ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

দলের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত ॥ ‘যাকেই মনোনয়ন দেব, আপনাদের মেনে নিতে হবে’

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ১৫ নভেম্বর ২০১৮

দলের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত ॥ ‘যাকেই মনোনয়ন দেব, আপনাদের মেনে নিতে হবে’

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ আগামী চ্যালেঞ্জের নির্বাচনে দল যাকেই মনোনয়ন দেবে, তাকে মেনেই নিয়েই ঐক্যবদ্ধভাবে নৌকার বিজয়ে কাজ করার অঙ্গীকার করলেন আওয়ামী লীগের চার সহস্রাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশী। প্রধানমন্ত্রী ও দলের সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি যাকেই মনোনয়ন দেব, তাকেই আপনাদের মেনে নিতে হবে। আপনারা কথা দেন, দেশের বৃহত্তর স্বার্থে দলের সিদ্ধান্ত মেনে নেবেন কিনা।’ এ সময় মনোনয়ন প্রত্যাশীরা নিজ আসন থেকে দাঁড়িয়ে দু’হাত তুলে দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে নেয়ার অঙ্গীকারের কথা জানান। বুধবার গণভবনে মনোনয়ন প্রত্যাশীরা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সৌজন্য সাক্ষাত ও দোয়া নিতে গেলে তাদের উদ্দেশে দিক-নির্দেশনামূলক বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী সবার কাছ থেকে এমন অঙ্গীকার নেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সতর্ক করে দিয়ে বলেন, বিএনপির দাবির মুখে নির্বাচনের তারিখ পেছালেও তারা আবারও পেছানোর দাবি তুলেছে। এটার পেছনে নিশ্চয়ই ষড়যন্ত্র রয়েছে। তারা কখন নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ায়, তারও ঠিক নেই। এর আগেও তারা এটি করেছে। তাই সাবধান থাকবেন, বিএনপি যেন দেশের জন্য ক্ষতিকর কিছু করতে না পারে। আবারও জ্বালাও-পোড়াও করতে না পারে। আর সবার প্রতি অনুরোধ, নিজেদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তিকে ক্ষমতায় আসার পথ সুগম করে দেবেন না। একাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশী সূত্রে জানা গেছে, আগামী নির্বাচনকে দলের জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে এই নির্বাচন কোন অবস্থাতেই অবহেলার চোখে না দেখার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে। ক্ষমতায় আছেন, তাই এমনিতেই ক্ষমতায় চলে আসবেন- এমনটা ভাববেন না। জনগণের কাছে যেতে হবে, তাদের মনজয় করতে হবে। ঘরে ঘরে গিয়ে নৌকার পক্ষে ভোট চাইতে হবে। কোন রকম অবহেলা করলে ১৯৯১ ও ২০০১ সালের নির্বাচনের মতো হারতে হতে পারে। মনে রাখবেন, আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ থাকলে পৃথিবীর কোন শক্তি আমাদের হারাতে পারবে না। তাই দল যাকে মনোনয়ন দেবে তার পক্ষেই ঐক্যবদ্ধ থেকে নৌকার বিজয় নিশ্চিত করতে হবে। সৌজন্য সাক্ষাতের এই অনুষ্ঠানে সূচনা বক্তব্যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের উদ্দেশ্য করে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে কেউ যদি দলের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেন, দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে দল মনোনীত প্রার্থীর বিপক্ষে কাজ করেন তবে এবার আর রক্ষা নেই। তদন্ত করে সঙ্গে সঙ্গে জড়িতদের দল থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হবে। তাদের আর কোনদিন দলে ফিরিয়ে নেয়া হবে