ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিধান রিবেরু

সাহিত্য ও চলচ্চিত্র

প্রকাশিত: ০৭:২৬, ২৬ অক্টোবর ২০১৮

সাহিত্য ও চলচ্চিত্র

একটির বয়স সঠিকভাবে নির্ণয় করা যায়নি, আর অন্যটির বয়স এক শ’ পেরিয়েছে গত শতাব্দীতে। একটি সাহিত্য নামে পরিচিত, অন্যটির একটি অংশÑচিত্রনাট্যÑসাহিত্যের মর্যাদা দাবি করছে ইদানীং। এই নিবন্ধে আমরা আলাপ করব সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের ফারাক নিয়ে, এর পাশাপাশি চিহ্নবিদ্যার চশমায় ফারাকের স্বরূপটাও তুলে ধরার চেষ্টা করব সংক্ষিপ্ত আকারে। মূল আলোচনায় প্রবেশের আগে প্রণাম জানাতে চাই পশ্চিমবঙ্গের প-িত পবিত্র সরকারকে। এর কারণ তিনিও একই শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন ‘সাহিত্য ও চলচ্চিত্র’ নামে, তবে ওই প্রবন্ধের বক্তব্যের সঙ্গে আমি প্রায় পুরোপুরি দ্বিমত পোষণ করি। লেখাটির যে ভঙ্গিÑ চলচ্চিত্র হলো এই সেদিনের বিষয়, আর সাহিত্য হলো বিশাল মহীরুহ, সাহিত্যের সঙ্গে চলচ্চিত্রের তুলনাই চলে নাÑ আমি এই ভঙ্গিটার বিরোধিতা করি। পবিত্র সরকার এক জায়গায় লিখছেন, ‘এই প্রবীণ [সাহিত্য] শিল্পের সঙ্গে মাত্র এক শ’ বছরের একটি তরুণ শিল্পের তুলনা এক দিকে অন্যায় এবং অনুচিত। কারণ চলচ্চিত্রের মধ্যে এখনও এত বৈচিত্র্য তৈরি হয়নি।’ বৈচিত্র্যে চলচ্চিত্রকে সাহিত্যের তুলনায় দরিদ্র উল্লেখ করে পবিত্র সরকার আরও বলেন, ‘আর কোন শিল্পে গীতিকবিতা, গাথা, ছোট গল্প, ছোট উপন্যাস, বড় উপন্যাস, মহাকাব্য, নাটক, প্রবন্ধ-নিবন্ধ; অন্যদিকে লোকসাহিত্যের ছড়া, প্রবাদ, উপকথা, রূপকথা, গীতিনাট্য ইত্যাদি এত সব সংরূপ তৈরি হয়েছে? বা এসব ভেঙ্গে, প্রবন্ধ-গল্প-নাটক-কবিতা মিলিয়ে নতুন সংরূপ তৈরি করার চেষ্টা হচ্ছে?’ পবিত্র সরকারের এসব প্রশ্ন যে কতটা খেল তা চলচ্চিত্রপ্রেমী মাত্রই জানেন। মিউজিক্যাল ফিল্ম থেকে শুরু করে ড্রামা, কমেডি, হরর, থ্রিলার, এপিক, সাই-ফাই, এ্যানিমেশন, ফ্যান্টাসি, ডিজাস্টার, স্পাই, সাইলেন্ট ইত্যাদি কত রকম যে কাহিনীচিত্র রয়েছে দুনিয়ায়! সেগুলোর ভেতরেও আবার রয়েছে নানা রকমের ফারাক, যেমন ধরি থ্রিলারÑ এই থ্রিলার হতে পারে এ্যাকশন থ্রিলার, কমেডি থ্রিলার, কন্সপিরেসি থ্রিলার, ইরোটিক থ্রিলার ইত্যাদি। আছে রিয়েলিস্ট ধারার ফিল্ম, আছে ফিল্ম নোয়া, আছে সুররিয়ালিস্ট ফিল্ম। পর্নোগ্রাফির কথা না হয় বাদই