ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

প্রসঙ্গ ॥ জাতীয় সংসদ নির্বাচন

প্রকাশিত: ০৩:৫০, ২৯ অক্টোবর ২০১৮

প্রসঙ্গ ॥ জাতীয় সংসদ নির্বাচন

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের রাজনীতি এখন সরগরম। বলা যায়, রাজনৈতিক নেতারা নিদ্রাহীন। মিটিং-বৈঠকে ব্যস্ত সবাই। ছোট ছোট দল এবং ছোট দলের বড় নেতাদের কদরও বাড়ছে। রাজনৈতিক মেরুকরণ চলছে। নাটকীয়তায় মানুষের আগ্রহ বাড়ছে, তবে শঙ্কাও যে একেবারে নেই তাও নয়। রাজনৈতিক দলের ঐক্যজোট খারাপ বা নতুন কিছু নয়। বাংলাদেশের মানুষ এ ধরনের জোট দেখে অভ্যস্ত। তবে এবারের জোট নিয়ে মানুষের কৌতূহলের পাশাপাশি নানা ধরনের শঙ্কাও বিরাজ করছে। এই শঙ্কার পেছনে রয়েছে নেতাদের লাগামহীন বক্তব্য এবং নানা ধরনের হুমকি ও ষড়যন্ত্রের আভাস। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতভিন্নতা দীর্ঘদিনের। নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়েও নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে বিগত দিনগুলোতে। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন, সামরিক সরকারের অধীনে নির্বাচন, নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন- এসবই জাতি প্রত্যক্ষ করেছে। তবে কোন পদ্ধতিই ক্রটিমুক্ত আর বিতর্কের উর্ধে ছিল না। রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর আস্থা হারিয়ে মানুষ ছুটেছিল দল নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দিকে। কিন্তু সে অভিজ্ঞতা আরও ভয়াবহ। ৯০ দিনের মধ্যে নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত না করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে রাখার অপচেষ্টাও মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে। নিরপেক্ষ নির্বাচন তো হলোই না গণতন্ত্রই বিপন্ন হয়ে গেল। শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়ার মতো জাতীয় নেতাদের জেলে বন্দী করা হলো। জনতার আন্দোলনে ক্ষমতা দখলকারী তত্ত্বাবধায়ক সরকার শেষ পর্যন্ত জাতীয় নির্বাচন দিতে বাধ্য হলো। এ প্রেক্ষাপটে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রাসঙ্গিকতা, নিরপেক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত এবং জাতীয় সংসদও এ তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে আর অনুমোদন করেনি। অনির্বাচিত বিধায় এ সরকারের আইনগত এবং নৈতিক কোন বৈধতাই আর থাকল না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রেক্ষাপটে ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট পুনরায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন দাবি করে। যদিও তারাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিকে বিতর্কিত ও অকার্যকর করেছিল। ছোট ছোট কিছু বাম দলও তাদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে। কিন্তু শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সংবিধানের বাইরে গিয়ে কোন পদ্ধতি গ্রহণ করতে রাজি হয়নি। তবে বিরোধীদলকে আস্থায় আনার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে টেলিফোনে আলোচনার প্রস্তাব দিলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। এমনকি সে সময় সরকার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ চারটি মন্ত্রণালয় বিএনপি জোটকে দেয়ার প্রস্তাব করলেও তারা তা গ্রহণ করেনি। এমনি পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করে। সাংবিধানিক পদ্ধতি রক্ষার জন্য সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের আর কোন বিকল্প ছিল না। বিএনপি-জামায়াত জোট সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা জেনেও নির্বাচন বর্জন এবং প্রতিরোধের ডাক দেয়। এর ফলে প্রকারান্তরে তারা দেশে একটি বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি করে অসাংবিধানিক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল- যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করবে এবং বিএনপি-জামায়াতের অপরাজনীতিকে সমর্থন করবে। কিন্তু শেখ হাসিনার বিচক্ষণতা এবং নির্বাচন কমিশনের দৃঢ়তায় ৫ জানুয়ারি ২০১৪ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিএনপি-জামায়াত জোট নির্বাচন বর্জন এবং প্রতিরোধের ডাক দেয়ায় বহু আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অনেক প্রার্থী জয়লাভ করে। বিএনপি-জামায়াত জোটের ব্যাপক সহিংসতার কারণে ভোটার উপস্থিতি তুলনামূলকভাবে কম ছিল। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনেকেই ভোট কেন্দ্রে যেতে সাহসী হয়নি। যারা গেছে তাদের উপর কি ভয়াবহ নির্যাতন করা হয়েছিল তা জাতি প্রত্যক্ষ করেছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি-জামায়াত জোট পুরনো ধারাতেই অগ্রসর হচ্ছে তবে কৌশলটা নিয়েছে ভিন্ন। আদালতের রায় এবং নির্বাচন কমিশনের বিধির কারণে জামায়াতে ইসলামী নিজ নামে নির্বাচনে অংশ নিতে পারছে না। বিএনপি তাদের সঙ্গে রেখে নতুন মিত্রের সন্ধানে কারণ ইতোমধ্যে দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলা এবং মানিলন্ডারিং মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে ইংল্যান্ডে রাজনৈতিক আশ্রয়ে রয়েছেন। এমনি পরিস্থিতিতেও নেতৃত্বহীন বিএনপি ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেছে। ছোট ছোট দলের বড় বড় নেতাদের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করেছে। এ ঐক্যফ্রন্ট গঠনের প্রক্রিয়াতেও নানাবিধ জটিলতা এবং নাটকীয়তা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। ইতোমধ্যে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচনের জন্য ৭ দফা দাবিনামা ঘোষণা করেছে এবং নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার আগেই এগুলো মেনে নেয়ার জন্য সরকারকে আহ্বান জানিয়েছে- হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে। সরকার দাবি না মানলে সরকারের পতন ঘটানো হবে অথবা এমন পরিস্থিতি তৈরি করা হবে যাতে সরকার দাবি মানতে বাধ্য হয়। বাস্তব পরিস্থিতি হলো নেতারা এখনও ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের পূর্ব পরিস্থিতিতেই রয়ে গেলেন। দাবি মানতে হলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে- কিন্তু সরকার তো এ দাবিকে যৌক্তিক মনে করে না। ঐক্যফ্রন্টের তো সংসদে প্রতিনিধিত্ব নেই- তবে সংবিধান কীভাবে সংশোধিত হবে? মহামান্য রাষ্ট্রপতি সার্চকমিটি গঠন করে সবার মত নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করেছেন- তারা এখন বলছেন নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে। কে করবে? তাহলে কি ঐক্যফ্রন্ট এবং ২০ দলীয় জোট ঠিক করে দেবে কাকে কাকে নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেন বাংলাদেশের সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা। তিনি সবসময় বলে থাকেন সংবিধান মতো দেশ চলতে হবে। তাহলে এখন সংবিধানের বাইরে গিয়ে কীভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি উত্থাপন করছেন। ঐক্যফ্রন্টের নেতারা বলছেন- জনগণের ভোটাধিকার রক্ষা এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য তাঁরা একত্রিত হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ সমন্বিত রাখাও তাদের অন্যতম লক্ষ্য। এদের অনেকেই একসময় বঙ্গবন্ধুর অনুসারী ছিলেন এবং এখনও সে আদর্শকে ধারণ করছেন বলে দাবিও করেন। ড. কামাল হোসেনসহ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া নেতাদের কাছে জানতে ইচ্ছে করে যাদের সঙ্গে নতুন করে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন এদেশে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার জন্য তারা কি কম দায়ী? রাজনীতির নামে সন্ত্রাস, অগ্নিসংযোগ, পেট্রলবোমার আমদানি, সংখালঘু নির্যাতন, গ্রেনেড হামলা- এগুলো ভুলে গেলেন? বঙ্গবন্ধুর অনুসারী বলে যদি দাবিই করেন তাহলে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনীদের পৃষ্ঠপোষক এবং ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে যারা মহাসমারোহে কেক