না। দলের জন্য ক্ষতিকারক কাউকেই আর ছাড় দেয়া হবে না। সকাল থেকেই প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবনে আসতে থাকেন দলের মনোনয়ন প্রত্যাশীরা। লক্ষ্য আগামী নির্বাচন সামনে রেখে দলীয় প্রধানের সঙ্গে সাক্ষাত এবং দোয়া গ্রহণ করা। এদিন দলের ৪০২৩ জন মনোনয়ন প্রত্যাশীর সিংহভাগই তাঁর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে এলে তাদের উদ্দেশে নানা দিক-নির্দেশনাও দেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। আর চার সহস্রাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশীর পদভারে মুখরিত ছিল প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবন। আওয়ামী পরিবারের এই মিলনমেলায় কয়েক দফায় হাত তুলে এবং সেøাগান দিয়ে ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধভাবে দলের পক্ষে করার দৃঢ় অঙ্গীকারও ব্যক্ত করেন। নৌকা প্রতীকে যাকেই প্রার্থী করা হবে, তার পক্ষেই কাজ করার জন্য সব মনোনয়ন প্রত্যাশীকে নির্দেশ দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, এবার দলের মধ্যে প্রার্থী অনেক। কিন্তু আসন সংখ্যা সীমিত। একটি আসনে একজনকেই প্রার্থী করা যাবে, বাকিদের মনোনয়ন দেয়া সম্ভব হবে না। মনোনয়ন প্রত্যাশীরা সবাই যোগ্য ও দলের ত্যাগী নেতা। কিন্তু একটি আসনে তো একজনই মনোনয়ন পাবেন, দু’জনকে তো আর দিতে পারব না। তবে যাকেই মনোনয়ন দেয়া হবে- মতবিরোধ ভুলে সবাইকে তার পক্ষেই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। এ সময় তিনি আক্ষেপ করে বলেন, একটি আসনে দল থেকে ৫২ প্রার্থী হয়েছেন। আবার কোথাও ৩০, কোথাও ২০ আবারও কোথাও কোথাও ১০-১৫ জনও দাঁড়িয়ে গেছেন। এটি অশুভ লক্ষণ। এটা নিশ্চয়ই ওসব এলাকার নেতৃত্বের ব্যর্থতা। ওই এলাকার নেতৃত্বে থাকা নেতা-এমপিরা সবাইকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন। না হলে এতজন প্রার্থী হন কীভাবে? এসব আসনে যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে উঠছে না। তাই আপনারা যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে তুলুন, বিভেদে জড়াবেন না। বৈঠক শেষে মনোনয়ন প্রত্যাশীরা জানান, সূচনা বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী মনোনয়ন প্রত্যাশীদের উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আমি সবার সম্পর্কে জানি। আপনাদের সব তথ্য আমাদের কাছে আছে। কারা কি করেছেন, কারা কোন দল থেকে এসেছেন, গত দুই টার্মে নিজ নির্বাচনী এলাকায় কে কী করেছেন আমি সব জানি। তাই বেশি লাফালাফির দরকার নেই, কোন গ্রুপিংয়েরও দরকার নেই। দলের অনেক বড় নেতা রয়েছেন, জরিপে দেখা গেছে তিনি এলাকার জনগণের সঙ্গে নেই। যিনি জনগণের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন, তাকে আমরা এবার মনোনয়ন দেব না। বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জরিপ সংস্থা এবং দলীয়ভাবে দফায় দফায় করা তিন শ’ আসনের জরিপ রিপোর্ট তাঁর হাতে থাকার কথা তুলে ধরে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, সবার তথ্য আমার কাছে আছে। এবার দেখেশুনে যোগ্য, জনপ্রিয় ও জিততে সক্ষম প্রার্থীদেরই দলের মনোনয়ন দেয়া হবে। এ সংক্রান্ত দল ও দেশী-বিদেশী বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে পরিচালিত জরিপ প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ও যাচাই-বাছাই করেই প্রার্থী করা হবে। জোট-মহাজোটের