ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের ১৮ বছর

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ১১ নভেম্বর ২০১৮

টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের ১৮ বছর

মোঃ মামুন রশীদ ॥ ১০ নবেম্বর, ২০১৮ বাংলাদেশের ক্রিকেটে একটি ঐতিহাসিক দিন। মর্যাদার টেস্ট ক্রিকেটে সেদিন ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে যাত্রা শুরু হয়েছিল শক্তিশালী ভারতের বিপক্ষে। নাঈমুর রহমান দুর্জয়ের নেতৃত্বে সেই ম্যাচে বেশ কয়েকটি রেকর্ডের জন্ম দিলেও শেষ পর্যন্ত খারাপভাবেই হেরেছিল বাংলাদেশ। এরপর নানা ঘটনার সাক্ষী হতে হতে স্থায়ী ও অস্থায়ী মিলিয়ে ১০ অধিনায়কের অধীনে ১০৯ টেস্ট খেলেছে বাংলাদেশ দল। শনিবার ১০ নবেম্বর শেষ হয়েছে ১৮ বছর। আজ ১৯তম বছরের প্রথমদিনেই আরেকটি টেস্ট খেলতে নামবে তারা। দীর্ঘ এ ১৮ বছরে দলগত প্রাপ্তির খাতা বেশ হাল্কা, ব্যর্থতার পাল্লাই ভারি। ওয়ানডে ক্রিকেটে এর মধ্যে ব্যাপক উন্নতি সাধন করলেও টেস্ট ক্রিকেটে এখন পর্যন্ত নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্তভাবে শক্ত করতে পারেনি বাংলাদেশ। টেস্ট ক্রিকেটে যাত্রার ক্ষেত্রে প্রাপ্তবয়স্ক হতে পারলেও দল হিসেবে এখনও বিশ্ব ক্রিকেটে নাবালকই আছে তারা। আর এমনটা ভারপ্রাপ্ত টেস্ট অধিনায়ক মাহমুদুল্লাহ রিয়াদই বলছেন। নিজেদের অভিষেক টেস্টের প্রথম ইনিংসেই ৪০০ রান করে সবাইকে চমকে দিয়েছিল বাংলাদেশ। আমিনুল ইসলাম বুলবুল ১৪৫ রানের যে ইনিংসটি খেলেছিলেন সেটি ছিল দলের অভিষেক টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার চার্লস ব্যানারম্যান ও জিম্বাবুইয়ের ডেভ হটনের পর তৃতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে সেঞ্চুরির রেকর্ড। ভারতের প্রথম ইনিংসে নাঈমুর রহমান ৬ উইকেট নিয়ে আরেকটি গৌরবজনক অধ্যায়ের কীর্তি দেখান। কিন্তু সেই টেস্টেই দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিং ব্যর্থতায় ৯ উইকেটের বড় পরাজয় মানতে হয়। সেই বাংলাদেশ দলটিই ২০১৬ সালে দেশের মাটিতে ইংল্যান্ড ও ২০১৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার মতো দুটি ক্রিকেট পরাশক্তি ও টেস্ট ক্রিকেটের অন্যতম কুলীন দল দুটিকে হারিয়ে দিয়ে দারুণ এক সময়ে পৌঁছার ইঙ্গিত দিয়েছিল। কিন্তু সার্বিকভাবে ১৮ বছরে দলগত প্রাপ্তি খুব বেশি নেই। প্রথমবার সিরিজ জেতার জন্য ২০০৫ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। অন্যতম প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠা জিম্বাবুইয়েকে ১-০ ব্যবধানে ২ টেস্টের সিরিজে হারিয়ে দেয়। এরপর ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে ২-০ এবং ২০১৪ সালে ঘরের মাটিতে জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে ৩-০ ব্যবধানে দুটি হোয়াইটওয়াশ সিরিজ জয়ের গৌরব দেখিয়েছে দল। মাত্র এ তিনটিই সিরিজ জয়। গত ১৮ বছরে ১০৯ টেস্ট খেলে মাত্র ১০ জয়ের বিপরীতে দলকে হার দেখতে হয়েছে ৮৩টি, বাকি ১৬ টেস্ট ড্র হয়েছে। সবমিলিয়ে ১০ অধিনায়কের অধীনে খেলা বাংলাদেশের টেস্টে জয়ের দিক থেকে সাফল্যের ক্ষেত্রে বেশ এগিয়ে মুশফিকুর রহীম (অন্তত ৫ টেস্টে অধিনায়ক বিবেচনায়)। তিনিই সর্বাধিক টানা ৬ বছর দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন ৩৪ টেস্টে। এর মধ্যে ৭ টেস্ট জয় পায় বাংলাদেশ যা শতকরা ২০.৫৮ ভাগ। এছাড়া বাকিদের অধীনে তেমন কোন সাফল্যই নেই বাংলাদেশ দলের। প্রথম টেস্ট অধিনায়ক নাঈমুরের নেতৃত্বে বাংলাদেশ দল ৭ টেস্ট খেলে ৬টিতেই হারে, ১টি ড্র হয়। এরপর খালেদ মাসুদ পাইলট ২০০১ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত ১২ টেস্টে দলকে নেতৃত্ব দিয়ে সবগুলোতেই হার দেখেছেন। সেদিক বিবেচনায় দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বাজে টেস্ট ক্যাপ্টেন্সি রেকর্ড তার। খালেদ মাহমুদও ৯ টেস্টে নেতৃত্ব দিয়ে সবগুলোতে হেরেছেন। হাবিবুল বাশার ১৮ টেস্টে অধিনায়কত্ব করে ১ জয়ের মুখ দেখলেও ১৩টি হেরেছেন এবং ৪টি ড্র হয়েছে। মোহাম্মদ আশরাফুল ১৩ টেস্টে অধিনায়ক ছিলেন, হেরেছেন ১২টি এবং ড্র করেছেন ১টি। মাশরাফি বিন মর্তুজা ১ টেস্টেই দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন যেটি বাংলাদেশ জিতেছিল। সাকিব আল হাসান ১১ টেস্টে নেতৃত্ব দিয়ে ১ জয়ের বিপরীতে ১০ হার দেখেছেন। ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক হিসেবে তামিম ইকবাল ১ টেস্টে দলকে নেতৃত্ব দিয়ে হার দেখেছেন। বর্তমানে সাকিব অধিনায়ক হলেও ইনজুরির কারণে তিনি অনুপস্থিত। তাই ভারপ্রাপ্ত হিসেবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন মাহমুদুল্লাহ। তিনি ৩ টেস্টে দলকে নেতৃত্ব দিয়ে ২ হার দেখেছেন এবং ১টি ড্র করাতে পেরেছেন। এই ১৮ বছরে দেশের সেরা টেস্ট ব্যাটসম্যান ওপেনার তামিম। তিনি ৫৬ টেস্ট খেলে সর্বাধিক ৪০৪৯ রান করেছেন ৩৭.৮৪ গড়ে। সর্বাধিক ৮ সেঞ্চুরিও তার ব্যাট থেকে এসেছে। তবে টেস্টে দেশের সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ২১৭ রানের ইনিংসটি খেলেছেন সাকিব। তিনি আবার বল হাতে দেশের সবচেয়ে সেরা বোলার। ৫৩ টেস্টে ১৯৬ উইকেট শিকার করেছেন তিনি। তবে ইনিংসসেরা বোলিং তাইজুল ইসলামের (৮/৩৯, বিপক্ষ জিম্বাবুইয়ে)। সবমিলিয়ে টেস্টে ৪৯টি সেঞ্চুরি করেছেন বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা। তবে ডাবল সেঞ্চুরি মাত্র তিনটি (মুশফিক ২০০, তামিম ২০৬ ও সাকিব ২১৭)। সর্বাধিক ৬৩ টেস্ট খেলেছেন