ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

দারিদ্র্যমুক্ত বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থার দিকে এগোচ্ছে দেশ সক্রিয় হয়েছে গ্রামীণ অর্থনীতি ১ কোটি ৩৪ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান চাকরি নিয়ে বিদেশে গেছেন ৭৯ লাখ মানুষ

বাজেট বেড়েছে ৭ গুণ ॥ দশ বছরে সাফল্যের অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত

প্রকাশিত: ০৬:০০, ২৭ অক্টোবর ২০১৮

বাজেট বেড়েছে ৭ গুণ ॥ দশ বছরে সাফল্যের অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত

এম শাহজাহান ॥ দশ বছরে অর্থনৈতিক-সামাজিক উভয়ক্ষেত্রে সাফল্যের অনুকরণীয় নজির স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের উন্নয়ন আকাক্সক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাজেটের আকার বাড়ানো হয়েছে ৭ গুণের বেশি। একটি দারিদ্র্যমুক্ত বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। সক্রিয় হয়েছে গ্রামীণ অর্থনীতি। বিভিন্ন ধরনের কর্মসৃজন ও দক্ষতা উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়নের ফলে দেশে-বিদেশে সরকারী-বেসরকারী ও ব্যক্তি উদ্যোগে কাজের সুযোগ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। সার্বিকভাবে এই সময়ে দেশে ১ কোটি ৩৪ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া ওই সময়ে ৭৯ লাখ মানুষ চাকরি নিয়ে বিদেশে গেছে। এদিকে, আর্থ-সামাজিক অগ্রযাত্রার এই মজবুত ভিত রচনা করতে বর্তমান সরকারকে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়েছে। দায়িত্ব নেয়ার শুরুতেই মোকাবেলা করতে হয়েছে বিশ্ব মন্দার প্রভাব। দেশের অভ্যন্তরে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশের অপ্রতুলতা ও জনমুখী নীতি কৌশল না থাকাটা ছিল বড় সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম। এছাড়া ওই সময় জঙ্গীবাদ, স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো চ্যালেঞ্জ ছিল সরকারের সামনে। তবে দক্ষ সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সঙ্কটের অভিঘাতসহ সব বাধা সাফল্যের সঙ্গেই মোকাবেলা করেছে বাংলাদেশ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আর্থ-সামাজিক অগ্রযাত্রার এই মজবুত ভিত রচিত হওয়ার পেছনে বর্তমান সরকারের নেতৃত্ব ও অনুসৃত কর্মকৌশলের ধারাবাহিকতা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। একদশকের এই অর্জন আরও শাণিত করে ২০৪১ সালের মধ্যে সুখী সমৃদ্ধ ও উন্নত দেশ গঠনের লক্ষ্য স্থির করেছে শেখ হাসিনা সরকার। সুদূরপ্রসারী প্রেক্ষিত পরিকল্পনা-২০২১-৪১ প্রণয়নের কাজ চলছে। এছাড়া দেশের অমূল্য পানি সম্পদের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপসহ সব খাতের সমন্বয়ে প্রণয়ন করা হয়েছে সমন্বিত দীর্ঘমেয়াদী ‘বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০’ যা ইতোমধ্যে অনুমোদন করা হয়েছে। এদিকে, গত ২০০৮-০৯ থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের সামগ্রিক উন্নয়ন কর্মকা- নিয়ে ‘অগ্রযাত্রার দশ বছর’ শীর্ষক একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। প্রাপ্ত সর্বশেষ তথ্য ও উপাত্তের ভিত্তিতে এই বইটি রচিত হয়েছে। দেশের সামগ্রিক অগ্রগতি নিয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দুই মেয়াদে দশ বছরের ধারাবাহিক ও পরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকা- বাস্তবায়নের ফলে এই সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়েছে। দারিদ্র্যমুক্ত ও বৈষম্যহীন সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনের প্রত্যয় নিয়ে রূপকল্প-২১ সামনে রেখে ২০০৯ সালে বর্তমান সরকারের অভিযাত্রা শুরু হয়। তিনি বলেন, ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে কম মাথাপিছু আয় নিয়েও বাংলাদেশ সামাজিক সূচকসমূহ বিশেষ করে প্রত্যাশিত গড় আয়ুষ্কাল, স্বাক্ষরতার হার, শিশুমৃত্যু হ্রাস প্রভৃতি ক্ষেত্রে বেশি সাফল্য অর্জন করেছে। রাজস্ব ও মুদ্রানীতির যথাযথ সমন্বয়, অর্থনীতির সার্বিক শৃঙ্খলা ও সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক ও অগ্রযাত্রায় এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। তিনি বলেন, বাজেট বাস্তবায়নের সক্ষমতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা হলেও কার্যত তা অমূলক প্রমাণিত হয়েছে। বরং বর্ধিত সরকারী ব্যয় ও তার বণ্টনে দক্ষতা ও উৎকর্ষতা নিশ্চিত করার ফলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উভয় ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সাফল্যের অনুকরণীয় নজির স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। সূত্রমতে, গত ২০০৮-০৯ থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত সময়ে গড়ে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। বিশেষ করে গত তিন বছরে একাদিক্রমে সাত শতাংশের অধিক হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে বাংলাদেশ। সর্বশেষ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে প্রকৃত প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ। ইতোমধ্যে মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৭৫১ মার্কিন ডলার উন্নীত হয়েছে। দারিদ্র্য ও অতি দারিদ্র্যের হার নেমে এসেছে যথাক্রমে ২১ দশমিক ৮ এবং ১১ দশমিক ৩ শতাংশে। এছাড়া সরকার পরিকল্পিত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন কৌশল বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশে ধারাবাহিকভাবে প্রবৃদ্ধি বেড়েছে এবং দারিদ্র্যের হার কমে এসেছে। এদিকে, চলতি বছর প্রকাশিত জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন সূচকেও বাংলাদেশ পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় তিন ধাপ অগ্রসর হয়েছে। ১৮৯ দেশের মধ্যে আমাদের বর্তমান অবস্থান ১৩৬তম। শুধু তাই নয়, গত দশ বছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে অভ্যন্তরীণ চাহিদা তথা ভোগ ও বিনিয়োগের অবদান ক্রমে বাড়ছে। ইতোমধ্যে নি¤œ মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণ ঘটেছে এবং চলতি বছর স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের তিনটি শর্ত যথাÑ মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে নির্ধারিত মান অর্জন একসঙ্গে পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে মানব উন্নয়নে বিগত এক দশকে বাংলাদেশের অর্জন সমমানের অন্যান্য দেশের তুলনায় ছিল অনেকটাই ভিন্ন মাত্রার। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জীবনমান এ তিনটি নির্দেশকের ভিত্তিতে জাতিসংঘের তৈরি করা মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ ২০০৫ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে চার ধাপ এগিয়েছে। এই সময়ে শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা বাড়ার ফলে তাদের মজুরি ও আয় বেড়েছে। দুটি জাতীয় বেতন স্কেল বাস্তবায়ন করায় সরকারী কর্মচারীগণের জীবনমানে গুণগত পরিবর্তন এসেছে। খাদ্যপণ্যের দাম কমাতে মূল্যস্ফীতির দিকে নজর রাখা হয় এই সময়ে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী ॥ কাঠামোগত কারণে যারা উৎপাদন প্রক্রিয়ার বাইরে থাকছে, সামাজিক নিরাপত্তা কর্র্মসূচীসহ নানামুখী আয় হস্তান্তর কার্যক্রমের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল তাদের কাছে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। দরিদ্র, অসহায় এবং সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর উন্নত জীবনমান নিশ্চিত করার জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কার্যক্রমের আওতায় সুবিধাপ্রাপ্তদের সংখ্যা ও সহায়তরা পরিমাণ বহুলাংশে বাড়ানো হয়েছে। এ খাতে বরাদ্দ ২০০৮-০৯ অর্থবছরের ১৩ হাজার ৮৪৫ কোটি টাকা থেকে ৪ দশমিক ৬ গুণ বাড়িয়ে চলতি অর্থবছর ৬৪ হাজার কোটি ১৭৭ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। সার্বিকভাবে সরকারের অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন কৌশলের প্রভাবে সামাজিক