দিলাম। প্রামাণ্যচিত্রেও তো বৈচিত্র্যের অভাব নেই। সেই রবার্ট ফ্লাহার্টির ‘নানুক অব দ্য নর্থ’ থেকে শুরু করে আধুনিককালের মাইকেল ম্যুর পরিচালিত ‘ফারেনহাইট নাইন ইলেভেন’ পর্যন্ত, কত কিসিমের যে প্রামাণ্যচিত্র রয়েছে, কোনটি সাক্ষাতকারভিত্তিক, তো কোনটি বর্ণনাভিত্তিক বা শুধু ছবিই কথা বলে গেছে ধারা বর্ণনা ছাড়া। এক ধরনের ডকুমেন্টারিকে তো ডাকা হয় মকুমেন্টারি, যেমন উডি এ্যালেনের ‘জেলিগ’ (১৯৮৩)। ডকুমেন্টারি আর ফিকশন মিলিয়ে ডকুফিকশনের ধরনটাও আমাদের অজানা নয়, উদাহরণস্বরূপ ফ্লাহার্টির ‘মোয়ানা’র (১৯২৬) কথা বলা যায়। আর দৈর্ঘ্যরে দিক থেকেও তো পূর্ণ ও স্বল্প দৈর্ঘ্যরে চলচ্চিত্রের কথা আমরা জানি। চলচ্চিত্রের ইতিহাসে রএ্যাবেল গঁস পরিচালিত ৩৩২ মিনিটের ‘নেপোলিয়ন’ (১৯২৭)বা ইঙ্গমার বারিমান পরিচালিত ৩১২ মিনিটের ‘ফ্যানি অ্যান্ড আলেকজান্ডার’ (১৯৮২) প্রভৃতি ছবি যেমন আছে, তেমনি আছে চ্যাপলিনের অসংখ্য ছোট দৈর্ঘ্যরে ছবি। এগুলোকে চাইলে আপনি বড় উপন্যাস, উপন্যাস ও ছোটগল্পের দৈর্ঘ্যরে সঙ্গে তুলনা করতে পারেন, যদি গত শতকের শেষ প্রান্তে লেখা পবিত্র সরকারের প্রবন্ধটি আমলে নেন আর কি! চলচ্চিত্রে শব্দ ও রং যোগ হওয়ার পর যে মাত্রায় পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়েছে সেটা কি আর কোন মাধ্যমে সম্ভব হয়েছে? সম্ভব হয়নি মাধ্যমের কারণেই। কারণ চলচ্চিত্র অন্যান্য শিল্পের চেয়ে আধুনিক এবং অন্য সকল শিল্পের কাছ থেকেই সে গ্রহণ করেছে দু’হাত ভরে। কাজেই একটি চলচ্চিত্রে যেমন সংলাপের মাধ্যমে উন্নত সাহিত্যের ঝলক দেখানো যায়, তেমনি একটি শট দিয়ে তৈরি করা যায় পেইন্টিং বা ফটোগ্রাফির আবহ, আবহসঙ্গীতের মাধ্যমে শোনানো যায় সুরের মূর্ছনা, শব্দ ও নৈশব্দের ভেতর দিয়ে দেয়া যায় এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। এসব তো সাহিত্যে সম্ভব নয়। কিন্তু তার পরও সাহিত্য টিকে আছে ভিন্ন শক্তি নিয়ে। আর এই শক্তির কারণেই সাহিত্যচলচ্চিত্র থেকে স্বতন্ত্র। এক. সাহিত্য ও চলচ্চিত্র দুটো দুই মাধ্যম, দুই রকম শিল্প, দুই রকম তাদের ক্ষমতার জায়গা। ক্রিস্তিয়াঁ মেৎজ ‘ফিল্ম ল্যাঙ্গুয়েজ’ বইতে বলছেন, সাহিত্য হলো ভিন্নমাত্রিক অর্থবিকেন্দ্রিক জ্ঞানের (Heterogeneous connotation) শিল্প, অন্যদিকে চলচ্চিত্র হলো সমমাত্রিক অর্থবিকেন্দ্রিক জ্ঞানের (Homogeneous connotation) শিল্প। এই