মুশফিক। তবে দলগত নৈপুণ্যে তেমন প্রাপ্তি না থাকায় এখন পর্যন্ত টেস্ট ক্রিকেটে অপ্রাপ্তবয়স্কই বাংলাদেশ দল। এ বিষয়ে মাহমুদুল্লাহ শনিবার বলেন, ‘যদি ফলাফল হিসেব করে দেখেন, তাহলে হয়তো ওতটা প্রাপ্তবয়স্ক হয়নি। টেস্ট ক্রিকেটটা আপনাকে খেলতে থাকতে হবে, তারপর আপনি ফলাফলটা পাবেন। অন্য ফরমেটে আমরা যেভাবে ভাল খেলছি, ছন্দ ধরতে পেরেছি, টেস্টে হয়তো সেটা ধরতে পারছি না। কিছু ম্যাচে আমরা ভাল করেছি, কিছু ম্যাচে আবার বাজে পারফর্ম করেছি। এই জিনিসটা থেকে বের হওয়া দরকার, বের হতেই হবে। ধারাবাহিকতাটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ টেস্ট ক্রিকেটে। সুশৃঙ্খল হতে হবে আমাদের তিন বিভাগেই।’ মাহমুদুল্লাহর কথার প্রমাণ পাওয়া যায় শুরুর ১৮ বছরে বাকি টেস্ট খেলুড়ে দলগুলোর সাফল্যের হারের সঙ্গে তুলনা করলেই। সেক্ষেত্রে সবার নিচে বাংলাদেশ। প্রথম ১৮ বছরে সর্বাধিক ১০৯ টেস্ট খেলেছে বাংলাদেশই। এরপর ৯৬ টেস্ট খেলে দ্বিতীয় অবস্থানে শ্রীলঙ্কা, ৮৩ টেস্ট খেলে তৃতীয় জিম্বাবুইয়ে। এই সময়ে সবচেয়ে সফল ইংল্যান্ডের সাফল্য ৬৩.০ ভাগ, পাকিস্তানের ৪৪.১, অস্ট্রেলিয়ার সাফল্য ৩৯.৫, শ্রীলঙ্কার ৩৮.৫, ওয়েস্ট ইন্ডিজের ৩১.৮ ভাগ, নিউজিল্যান্ডের ৩১.৩, দক্ষিণ আফ্রিকার ২৮.১ ভাগ, জিম্বাবুইয়ের ২৫.৩, ভারতের ২২.৫ এবং বাংলাদেশের ১৬.৫। তবে ব্যক্তিগত সাফল্যে অনেক রেকর্ডই বাংলাদেশের দখলে। টেস্ট অভিষেকে সর্বকনিষ্ঠ সেঞ্চুরিয়ানের বিশ্বরেকর্ডটি এখনও আশরাফুলের। ২০০১ সালে টেস্ট অভিষেকে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ১৭ বছর ৬৩ দিন বয়সে সেঞ্চুরি করেন আশরাফুল। সবচেয়ে কম বয়সে ১০ উইকেটের রেকর্ড এনামুল হক জুনিয়রের। ২০০৫ সালে ঢাকায় জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে ১২ উইকেট নেয়া ম্যাচের শুরুর দিন এনামুলের বয়স ছিল ১৮ বছর ৪০ দিন। টেস্ট অভিষেকে ১০ নম্বরে ব্যাটিংয়ে নেমে সর্বোচ্চ রানের ইনিংসটি আবুল হাসানের। ২০১২ সালে খুলনায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেকে দশে নেমে ১১৩ রান করেছিলেন এই পেসার। একই টেস্টে সেঞ্চুরি ও হ্যাটট্রিকের রেকর্ড সোহাগ গাজীর। ২০১৩ সালে চট্টগ্রামে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট ইতিহাসের একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে এই কীর্তি গড়েছিলেন এ ডানহাতি অফস্পিনার। টেস্টে একই ম্যাচে সেঞ্চুরি ও ১০ উইকেট নিয়েছেন সাকিব আল হাসান। ২০১৪ সালে খুলনায় জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে প্রথম ইনিংসে সেঞ্চুরি এবং ম্যাচে ১০ উইকেট নেন সাকিব। ইংল্যান্ডের ইয়ান বোথাম ও পাকিস্তানের ইমরান খানের পর তৃতীয় ক্রিকেটার হিসেবে এই কীর্তি গড়েন সাকিব।
×