প্রার্থীদেরও একই প্রক্রিয়ায় মনোনয়ন দেয়া হবে। যাকে প্রার্থী করা করা হবে, তার পক্ষেই দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী সবাইকে ছাড় দিতে হবে। আর প্রার্থী হিসেবে ব্যক্তিকে দেখার দরকার নেই, আপনারা নৌকার দিকে তাকিয়ে আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করতে কাজ করবেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী দেশ ও দলের বৃহত্তর স্বার্থে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট-মহাজোটের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ নির্বাচনের ক্ষেত্রে অনেক যোগ্য প্রার্থীকেও ছাড় দিতে হতে পারে এমন কথা উল্লেখ করে বলেন, নির্বাচনে আমাদের জোট-মহাজোট রয়েছে। জয়লাভের স্বার্থে তাদেরকেও অনেক আসনে ছাড় দিতে হবে। এক্ষেত্রেও ওইসব আসনে দলীয় প্রার্র্থী যারা থাকবেন, তাদের দলের বৃহত্তর স্বার্থে প্রার্থিতা থেকে সরে দাঁড়াতে হবে। মহাজোট প্রার্থীদের পক্ষে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। বৈঠক সূত্র জানায়, মনোনয়ন প্রত্যাশী ও দলীয় প্রার্থীদের জয়লাভের ব্যাপারে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী না হওয়ার পরামর্শ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন পেয়েছেন বলেই জিতে গেছেন- এমনটি ভাববেন না। মানুষের কাছে যেতে হবে, তাদের কাছে সরকারের উন্নয়ন কর্মকা- তুলে ধরতে হবে। ভালবাসা দিয়েই তাদের ভোট আদায় করতে হবে। মনে রাখতে হবে, অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের কারণেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও ১৯৯১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে হারতে হয়েছিল। এ বিষয়ে শেখ হাসিনা আরও বলেন, আপনারা সবাই যদি ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ না করেন, তাহলে বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্বাচনে সবার দায়িত্ব নিতে পারব না। এবার নেত্রীকে বেটে খাওয়ালেও কাজ হবে না। আমরা আগামী নির্বাচন নিয়ে কাজ করছি না, আমরা কাজ করছি আগামী প্রজন্ম নিয়ে। তিনি এ সময় বর্তমান সরকারের টানা দুই মেয়াদে দেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে নিয়ে যাওয়া, সারাদেশের ব্যাপক উন্নয়ন ও অগ্রগতির সার্বিক চিত্র মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সামনে তুলে ধরেন। এ সময় সবাইকে সজাগ ও সতর্ক করে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা দেশকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে ১০টি মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়ন করছি। উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষায় আগামী নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আসতে পারলে আমরা এসব প্রকল্পের কাজ শেষ করতে পারব। কিন্তু বিএনপি-জামায়াতসহ স্বাধীনতাবিরোধী যদি ক্ষমতায় আসে সব প্রকল্প বন্ধ করে দেবে, দেশকে আবার অন্ধকারে ঠেলে দেবে। হত্যা-সন্ত্রাস-দুর্নীতি-দুঃশাসন আবার ফিরে আসবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস করে দেবে। মনে রাখবেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীশক্তি এক সঙ্গে ষড়যন্ত্রে নেমেছে। তাই নিজেদের মধ্যে ভেদাভেদ সৃষ্টি করে ওই বিরোধী শক্তিকে ক্ষমতায় আসার পথ সুগম করে দেবেন না। তাই সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে বিজয়ী করতে হবে। সৌজন্য সাক্ষাত শেষে বেরিয়ে মনোনয়ন প্রত্যাশীরা আরও জানান, প্রধানমন্ত্রী ঢাকায় বসে না থেকে সবাইকে নিজ নিজ আসনে ফিরে গিয়ে প্রতিটি ভোটারের ঘরে ঘরে গিয়ে নৌকায় ভোট প্রার্থনা, টানা ১০ বছরের উন্নয়ন-সফলতাগুলো তাদের সামনে তুলে ধরা এবং বিএনপি-জামায়াত জোটের অগ্নিসন্ত্রাস, ভয়াল নাশকতা, দুর্নীতি, দুঃশাসনের চিত্রও তাদের সামনে তুলে ধরার নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, বিশ্বের সামনে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোলমডেল। বিশ্বের বাঘা বাঘা নেতাও অল্পসময়ে দেশের বিপুল এই উন্নয়নে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। বিদেশে যখনই গেছি, তখন বিশ্ব নেতারাও দেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে আমাদের সরকারের ধারাবাহিকতা থাকুক এটিই চেয়েছেন। আর আমরা দেশের বিপুল এই উন্নয়ন করতে পেরেছি সরকারের ধারাবাহিকতা ছিল বলেই। এ সময় জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নাম উল্লেখ না করে তিনি বলেন, আমাদের দল ছেড়ে গিয়ে বড় পদের আশায় অনেকেই চলে গেছেন। কিন্তু আমাদের দল যারা ছেড়ে চলে গেছেন, তারা কিন্তু কেউ ভাল নেই। কেউ-ই কোন ভাল জায়গায় টিকে থাকতে পারেনি। কারণ একমাত্র আওয়ামী লীগই বঙ্গবন্ধুর আদর্শে ত্যাগের মনোভাব নিয়ে দেশের জন্য কাজ করে। একমাত্র আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেই যে দেশের উন্নয়ন হয় আমরা তা প্রমাণ করেছি। তাঁর প্রাণনাশের চেষ্টায় বার বার হামলার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁকে হত্যার জন্য বার বার হামলা করা হয়েছে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছে। কিন্তু আল্লাহর রহমতে এবং দেশবাসীর দোয়ায় প্রাণে বেঁচে গেছি। তাই মৃত্যুকে আমি ভয় করি না। যতক্ষণ বেঁচে থাকব দেশের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে কাজ করে যাব। আমরা বঙ্গবন্ধু হত্যা, জেলা হত্যা ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছি। তাই স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তিরা নানা ষড়যন্ত্র করার চেষ্টা করবে। সবাইকে এ বিষয়ে সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে। যেন কেউ দেশের জনগণের ক্ষতিকারক কিছু করতে না পারে, কেউ আর অগ্নিসন্ত্রাস-নাশকতা করতে না পারে। বৈঠক সূত্র জানায়, অনানুষ্ঠানিক এই সাক্ষাত অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৫ আগস্টের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, পরিবারের সবাইকে হারিয়ে দিনরাত কষ্ট করে দেশকে আজ এ পর্যায়ে এনেছি। তাই আগামী নির্বাচন সামনে রেখে আমাদের সিদ্ধান্ত যদি আপনারা (মনোনয়ন প্রত্যাশী) না মানেন, তবে আমার চলে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। এ সময় হাজার হাজার মনোনয়ন প্রত্যাশী নিজ আসনে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত মেনে নেয়ার শপথ নেন এবং স্লোগান তোলেন- ‘শেখ হাসিনার ভয় নাই, আমরা আছি লাখ ভাই’, ‘শেখ হাসিনার সরকার বারবার দরকার’-ইত্যাদি। চেয়ারম্যান-মেয়ররা মনোনয়ন পাবেন না ॥ বিভিন্ন জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান এবং পৌরসভার মেয়র হিসেবে নির্বাচিত কোন জনপ্রতিনিধি আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাবেন না। মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সঙ্গে সাক্ষাত অনুষ্ঠানে সূচনা বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী ও দলটির সভানেত্রী শেখ হাসিনা একথা বলেন। বিকেলে সংবাদ সম্মেলনেও দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিষয়টি নিশ্চিত করেন। ওবায়দুল কাদের বলেন, একটি কথা নেত্রী (শেখ হাসিনা) তাঁর বক্তব্যে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, যারা জেলা পরিষদ, উপজেলা বা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কিংবা পৌরসভার মেয়র পদে নির্বাচিত হয়েছেন, তারা তো একটি পদে আছেনই। যদি তারা এখন কেউ এমপিও হতে চান, তাহলে ওই পদ খালি করে এমপি হতে হবে। এটা একটা ঝুঁকি। এই ঝুঁকিটা আমরা কেন মাঝপথে জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে নেব? তিনি বলেন, আমাদের দলের অনেক নেতা আছেন, যাদের অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে, অনেক সংগ্রম করতে হয়েছে, অনেক জেল-জুলুমের মুখে পড়তে হয়েছে। তাদেরও কিছু প্রাপ্য রয়েছে। আপনারা যারা পদে আছেন, তারা তো কিছু একটা পেয়েছেন। কিন্তু যারা পাননি, আমরা তাদেরকে প্রোভাইড করব। এ কথাটি প্রধানমন্ত্রী বলেছেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি যারা আছেন, তারা যেন এখানে আর আশা না করেন (সংসদ সদস্য পদে দলীয় মনোনয়ন)। তারপরও বিশেষ কোন প্রয়োজনে যদি কাউকে দিতে হয়, সেটা পরিস্থিতি বলে দেবে। ওবায়দুল কাদের বলেন, আগামীকাল (বৃহস্পতিবার) থেকে দলের মনোনয়ন দেয়ার বিষয়ে বসা হবে। তখন দেখা যাবে কোথায় কী পরিস্থিতি দাঁড়ায়। তবে আমাদের সাধারণ যে সিদ্ধান্ত, আমরা জেলা বা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কিংবা সিটি কর্পোরেশন বা পৌরসভার মেয়র যারা আছেন, তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তারা এখানে মনোনয়ন চাইবেন না এবং তারা মনোনয়ন চাইলেও আমরা তাদের দেব না। এই কথা আমরা তাদের জানিয়ে দিয়েছি। চাই না স্বাধীনতা বিরোধীরা ক্ষমতায় আসুক ॥ বৈঠক সূত্র জানায়, সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহŸান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট এক হয়েছে, আমি তাদের স্বাগত জানাই। নির্বাচনেই দেখা যাবে জনগণ কাকে চায়, এটা ভোটের মাধ্যমে জনগণ বুঝে রায় দেবে। সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে তিনি বলেন, অন্য কেউ যদি ক্ষমতায় আসে তাহলে জাতির পিতার নামই মুছে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করবে। ২০২১ সালে আমরা সেইভাবে আবার স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করতে চাই। সেজন্য আমাদের সরকার গঠন করতে হবে। আর সরকার গঠন করতে হলে আমাদের সিটও পেতে হবে। নির্বাচনে জিততে হবে। সরকারের ম্যান্ডেট থাকতে হবে। সরকার প্রধান বলেন, কখনও নিজের কথা ভাবি না। শুধু দিন-রাত কার জন্য পরিশ্রম করি এই দেশের জন্য, এই দেশের মানুষের জন্য। আমার কাছে যারা আছে তারা একজনের বিরুদ্ধে আরেকজনের বিরুদ্ধে গিবত গাইতে, বিষাদাগার করতে আসে। তাই আমি ওতো বেশি দেখা করি না। কেউ যদি খারাপ থাকে অবশ্যই আমরা শুনব। কিন্তু এভাবে কাদাছোড়াছুড়ি করে আপনি কার হাতকে শক্তিশালী করছেন? কার হাতে অস্ত্র তুলে দিচ্ছেন? শক্র পক্ষের হাতে? এগুলো কিন্তু জনগণ দেখে। ১৯৯৬ থকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তো কম উন্নয়ন করিনি। এত কিছু করার পরও সরকারে আসতে পারিনি। এবারও তো কম করিনি। তাই