ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলার নারী ফুটবলের মেসি সারাবান তহুরা

প্রকাশিত: ০৭:০৯, ৩১ অক্টোবর ২০১৮

বাংলার নারী ফুটবলের মেসি সারাবান তহুরা

বয়সভিত্তিক নারী ফুটবলে বর্তমানে বাংলাদেশের আলোচিত ফুটবলার তহুরা। তার পুরো নাম সারাবান তহুরা খাতুন। বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছা উপজেলার কলসিন্দুর গ্রামে। মাঠে তিনি খেলেন আক্রমণভাগে। তার জার্সি নম্বর ১০। চুলের ছাট, মাঠে ক্ষিপ্র গতিতে বল নিয়ে দৌড়ানো, দৃষ্টিনন্দন গোল করা, হ্যাটট্রিক করা-সবকিছু মিলিয়ে তহুরাকে অনেকেই বলেন ‘বাংলার মেসি’। ম্যাচ শুরু হলেই গ্যালারি থেকে দর্শকরা তহুরাকে ‘মেসি’ বলে চিৎকার করে তাকে আরও ভাল খেলার উৎসাহ জোগান। এসব অবশ্য দারুণভাবে উপভোগই করেন তহুরা। এক সময় এলাকার মানুষ তহুরাকে যখন মেসি বলে ডাকত তখন তার খুবই রাগ হতো। কারণ তিনি তখন জানতেনই না যে মেসি কে? কিন্তু জাতীয় পর্যায়ের খেলোয়াড় হওয়ার পর যখন জানল, টিভিতে মেসির খেলা দেখল তখন নিজেকে নিয়ে গর্ববোধ শুরু করে। ১৫ বছর বয়সী এই কিশোরী ফুটবলার আর্জেন্টাইন সুপারস্টার লিওনেল মেসির একজন দারুণ ভক্ত। ফুটবলে দল হিসেবে তিনি আর্জেন্টিনাকে সমর্থন করেন। টেলিভিশনে মোবাইলে সুযোগ পেলে লিওনেল মেসির খেলা দেখেন তিনি। ভবিষ্যতে আরও বড় মাপের ফুটবলার হতে চান এই কিশোরী। সেজন্য তিনি কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন। একটি বেসরকারী টেভিলিশন চ্যানেলকে দেয়া সাক্ষাতকারে সারাবান তহুরা বলেছেন, ‘বাংলাদেশের মেয়ে ফুটবলাররা খেলার সুযোগ পায় কম। যদি লিগ খেলা হয় তাহলে মেয়ে ফুটবলারদের ফুটবলের প্রতি আরও বেশি আগ্রহী হবে। তা না হলে মেয়েদের ফুটবল খেলার প্রতি আগ্রহ থাকবে না। যদি কেউ অর্থ উপার্জনের বা ভবিষ্যত ক্যারিয়ার নিয়ে শঙ্কায় থাকে তাহলে সে খেলা ছেড়ে দিবে এটাই স্বাভাবিক।’ কলসিন্দুরে একটি অতি সাধারণ পরিবারে জন্ম তহুরার। পাঁচ বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে তিনি তৃতীয়। বাবার নাম ফিরোজ মিয়া। মাতার নাম সাবিকুন্নাহার। অন্য ভাই-বোনদের চেয়ে লাজুক স্বভাবে তহুরা। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই ফুটবল খেলার প্রতি দারুণ আগ্রহ তার। দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ুয়া অবস্থায় ফুটবল খেলা শুরু তার। বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব গোল্ডকাপ প্রাইমারী স্কুল ফুটবল টুর্নামেন্টের মাধ্যমে জাতীয় পর্যায়ে উঠে এসেছে বাংলাদেশ বয়সভিত্তিক জাতীয় দলের এই প্রতিভাবান স্ট্রাইকার। ২০১১ সালে তহুরা খাতুন যখন দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে তখন থেকেই শুরু করে ফুটবল খেলা। খেলা শুরুর কাহিনী নিয়ে তহুরা বলেছেন, ‘বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব গোল্ডকাপের জন্য বড় আপুরা অনুশীলন করছিল। এমন সময় আমার ভাই আমাকে বলে যে, তুইও তো খেলতে পারিস। তুই অনুশীলন শুরু কর। অবশ্য আমিও ফুটবল খেলতে পারতাম। সময়-সুযোগ পেলেই বাড়ির পাশের ক্ষেতে সব সময় ফুটবল নিয়ে মেতে উঠতাম। এভাবেই আমার ফুটবল খেলা শুরু।’ আগ্রহ থাকলেও প্রথমে পরিবার ও আশপাশের মানুষ তহুরার ফুটবল খেলাকে ভালভাবে নেয়নি প্রথমে। তহুরার বাবা অনেকবার তাকে ফুটবল খেলতে নিষেধ করেছেন। আশপাশের অনেক মানুষও তহুরার পরিবারকে অনেক চাপ দিয়েছে। কিন্তু তহুরার আগ্রহ ও পরিশ্রম বৃথা যায়নি। সব বাধা উপেক্ষা করে সে ফুটবলার হয়েছে। অতি সাধারণভাবে উঠে এলেও বর্তমানে সে মেসি খ্যাত দেশ সেরাদের একজন। ফুটবল খেলতে দেখে গ্রামের যারা এক সময় তহুরাকে অনেকে বকাঝকা বা গালমন্দ করেছে তারাই এখন তহুরার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তহুরা বাড়িতে গেলে আশপাশের মানুষ তাকে দেখার জন্য ছুটে আসেন। তহুরা ফুটবলে সফলতা পাওয়ার কারণেই তার গ্রামবাসী ঘরে ঘরে বিদ্যুত পেয়েছে। এজন্য এলাকাবাসী সবাই তহুরার প্রশংসা করেন। এখন তহুরার কাছে এলাকাবাসীর প্রত্যাশাও বেড়েছে। তহুরাকে নাকি এলাকার লোকজন বলে যে, ভবিষ্যতে সে যেন ভাল ফুটবল খেলে কর্তৃপক্ষের আরও বেশি নজরে পড়ে। যাতে এলাকাবাসী যেন গ্যাস, ডিসলাইন এসবের সংযোগ পায় গ্রামে। ঢাকা শহর দূরের কথা। যে তহুরা একসময় উপজেলা বা জেলা শহর ভাল করে চিনত না সেই তহুরা এখন দেশ-বিদেশের নানা প্রান্তে ঘুরে বেড়ান গায়ে লাল-সবুজ জার্সি জড়িয়ে। যে তহুরা বাড়ির আকাশ দিয়ে বিমান উড়ে যেতে দেখলে ঘর থেকে বের হয়ে উড়োজাহাজ দেখার জন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকত, সেই তহুরা এখন বিমানে করে হংকং, নেপাল, ভুটান, তাজিকিস্তান, থাইল্যান্ড, কোরিয়া, জাপানসহ আরও অনেক দেশ ভ্রমণ করেছে ফুটবলার হওয়ার বদৌলতে। তহুরার বাবা একজন কৃষক, মা গৃহিণী। বাড়িতে টিনের ঘর। বাবা অনেক কষ্টক্লেশ করে বড় সংসার চালাতেন। কিন্তু এখন তহুরা সংসারের হাল ধরেছে। নিজের উপার্জন করা টাকা দিয়ে বাবাকে সাহায্য করছে। সম্প্রতি ভুটানে অনুষ্ঠিত এএফসি অনুর্ধ-১৮ উইমেন্স চ্যাম্পিয়নশিপে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। তার কিছুদিন আগে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত ২০১৯ সালের এএফসি অনুর্ধ-১৬ উইমেন্স চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাইপর্বে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশের মেয়েরা। পরপর এই দুই টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন দলের মধ্যে অনুর্ধ-১৬ নারী দলকে সম্প্রতি গণভবনে সংবর্ধনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বিজয়ী দলের প্রত্যেক ফুটবলারকে দশ লাখ টাকা করে আর্থিক সম্মাননা দিয়েছেন। নারী ফুটবলে বাংলাদেশের হয়ে বর্তমানে যারা বিশ্বে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করছেন তাদের বেশিরভাগের পরিবারই গরিব। কিন্তু মেয়ে ফুটবলার হওয়ার সুবাদে তাদের পরিবারে এখন আর্থিক সচ্ছলতা ফিরেছে। খেলোয়াড়রা প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে যে দশ লাখ টাকা পেয়েছেন তা দিয়ে অনেকে অনেক কিছু করছেন। কিন্তু তহুরা খাতুন এই টাকা ব্যয় করছে জমি কেনার পেছনে। সম্প্রতি তহুরা খাতুনের বাবা ফিরোজ মিয়া ঢাকায় আসেন মেয়ের কাছ থেকে এই চেক নিতে। তখন তিনি সংবাদমাধ্যমকে জানান তার পরিকল্পনার কথা। তহুরার বাবা বলেন, আমি তো প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না যে আমার মেয়ে দশ লাখ টাকা পেয়েছে। কিন্তু পরে যখন ও বলল প্রধানমন্ত্রী