ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান

আওয়ামী লীগের বিরোধিতা নাকি বাংলাদেশের বিরোধিতা

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ২ নভেম্বর ২০১৮

আওয়ামী লীগের বিরোধিতা নাকি বাংলাদেশের বিরোধিতা

একটি গণতান্ত্রিক দেশে স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বাধা বিঘ্ন তৈরি করা ঠিক নয়। রাজনৈতিক কর্মসূচী যতক্ষণ পর্যন্ত জনদুর্ভোগ এবং জনভোগান্তি সৃষ্টি না করে, ততক্ষণ পর্যন্ত অনুমতি দেয়া উচিত। রাজনৈতিক দলের সভা, সমাবেশে কোন ধরনের বাধা নিষেধ আরোপ করা কাম্য নয়। বরং সফল সার্থক সভা-সমাবেশ আয়োজন করতে দেয়ার মতো পরিবেশ তৈরি করা দরকার। সিলেটে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সমাবেশে বাধা না দিয়ে বরং সমাবেশ করতে দেয়া হয়েছে। যদি অন্য একটি দলের কর্মসূচী থাকে তা হলে সিলেটের বড় মাঠে সমাবেশের অনুমতি দেয়া যেত। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই গণতন্ত্রের অন্যতম সোপান নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতার কারা থাকবেন এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। এক্ষেত্রে সবাইকে অবাধে সভা-সমাবেশ করতে দেয়া উচিত। আইনশৃঙ্খলার অবনতি এবং সন্ত্রাসী কর্মকা-ের হুমকি সৃষ্টি না হলে কাউকে সভা-সমাবেশের বাধা সৃষ্টি করা উচিত নয়। জিয়া চ্যারিটি ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে। খালেদা জিয়া ৭ বছরের দ- পেয়েছেন। এ মামলার রায় ঘোষণার সঙ্গে বড় ধরনের অস্থিরতা কিংবা সঙ্গে সঙ্গে কর্মসূচী দিয়ে একটি অস্বাভাবিক অবস্থার তৈরি হবে বলে যে আশঙ্কা করা হয়েছিল, তা হয়নি। রাজনীতিক কর্মসূচী এবং মামলার রায় দুটি আলাদা বিষয়। মামলার রায়ের বিষয়টি আইনী লড়াই। এর সঙ্গে বিএনপির আইনজীবীরা সংশ্লিষ্ট। কিন্তু আরেকটি বিষয় হচ্ছে সভা-সমাবেশের নামে জঙ্গী সমাবেশ হতে না দেয়া। সনাতন গণতন্ত্রে রাজনৈতিক কর্মসূচী বলতে হরতাল, অবরোধ, বিক্ষোভ, মিছিলের মতো কর্মকা-কে বোঝানো হয়। কিন্তু রাজনৈতিক কর্মসূচীর নামে ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে শুরু করে ৩০ মার্চ তিন মাসব্যাপী দেশবাসী জ্বালাও পোড়াও লক্ষ্য করেছে। আবার যদি জঙ্গীবাদী আক্রমণের মতো পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ, রাস্তার গাছ কেটে ফেলা, রাস্তাঘাট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি সাধন, হাঁস-মুরগি-মাছ মেরে ফেলা হয়, তাহলে সভা-সমাবেশের অনুমতি দেয়া উচিত নয়। সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা এক বিষয়। যদি এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে এবং সতর্ক অবস্থানে থেকে সভা-সমাবেশ করা যেতে পারে। যদি একই স্থানে দুটি রাজনৈতিক দলের কর্মসূচী ঘোষণা করা হয়, তাহলে সেখানে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর উচিত হবে সমঝোতার মাধ্যমে মীমাংসা করে দেয়া। সকালে কিংবা বিকালে নির্দিষ্ট দূরত্বে সমাবেশের আয়োজন করা যেতে পারে। কিন্তু নানা অজুহাতে রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশ করতে না দেয়া কাম্য নয়। একই স্থানে একই দিনে দুটি রাজনৈতিক দলের কর্মসূচী থাকলে প্রশাসনের উচিত দুটিই নিরাপত্তা দেয়া এবং সার্থক সফলভাবে সম্পন্ন করতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। ভারতীয় উপমহাদেশের নজিরে তৃতীয় বারের মতো নির্বাচন করে ক্ষমতায় আসা বড় কঠিন। এ অর্থে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের যথার্থই বলেছেন। একটি সুষ্ঠু, সুন্দর এবং অবাধ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের তোড়জোড় অনেক আগে থেকে লক্ষ্যণীয়। নির্বাচনের বিষয়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা কঠোর পরিশ্রম করছে। নেতারা তৈরি হচ্ছেন। কারণ, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনেক প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হবে। দুই বছর আগে যখন আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন হয়, তখন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনাও বলেছেন, আগামীর নির্বাচন অনেক অংশগ্রহণমূলক হবে। সেই সঙ্গে অনেক চ্যালেঞ্জিং হবে। সেভাবে সবাইকে প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। কাজেই নির্বাচন নিয়ে ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য বর্তমানে জোটের কারণে এমনটি ভাবার কোন কারণ নেই। ড. কামাল হোসেন আমাদের সংবিধান