আমাদের আত্মবিশ্বাস আছে, দেশের জনগণ উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষার্থে আবারও আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে বিজয়ী করবে। প্রধানমন্ত্রী সরকারের ধারাবাহিকতার ওপর গুরুত্বারোপ করে শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগ দেশ স্বাধীন করেছে জাতির পিতার নেতৃত্বে। কাজেই আর একটু সময় চাই এই দেশের মানুষের জন্য। দায়িত্ব নিতে চাই এদেশের জনগণের ভবিষ্যতের জন্য। বাংলাদেশকে নিয়ে যেন আর ভবিষ্যতে কেউ খেলতে না পারে। বাংলাদেশকে নিয়ে যেন আর কেউ তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতে না পারে। কাজেই বাংলাদেশের ভাগ্যকে আমরা আজকে সারাবিশ্বে উজ্জ্বল করেছি। এই ভাগ্যকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে চাই। এই ভাগ্যকে ওই লুটেরা অগ্নি-সন্ত্রাসকারী, দুর্নীতিবাজ, এতিমের অর্থ চুরি করা, মানি লন্ডারিং ওই অস্ত্র পাচারকারী, এরা যেন আবার ক্ষমতায় এসে আমাদের উন্নয়নটাকে ব্যাহত করতে না পারে। দলের নেতাকর্মীদের সজাগ ও সর্তক করে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা (বিএনপি-জামায়াত) যদি ক্ষমতায় আসে কি ভয়াবহ পরিস্থিতি হবে? কিভাবে তারা মানুষের জীবন নেবে। যারা জীবন্ত মানুষ পুড়িয়ে মারতে পারে। এরা তো ক্রিমিনাল, এদের তো অন্য কিছু নাই? এরা চেনে অর্থ, এরা চেনে সম্পদ। এরা চেনে মানুষের জীবন নিয়ে খেলা। এরা মানুষের জীবন নিয়েই খেলতে পারে। এরা ক্ষমতায় আসা মানে দেশটাকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাওয়া। কারণ তাদের মনে পাকিপ্রেম। সেটা তো তারা আর ভুলতে পারে নাই। সেইসঙ্গে আরও জুটেছে কিছু পাকিপ্রেমী। এই চিন্তা মাথায় যাদের তাদের হাতে দেশটা তুলে দেবেন আপনারা বলেন? প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা এটা চাই না, যারা মানুষের স্বাধীনতার বিশ্বাস করে না, যারা যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত, যারা ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সঙ্গে জড়িত, যারা দুর্নীতিতে নিমজ্জিত, যারা সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদ এবং মাদকের সঙ্গে জড়িত, নিশ্চয়ই তারা ভোটে জিতুক আমরা এটা চাই না। তিনি বলেন, এই নির্বাচন হচ্ছে আগামী তরুণ প্রজন্মের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য। তাদের জীবনটাকে মানসম্মত করার জন্য। কাজেই এই দেশের মানুষ যে সুন্দর জীবন পায়, আমরা যেমন কষ্ট করে গেলাম তারা যেন তা না পায়। আগামী প্রজন্ম যাতে কষ্ট না করে। সেইভাবেই সুকান্তের কবিতার অনুযায়ী- ’যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ... সরাবো জঞ্জাল’ পঙ্ক্তি উচ্চারণ করে বক্তব্য শেষ করেন প্রধানমন্ত্রী। আজ সংসদীয় বোর্ডের বৈঠক ॥ দলীয় প্রার্থিতা চ‚ড়ান্ত করতে আওয়ামী লীগের সংসদীয় বোর্ডের বৈঠক আজ বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে তিনটায় দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার ধানমÐির রাজনৈতিক কার্যালয়ে হবে। বৈঠকে সভাপতিত্ব করবেন আওয়ামী লীগ ও সংসদীয় বোর্ডের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলের সাধারণ সম্পাদক ও সংসদীয় বোর্ডের সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিবৃতিতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে বৈঠকে উপস্থিত থাকার অনুরোধ জানিয়েছেন।
×