ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ঋণের হালনাগাদ তথ্য ১০ নবেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দেয়ার নির্দেশ

ভোটে মনোনয়ন পেতে ঋণ পুনর্তফসিলের হিড়িক

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ৮ নভেম্বর ২০১৮

ভোটে মনোনয়ন পেতে ঋণ পুনর্তফসিলের হিড়িক

রহিম শেখ ॥ নির্বাচনে অংশ নিতে হলে প্রার্থীদের ঋণ নিয়মিত থাকতে হয়। বর্তমান প্রার্থীদের বেশিরভাগই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ও তাদের ব্যাংকে ঋণ রয়েছে। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে আগ্রহী প্রার্থীরা ঋণ পুনর্তফসিলে ঝুঁকছেন। সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে যাদের ঋণ খেলাপী হয়ে গেছে, তারা ব্যাংকগুলোতে প্রতিনিয়ত ভিড় করছেন। এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ফজলে কবিরের সঙ্গেও কেউ কেউ দেখা করেছেন। এদিকে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে সম্ভাব্য প্রার্থীদের ঋণের তথ্য আগামী ১০ নবেম্বরের মধ্যে হালনাগাদের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ৩১ অক্টোবর বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি বিভাগ থেকে ব্যাংকগুলোকে এ নির্দেশ দেয়া হয়। বিষয়টি নিয়ে ব্যাংকগুলোর সঙ্গে ৯ অক্টোবর সভাও করে বাংলাদেশ ব্যাংক। জানা গেছে, ঋণখেলাপী নন বাংলাদেশ ব্যাংকের এমন সনদ মিললে হতে পারবেন প্রার্থী। যারা বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ফেরত দেননি তারা প্রার্থী হতে পারবেন না। প্রার্থী হতে হলে অবশ্যই ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ কিংবা পুনঃতফসিল করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি এ নতুন নির্দেশনা জারি করেছে। সে মোতাবেক কোন ব্যক্তির যদি এক টাকাও ঋণ থাকে তার রিপোর্ট পাঠাতে হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। ফলে ছোট-বড় যে আকারের ঋণই থাকুক না কেন তা নিয়মিতকরণ করতে হবে। এবারই প্রথম নিয়ম করা হয়েছে ব্যাংকে যে কোন পরিমাণের দায়ে আটকে যেতে পারে প্রার্থিতা। আগে নির্ধারিত শাখা অথবা সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে ম্যানেজ করে ছাড়পত্র নিলেই প্রার্থী হওয়া সম্ভব ছিল। কিন্তু এবার প্রার্থী হতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ছাড়পত্র নিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, এ বছরের জুনে ঋণ পুনঃতফসিলের পরিমাণ ছিল প্রায় এক হাজার ৪৫৮ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। আগস্টে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজার ৮শ’ ৭৮ কোটি ৮১ লাখ টাকা। সেই হিসেবে তিন মাসের ব্যবধানে বেড়েছে প্রায় চার হাজার ৪২০ কোটি টাকা বা ৩০৩ শতাংশ। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এ সময় সবচেয়ে বেশি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে মোট ৮৪ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে দেশের ব্যাংকিং খাতে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ব্যাংকগুলো থেকে ঋণখেলাপীদের তালিকা নিয়ে সিআইবি হালনাগাদ করতে শুরু করেছে। তথ্য চাওয়া হয়েছে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরির আওতায় থাকা ক্ষুদ্র ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের খেলাপী গ্রাহকেরও। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিজিএমইএর বর্তমান সহসভাপতি এস এম মান্নান কচি নির্বাচন করতে চান ঢাকা-১৬ আসন থেকে। তার খেলাপী ঋণ ১০৯ কোটি টাকা। তিনি এরই মধ্যে ব্যাংকে যোগাযোগ করেছেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের সংসদ সদস্য আসলামুল হক ঋণ খেলাপী হয়েছেন। তার নর্থ পাওয়ার ইউটিলিটির কাছে শুধু ন্যাশনাল ব্যাংকেরই পাওনা এক হাজার ৩শ’ কোটি টাকা, যার বড় অংশই খেলাপী হয়ে গেছে। একইভাবে রাজশাহীর সংসদ সদস্য এনামুল হকের নর্দান পাওয়ার সল্যুশন শীর্ষ ঋণখেলাপীর তালিকায়। প্রার্থী হতে হলে তাকে ঋণ পরিশোধ করে নিতে হবে সিআইবি সনদ। এই দুই প্রার্থীই ঋণ পুনঃতফসিলের জন্য ব্যাংকে যোগাযোগ করছেন বলে জানা গেছে। বিকল্প ধারার মেজর (অব.) মান্নান বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিন্যান্স কোম্পানি থেকে নামে-বেনামে ঋণ নিয়েছেন। নির্বাচনে প্রার্থী হতে তাকেও সিআইবির মুখোমুখি হতে হবে। আকিজ গ্রুপের কর্ণধার ও যশোর-১ আসনের আওয়ামী লীগের এমপি শেখ আফিল উদ্দিন এবারও ওই আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হতে পারেন। তাদের গ্রুপের একটি কোম্পানির নামে খেলাপী ঋণ ছিল। সেটি ইতোমধ্যেই নবায়ন করে নেয়া হয়েছে। বিএনপি সরকারের সাবেক মন্ত্রী ও মুন্নু গ্রুপের কর্ণধার মরহুম হারুনার রশিদ খান মুন্নুর মেয়ে আফরোজা খানম রিতা বিএনপির পক্ষে মানিকগঞ্জ থেকে প্রার্থী হতে পারেন। তাদের প্রতিষ্ঠান মুন্নু ফেব্রিক্স সোনালী ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয়ে ঋণখেলাপী হিসেবে চিহ্নিত। তাদের খেলাপী ঋণের পরিমাণ ২৩০ কোটি টাকা। গ্রুপের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে এই ঋণ নবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ঋণ নবায়নের জন্য এককালীন ডাউন পেমেন্ট বাবদ ১১ কোটি টাকা সোনালী ব্যাংকে জমা দেয়া হয়েছে। বিএনপি সরকারের সাবেক মন্ত্রী মোর্শেদ খানের মালিকানাধীন প্যাসিফিক বাংলাদেশ টেলিকমের কাছে বিভিন্ন ব্যাংকে খেলাপী ঋণের পরিমাণ এক হাজার ৩শ’ কোটি টাকা। গ্রুপের পক্ষ থেকে ঋণ নবায়নের বিষয়ে আলোচনা করা হচ্ছে। তারা বিদেশী উদ্যোক্তাদের কাছে শেয়ার বিক্রি করে ঋণ শোধে উদ্যোগ নিয়েছে। নীলফামারী-৪ আসনে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য শওকত চৌধুরীর প্রতিষ্ঠান যমুনা এগ্রো লিমিটেড বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের বংশাল শাখায় একটি ঋণখেলাপী প্রতিষ্ঠান। তিনি খেলাপী ঋণ নবায়নের জন্য ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন দীর্ঘ সময় ধরে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, নির্বাচনে কে প্রার্থী হতে পারবেন বা পারবেন না সেটি নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ার। আমরা কমিশন থেকে যে তালিকা পাব সেটি যাচাই-বাছাই করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ঋণখেলাপী কি না সে রিপোর্ট দেব। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, রাজনৈতিক বা আমলাতান্ত্রিক বিবেচনায় ও ব্যাংকারদের যোগসাজশে যেসব ঋণ দেয়া হয়, সেগুলোর অধিকাংশই খেলাপী হয়ে যায়। ঠিক একই কৌশলে গ্রাহকরা তা আবার পুনঃতফসিল করে নেয়। সাধারণত দুটো কারণে ঋণ পুনঃতফসিল করে গ্রাহকরা। যেমন- ঋণ খেলাপী থাকলে নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবে না। এছাড়া পুনরায় ঋণ নেয়ার জন্য আগের নেয়া ঋণ পুনঃতফসিল করে বলে মনে করেন সাবেক এই গবর্নর। এদিকে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে সম্ভাব্য প্রার্থীদের ঋণের তথ্য আগামী ১০ নবেম্বরের মধ্যে হালনাগাদের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মনোনয়ন দাখিল করা প্রার্থীদের ঋণের তথ্য নির্বাচন কমিশনে জমা দিতে হবে, এজন্য ব্যাংকগুলোকে ঋণ তথ্য ব্যুরোতে (সিআইবি) হালনাগাদ তথ্য দিতে বলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত ৩১ অক্টোবর বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি বিভাগ থেকে ব্যাংকগুলোকে এ নির্দেশ দেয়া হয়। বিষয়টি নিয়ে ব্যাংকগুলোর সঙ্গে ৯ অক্টোবর সভাও করে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চিঠিতে বলা হয়েছে, আসন্ন সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন দাখিলকারী প্রার্থীদের খেলাপী ঋণ-সংক্রান্ত তথ্য নির্বাচন কমিশনকে সরবরাহ করতে হবে। এ জন্য নির্ভুল তথ্য প্রদান নিশ্চিত ও সম্ভাব্য প্রার্থীদের হালনাগাদ তথ্য দ্রুত জমা দিতে বলা হয়েছে। ১০ নবেম্বরের মধ্যে ব্যাংকগুলোকে সম্ভাব্য প্রার্থীদের ঋণ তথ্য হালনাগাদ করতে বলা হয়েছে। নির্বাচনে অংশ নিতে হলে প্রার্থীদের ঋণ নিয়মিত থাকতে হয়। বর্তমানে প্রার্থীদের বেশিরভাগই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ও ব্যাংকে তাদের ঋণ রয়েছে। এজন্য সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে যাদের ঋণ খেলাপী হয়ে গেছে, তারা ব্যাংকে প্রতিনিয়ত ভিড় করছেন। এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ফজলে কবিরের সঙ্গেও কেউ কেউ দেখা করেছেন।
×