প্রণেতাদের একজন। সংবিধানই সরকারকে বিভিন্ন ধরনের আইন তৈরি করা, অনুষ্ঠানিকতা, বিধিবিধান প্রণয়নের অধিকার দেয়। সংবিধান মেনেই সরকারকে চলতে হয়। কাজেই স্থানীয় প্রশাসনকে সমাবেশের বিষয়টি জানানো নতুন কিছু নয়। সমাবেশে গ্রেনেড হামলা করে দলের প্রধানসহ সকল শীর্ষ নেতৃত্বকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার ঘটনাও দেশে ঘটেছে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট, আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপির বাইরেও আরও অনেক দল, ব্যক্তি, গোষ্ঠী রয়েছে। ২০ দলের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী এখনও রয়েছে। এই দলটি একটি স্বীকৃত সন্ত্রাসী দল। জামায়াতের ক্যাডার বাহিনী সুযোগ পেলেই সভা-সমাবেশে, বিক্ষোভ মিছিলে হামলা, অগ্নিসংযোগ করবে। সংবিধান প্রণয়নে ভূমিকার জন্য আমরা কামাল হোসেনকে সম্মান করি। কিন্তু সংবিধান অনুসারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওপর বর্তায় একটি সভা-সমাবেশের শৃঙ্খলা রক্ষা করা। সমাবেশের অনুমতির সঙ্গে কিছু শর্ত সব সময়ই থাকে। ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের অফিসের সামনের বেড়িকেটের মধ্যে সভা-সমাবেশ করতে হতো। যদিও এগুলো খুব ভাল অভিজ্ঞতা নয়। বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিওয়ের রাস্তায় কাঁটাতারের মধ্যে আওয়ামী লীগকে সমাবেশ করতে হয়েছে দীর্ঘদিন। এর বাইরে কোথাও যেতে দেয়া হয়নি। আমি সে সময় মাঠের রাজনীতিতে সরাসরি যুক্ত ছিলাম। অবশ্য তখন এর বাইরে যাওয়ার দরকারও ছিল না। সেখানে কয়েক হাজার লোক দাঁড়িয়ে থাকত। কাঁটাতারের বেড়ার বাইরে কাউকে আসতে দেয়া হয়নি। তবে এই সব কালচার ভাল নয়। বাইরের দেশের লোকজনের সঙ্গে রাজনৈতিক কথাবার্তা বলা আমাদের দেশে নতুন নয়। আওয়ামী লীগ যখন বিরোধী দলে ছিল, তখনও এই সংস্কৃতি চালু ছিল। কারণ, আমাদের রাজনীতি এবং গণতন্ত্রের ব্যাপারে অনেকের আগ্রহ আছে। গণতন্ত্র শক্তিশালী করার জন্য নানা দাতাগোষ্ঠী অর্থ দেয়। গণতন্ত্রে চর্চা করার জন্য প্রশিক্ষণের নামে অর্থ দেয়া হয়। কিন্তু আমাদের একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, আওয়ামী লীগ হচ্ছে একটি রাজনৈতিক দল আর বাংলাদেশ হচ্ছে একটি রাষ্ট্র। কাজেই আমরা এমন কোন কাজ না করি, যেখানে আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করতে গিয়ে রাষ্ট্রের বিরোধিতা করে বসি। বাংলাদেশ থেকে গামের্ন্টস শিল্পের পণ্য যাতে না নেয়া হয়, সেজন্য চিঠি দেয়ার ঘটনাও আছে। পদ্মাসেতুর অর্থ যাতে বন্ধ করে দেয়, সে বিষয়ে ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত একটি সরকারকে স্বৈরাচারী সরকার বলা যায়, ততক্ষণ পর্যন্ত সেই সরকার স্বৈরাচারী সরকার নয়। স্বৈরাচারী শাসক বলতে গিয়ে কারও কোনও অসুবিধা হচ্ছে না। এটাই প্রমাণ করে বর্তমান সরকার স্বৈরাচারী সরকার নয়। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, নির্বাচন নিয়ে আর সংলাপের দরকার নেই। সংলাপ প্রতিনিয়ত হচ্ছে। টকশোর আলোচনাও এক ধরনের সংলাপ। সংলাপ কেবল দুই দলের মধ্যে হতে হবে, এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই। টকশোর এসব কথাবার্তার মাধ্যম অনেক বিষয় বেরিয়ে আসছে। এখন জাতীয় পার্টিকে বলা হয় গৃহপালিত বিরোধী দল। কিন্তু এই গৃহপালিত বিরোধী দলের নেতা ছিলেন আসম আবদুর রব। তিনি ৭৬টি দল দিয়ে ‘কপ’ নামে একটি বিরোধী জোট গঠন করেছিলেন। সকল রাজনৈতিক দলকে নিয়ে প্রতিনিধিত্বশীল সংসদ তৈরি একান্তভাবে কাম্য। আমি মনে করি, এক্ষেত্রে জাতীয় পার্টি এবং বিএনপি পৃথক শক্তি। কিন্তু বেশি আলোচনার বিষয় হচ্ছে জামায়াত। এই জামায়াত কোথায় যাবে? ধরেই নেয়া হলো জামায়াত নেই। কিন্তু তারপরও জামায়াত বিএনপির সঙ্গেই থাকবে। জামায়াতকে যদি ২০ দল থেকে বের করে দেয়া হয়, তারপরও জামায়াত কোন না কোনভাবে বিএনপির সঙ্গেই থাকবে। জামায়াতের অন্য কোন জায়গায় যাওয়ার সুযোগ নেই। আর এটা নিয়ে সবার মাথা ব্যথা হওয়ার কারণ নেই। জামায়াত এবং বিএনপির যদি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দিয়েও বলে তারা আলাদা, তারপরও বিএনপির সঙ্গে থাকবে জামায়াত। জামায়াতের সমর্থন, ভোট, সন্ত্রাসী কর্মকা- সবই বিএনপির সঙ্গে থাকবে। কাজেই এই সত্যকে মেনে নিয়েই অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোকে কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। লেখক : উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
×