চালকসমূহে সমমানের দেশসমূহে তুলনায় বাংলাদেশ অনেক বেশি সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। এ প্রসঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোঃ আজিজুল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, গত এক দশকে অর্থনৈতিকক সব সূচকে বাংলাদেশ ভাল করেছে। নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখেও রফতানি আয় ও রেমিটেন্সের প্রবাহ ইতিবাচক ধারায় রয়েছে। এছাড়া গত দশ বছরে অবকাঠামো খাতে সরকারী বিনিয়োগ বাড়ায় দেশের বেসরকারী খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বেড়েছে। তিনি বলেন, যারা মূল ধারার অর্থনীতির বাইরে রয়েছেন, তাদের সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় সুরক্ষা দেয়া হচ্ছে। এ কারণে দারিদ্র্য মানুষের সংখ্যা কমে আসছে। মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে বাংলাদেশ। তিনি বলেন, গত এক দশকে দেশের জন্য এটা বড় অর্জন। প্রথাগত তত্ত্ব ও ধ্যানধারণাকে পেছনে ফেলে বিগত এক দশকে বাংলাদেশ এগিয়েছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক খাত ও মানব উন্নয়ন ঘটেছে একই সমান্তরালে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্রুততম প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দশ দেশের মধ্যে একটি। প্রবৃদ্ধি সঞ্চালক খাতে অর্থায়ন ॥ সরকারী ব্যয় ২০০৫-০৬ অর্থবছরের ৬৪ হাজার ৩৬২ কোটি টাকা থেকে ৭ দশমিক ২ গুণ বাড়িয়ে চলতি অর্থবছরে ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকায় বৃদ্ধি করা হয়েছে। প্রবৃদ্ধি সঞ্চালক খাত বিশেষ করে বিদ্যুত-জ্বালানি, যোগাযোগ ও বন্দর অবকাঠামো, তথ্যপ্রযুক্তি এবং কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন খাতে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ দেয়ার ফলে ভৌত অবকাঠামোর সীমাবদ্ধতা অনেকখানি দূর হয়েছে। ২০০৫-০৬ অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরে কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন খাতে বাজেট বরাদ্দ বেড়েছে ৬ গুণ, বিদ্যুত ও জ্বালানি খাতে ৬ দশমিক ৫ এবং পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে ১১ গুণ বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হয়েছে। এই সময়ে শিক্ষা, প্রযুক্তি ও স্বাস্থ্য খাতে ৮ গুণ এবং সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ৪ দশমিক ৬০ গুণ বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া প্রবৃদ্ধি সঞ্চালক দশটি মেগা প্রকল্পের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলিকুজ্জমান আহমেদ সম্প্রতি জনকণ্ঠকে বলেন, বিগত দশ বছরে সরকারী ব্যয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আয়ও বেড়েছে। ফলে অবকাঠামো খাত উন্নয়নে দেশে সরকারী বিনিয়োগ বেশ ভালভাবেই বেড়েছে। প্রবৃদ্ধি সঞ্চালক খাতে বিনিয়োগ বাড়ায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র্যবিমোচনে আশানুরূপ অগ্রগতি অর্জন করেছে বাংলাদেশ। তিনি বলেন, সামাজিক খাতে অর্থ বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। তবে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন এবং রূপকল্প-২১ বাস্তবায়নে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন ও বিশ্বমন্দার প্রভাব ও দারিদ্র্যবিমোচনের মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে বাংলাদেশকে। আশা করছি, সরকারের দূরদর্শী পরিকল্পনায় এসব চ্যালেঞ্জ সামনে রেখেই এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। এদিকে, মেগা প্রকল্প ছাড়া ২০৩০ সালের মধ্যে মোট ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এসব অঞ্চল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ রফতানি আয় সম্ভব বলে মনে করছে সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া এসব অঞ্চলে নতুন করে এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে বলে আশা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আসা শুরু হয়েছে।
×