দেশে অস্থিতিশীল ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা গেলে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পেছাতে বাধ্য হবে নির্বাচন কমিশন। লন্ডনে বসে তারেক রহমান নির্র্বাচন বানচালের জন্য সহিংস সন্ত্রাসের মাধ্যমে পুলিশ হত্যার যে ছক কষেছিল তা পুলিশের উর্ধতন কর্তৃপক্ষের বিচক্ষণতায় ভেস্তে গেছে বলে পুলিশের দাবি। ঢাকা মহানগর পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, বিএনপি অফিসের সামনে মনোনয়ন পত্র জমা দিতে আসা হাজার হাজার বিএনপির নেতা-কর্মী সংঘবদ্ধ হয়ে পুলিশের ওপর হামলা, গাড়িতে আগুন, ভাংচুরের ঘটনার তদন্তে দেখা যাচ্ছে, আগে থেকেই তারা লাঠিসোটা, ইটপাটকেল, পেট্রোল, বোমা মজুদ করে রেখেছিল, যা ঘটনার সময়ে ব্যবহার করা হয়েছে মাত্র। এতেই প্রমাণিত ঘটনাটি ছিল পূর্বপরিকল্পিত। মূূলত ইস্যু তৈরির করার জন্যই পরিকল্পিতভাবে হামলাটি করা হয়েছে। জননিরাপত্তা বিঘিœত করে দেশে একটি ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতেই এমন মারাত্মক হামলা চালানো হয়েছে বলে মনে করেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই পুলিশ কর্মকর্তা। ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া বিভাগের উপ-কমিশনার মাসুদুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, হামলার ঘটনায় প্রচুর সিসি ক্যামেরা, তাদের নিজস্ব ক্যামেরা ও মিডিয়ার ক্যামেরার ফুটেজ এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ পাওয়া নানা ছবির পর্যালোচনা চলছে। রিমান্ডে আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। পুরো বিষয়টি গভীরভাবে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। অন্য আসামিদের শনাক্ত ও গ্রেফতার করতে বিশেষ অভিযান চলছে। গত ১৪ নবেম্বর নয়াপল্টনে বিএনপি কার্যালয়ের সামনে পুলিশ ও নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষে পুলিশ কর্মকর্তাসহ ৩০ জন পুলিশ সদস্য আহত হন। ওইদিন সবমিলিয়ে অর্ধশত মানুষ আহত হন। যারা পলাতক আছেন তাদেরকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
×