এই টাকা দিয়েছেন, তখনই বিশ্বাস করেছি। এই টাকা দিয়ে ২০ কাঠা জমি কিনব। এই জমি তহুরারই পছন্দ। তহুরাই এই জমি কিনতে চাইছে। বাড়ির পাশে আমার এক বন্ধু এই জমি বিক্রি করবে। জমিটা ফসলি। তহুরা বলেছিল বাবা আমি তোমাকে একদিন এই জমিটা কিনে দিব। স্বপ্ন সত্যি হয়েছে ক্রীড়াপ্রেমী প্রধানমন্ত্রীর আর্থিক সহযোগিতায়। এখন এই জমি আমি কিনতে পারব। তহুরার বাবা পরের জমিতে চাষ করেন। এখন এই জমিটা কিনলে তা তহুরাদের সংসারেই কাজে আসবে। বদলে যাবে পরিবারের পুরনো চিত্র। তাছাড়া সাফে চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় দলের সকল সদস্যকে একটি করে রেফ্রিজারেটর উপহার দিয়েছে পৃষ্ঠপোষক প্রতিষ্ঠান ওয়ালটন। এই রেফ্রিজারেটর নিতে ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় এসেছিলেন তহুরার বাবা। সম্প্রতি ভুটানে যে সাফ অনুর্ধ-১৮ উইমেন্স চ্যাম্পিয়নশিপ হলো তাতে মোট চারটি ম্যাচ খেলে বাংলাদেশের মেয়েরা ২৪টি গোল করে ও মাত্র একটি গোল হজম করে। টুর্নামেন্টের গ্রুপ পর্বে পাকিস্তানকে ১৭-০ গোলে হারানোর পর নেপালকে ২-১ গোলে হারায় বাংলাদেশ। এরপর সেমিফাইনাল ম্যাচে ভুটানকে ৪-০ গোলে ও ফাইনালে নেপালকে ১-০ গোলে হারায় বাংলাদেশের মেয়েরা। এই টুর্নামেন্টে তহুরা খাতুন একটি গোল করলেও তিনি খেলেন দুর্দান্ত। গত সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয় ২০১৯ সালের এএফসি অনুর্ধ-১৬ উইমেন্স চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাইপর্বের ‘এফ’ গ্রুপের খেলা। গ্রুপ পর্বে বাংলাদেশ অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়। এই টুর্নামেন্টে বাহরাইনকে ১০-০ গোলে, লেবাননকে ৮-০ গোলে, সংযুক্ত আরব আমিরাতকে ৭-০ গোলে ও ভিয়েতনামকে ২-০ গোলে হারায় বাংলাদেশের মেয়েরা। এই টুর্নামেন্টে তহুরা খাতুন তিনটি গোল করেন। এ ছাড়া অন্যদের গোল করার ক্ষেত্রেও দারুণভাবে সহায়তা করেন অসাধারণ পাস দিয়ে। গত আগস্টে ভুটানে অনুষ্ঠিত হয় সাফ অনুর্ধ-১৫ উইমেন্স চ্যাম্পিয়নশিপের আসর। এই আসরে বাংলাদেশ রানার্সআপ হয়। এই টুর্নামেন্টে ফাইনাল ম্যাচ ছাড়া অন্য কোন ম্যাচে হারেনি বাংলাদেশ। এই টুর্নামেন্টে গ্রুপ পর্বে পাকিস্তানকে ১৪-০ গোলে ও নেপালকে ৩-০ গোলে হারায় বাংলাদেশের মেয়েরা। তারপর সেমিফাইনালে ভুটনাকে বাংলাদেশ হারায় ৫-০ গোলে। কিন্তু ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে দুর্ভাগ্রক্রমে ০-১ গোলে হেরে যায় বাংলাদেশ। এই টুর্নামেন্টে তহুরা করেন চারটি গোল। গত এপ্রিলে হংকংয়ে অনুষ্ঠিত জকি সিজিআই ইয়ুথ ফুটবল টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয়। চার দেশ নিয়ে আয়োজিত এই টুর্নামেন্টে তহুরা খাতুন ছিলেন সেরা গোলদাতা খেলোয়াড়। তিন ম্যাচে মোট আটটি গোল করেছিলেন তিনি। এর মধ্যে দুই ম্যাচে তিনি হ্যাটট্রিক করেছিলেন। আর এক ম্যাচে দুটি গোল করেছিলেন। এই টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ মোট ২৪টি গোল করেছিল। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয়েছিল সাফ অনুর্ধ-১৫ উইমেন্স চ্যাম্পিয়নশিপের প্রথম আসর। এই আসরে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। সেবার তহুরা খাতুন মোট তিনটি গোল করেছিলেন।
×