কেটে জন্মদিন পালন করে- তাদের সঙ্গে গাঁটছাড়া বাঁধেন কিভাবে? বিএনপি যখন ঐক্যফ্রন্টে আসে তখন সে হয় মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনা ধারণকারী আবার সেই দলই যখন ২০ দলীয় জোটে বসে সে হয়ে যায় ইসলামী মূল্যবোধ এবং বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার কান্ডারি। এই দ্বিচারিতা এবং বৈপরীত্য নিয়ে বিএনপি সবদিক সামলে চলছে। ঐক্যফ্রন্টের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী নেতারা বিএনপির এই দ্বিমুখী নীতি জেনে বুঝেও এড়িয়ে যাচ্ছেন; কিন্তু মানুষ তো এড়িয়ে যাবে না, তাকে তো জবাব দিতেই হবে। ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের বক্তব্য শুনলে মনে হয় গণতন্ত্র এবং নির্বাচনের চাইতেও শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করাই তাদের মূল লক্ষ্য। জনগণের কথা বলছেন অথচ ক্ষমতা যাবার কর্মসূচীর বাইরে জনগণের জন্য কোন কথা নেই। রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি, শিল্প, কৃষি, বাণিজ্য, শিক্ষা, জ্বালানি, নারী উন্নয়ন, পরিবেশ, বেকারত্ব দূরীকরণসহ জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র গড়ায় কী কী পরিকল্পনা তারা গ্রহণ করবেন এ বিষয়ে কোন কথা নেই। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে- ‘শেখ হাসিনাকে সরাও আমাদের ক্ষমতা দাও’- এটাই মূল লক্ষ্য। আমাদের বামপন্থী বন্ধুরাও ঐক্যফ্রন্ট এবং বিএনপি জামায়াতের ২০ দলীয় জোটের মতোই নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের দাবিতে একাট্টা। বন্ধুদের কাছে জানতে ইচ্ছে করে অতীতের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তিনবার জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে- তাতে আপনাদের কোন লাভ হয়েছে কী? বর্তমানেও আপনাদের জয়লাভের কোন সম্ভাবনা আছে কী? যদি ধরেও নিন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হলো এবং বিএনপি-জামায়াত জোট জয়লাভ করল- তাতে কী সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হবে? ‘দেশ আরও গভীর অন্ধকারে তলিয়ে যাবে’- এ কথা বিশ্বাস করেন কি? আপনাদের কোন ভুলের কারণে গরিব মেহনতি মানুষ আপনাদের সমর্থন না করে অন্য দলকে ভোট দেয় একটু ভেবে দেখবেন আশা করি। সব গরিব মানুষ টাকার কাছে বিক্রি হয় না- এ সত্যটুকুও বিবেচনায় রাখবেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম লক্ষ্য গণতন্ত্র। গণতন্ত্র মানে শুধু একদিনের ভোট প্রদান নয়। গণতন্ত্র মানে- সার্বিক মুক্তি। গণতন্ত্র মানে- অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের নিশ্চয়তা প্রদান। গণতন্ত্র মানে- মানবিক মূল্যবোধ, মানুষে মানুষে মৈত্রীর বন্ধন, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, বিজ্ঞান মনস্কতা ও প্রগতিবাদী ধ্যান-ধারণা লালন ও মুক্তবুদ্ধির চর্চা। গণতন্ত্র মানে- বাক স্বাধীনতা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা। গণতন্ত্র মানে- দেশপ্রেম ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে লালন। গণতন্ত্র মানে- ৩০ লাখ শহীদের আত্মদান, কয়েক লাখ সম্ভ্রমহারা নারীর মর্যাদা রক্ষা। গণতন্ত্র মানে- জাতির জনকের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন- বাঙালীর ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারকদের যথাযথ মূল্যায়ন। সত্যিকার অর্থে যদি গণতন্ত্রকে সু-প্রতিষ্ঠিত হিসেবে দেখতে চাই তবে সকল সমালোচনা সত্ত্বেও উন্নয়নের প্রবহমান ধারাকে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করতে হবে। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদমুক্ত, আধুনিক, প্রগতিবাদী এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ হিসাবে গড়ে তুলতে হবে। সে তাগিদ থেকেই সকল ষড়যন্ত্রকে প্রতিহত করে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এগিয়ে যাওয়ার পথকে মসৃণ করতেই হবেÑ আজকের দিনে সচেতন মানুষের এই হোক দৃঢ় প্রত্যয়। লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
×