মন্তব্যকে পরিষ্কার করতে মেৎজ ধার করেছেন মাইকেল ডুফরেনের (Mikel Dufrenne) ‘প্রকাশ’ (Expression) ধারণাটি। ডুফরেনের দোহাই দিয়ে মেৎজ বলেন, কোন বিষয় তখনই ‘প্রকাশিত’, যখন ওই বিষয়ের সঙ্গে ‘অর্থ’টি সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে আমাদের সামনে হাজির হয়। আমরা জানি, ‘অর্থ’ উৎপন্ন হয় পদের (Signifier) সমষ্টি থেকে। বিশ্বের যেমন প্রকাশ আছে, তেমনি শিল্পেরও প্রকাশ আছে। বিশ্বকে প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রকৃতিই হলো লেখক। আর শিল্প প্রকাশের বেলায় লেখক হয় মানুষ। বিশ্বে অবস্থিত বস্তু, বিষয়, ধারণা ইত্যাদিকে বিশেষ রূপ দিয়েই শিল্পের জন্ম হয়। তেমনি ভাষা থেকেই সৃষ্টি হয় সাহিত্য। এটা অনেকটা পাথর কেটে ভাস্কর্য বানানোর মতোই। সাহিত্যে যে শব্দ বা শব্দমালা ব্যবহার হয়, তা ভাষা থেকে আহৃত, সেই শব্দের নিজের একধরনের প্রকাশ আছে, যা ভাষার শব্দ হিসেবেই আছে, এটা অনেকটা যেন প্রকৃতিতে অবস্থিত বস্তুর মতো। এই শব্দই যখন সাহিত্যের বাক্যে লিখিত আকারে, বই আকারে প্রকাশিত হয় তখন সেটি পদে পরিণত হয় এবং সমগ্রের সঙ্গে তার আরো বা ভিন্ন অর্থ উৎপন্ন হয়। কাজেই একটি শব্দ একই অর্থ উৎপন্ন করছে না সবসময়। অভিধানের শব্দ লেখকের ভাব প্রকাশ করে না, আভিধানিক শব্দের সঙ্গে নানা অর্থই যেহেতু থাকে, তাই লেখকের নির্দিষ্ট ভাবনার ছাঁচ সে পায় না, লেখকের ভাবনাও জড়িয়ে থাকে না সেখানে, থাকার বাস্তবতাও নেই, কিন্তু সেই শব্দই যখন সাহিত্যে ব্যবহৃত হয়, তখন সেখানে ভাবযুক্ত হয়, অর্থ বিকেন্দ্রিক জ্ঞান নিয়ে অন্য মেজাজে সে প্রকাশিত হয়, মেৎজ তাই বলছেন, সাহিত্যে Expressive connotation যুক্ত হয় Nonexpressive denotation-এর সঙ্গে। তাই সাহিত্যকে ভিন্নমাত্রিক অর্থবিকেন্দ্রিক জ্ঞানের (Heterogeneous connotation) সঙ্গে তুলনা করেছেন মেৎজ। আমরা যদি উদাহরণ দেই, একটি গোলাপের, তাহলে দেখব গোলাপ শব্দ হিসেবে যে অর্থকেন্দ্রিক বোধ বা ডিনোটেশন তৈরি করছে, ভাষার একটি একক হিসেবে, অভিধানের একটি ভুক্তি হিসেবে, সেটার হয় তো কোনোটেশন থাকে, কিন্তু লেখক যে কোনোটেশন তৈরি করতে চান, সেটি সাহিত্যে ব্যবহারের পরই প্রস্ফুটিত হয়, গোলাপ তখন ভিন্ন কোনোটেশন তৈরি করে, যেমন যদি বলি, ‘গোলাপ ফুল ফুটিয়ে আছে, মধুপ, হোথা যাসনে/ফুলের মধু লুটিতে গিয়ে কাঁটার ঘা খাস নে।’ এক্ষেত্রে গোটা গোলাপ গাছটাই মানসপটে হাজির হয়, হাজির হয় মেটাফোর হিসেবে বা রূপান্তরিত হয়ে। যদিও গোলাপটি কোন্ রঙের তা নির্দিষ্ট করা নেই সেখানে। চলচ্চিত্রে কিন্তু শুদ্ধ গোলাপ দেখিয়ে দেয়ার কোন ব্যবস্থা নেই। সেখানে হয় আপনাকে লাল গোলাপ দেখাতে হবে, নয় তো কালো গোলাপ দেখাতে হবে, মোটকথা কোন একটি নির্দিষ্ট গোলাপ আপনাকে দেখাতে হবেই। সিনেমায় যা দেখানো হলো সেটার অর্থকেন্দ্রিক বোধ বা ডিনোটেশন সরাসরি প্রকাশিত ও নির্মাতার ভাবযুক্ত। কল্পনার কোন অবকাশ নেই এখানে অর্থাৎ নির্দিষ্ট একটি বস্তুকেই ক্যামেরায় ধারণ করতে হবে আপনাকে। সিগনিফায়ার ও সিগনিফিকেট এখানে গায়ে গায়ে লাগানো থাকে, যেহেতু গোলাপের একটি রং আমরা দেখাচ্ছি। ধরুন যে সংস্কৃতির আবহে কালো গোলাপ দেখানো হচ্ছে, সেই সংস্কৃতিতে কালো গোলাপ যদি বেদনার চিহ্ন হয়, তাহলে বেদনার ভাবটাই যুক্ত হয়ে যায় সেই ধারণকৃত দৃশ্যের সঙ্গে। এবার আগেপিছে অনেক দৃশ্যমালার ভেতর বসানো ওই দৃশ্যটি তখন অর্থ বিকেন্দ্রিক বোধও তৈরি করবে, নির্দিষ্ট ডিনোটেশনটির সঙ্গে তখন জুড়ে যাবে নির্মাতার ভাবযুক্ত কোনোটেশন। মেৎজ এটাকেই বলছেন Expressive connotation-এর যুক্ত হওয়া Expressive denotation-এর সঙ্গে। একারণেই মেৎজ চলচ্চিত্রকে বলছেন সমমাত্রিক অর্থবিকেন্দ্রিক জ্ঞানের (Homogeneous connotation)) শিল্প। উদাহরণ হিসেবে মেৎজ আমলে আনেন একটি ছবিকে-‘ক্যু ভিভা মেক্সিকো’-রুশ নির্মাতা সের্গেই আইজেনস্টাইন এই ছবিটি শুরু করেন ১৯৩০ সালে, কিন্তু শেষ করতে পারেননি। যা হোক, এই অসমাপ্ত ছবির ট্রায়াঙ্গুলার কম্পোজিশনে একটি বিখ্যাত দৃশ্য রয়েছে যেখানে তিনজনকে মাটিতে পুঁতে, তাদের ওপর দিয়ে ঘোড়া চালিয়ে অত্যাচার করা হয়। মেৎজ বলছেন, এই দৃশ্যের ডিনোটেশনের মাধ্যমে আমরা পাই পদ/সিগনিফায়ার (তিনজনের মুখম-ল) ও পদার্থ/সিগনিফিকেট (মেরে ফেলার জন্য অত্যাচারিত); এটাই ‘সাবজেক্ট’, এটাই ‘স্টোরি’। এখানে প্রাকৃতিকভাবেই ভাবপ্রকাশ হচ্ছে : যন্ত্রণাক্লিষ্ট চেহারা একসময় নিথর হয়ে যায় মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। কিন্তু এর ওপর যে কনোটেশন রয়েছে সেখানেই শিল্পের শুরু। পেছনে বিস্তৃত ভূচিত্র বা ল্যান্ডস্কেপ ও সামনে ত্রিভুজ বিন্যাস- এসব দিয়েই ‘লেখক’ অর্থাৎ আইজেনস্টাইন কিছু বলতে চাইলেন : মেক্সিকোর জনগণের মাহাত্ম্য ও ত্যাগের বিনিময়ে তাদের বিজিত হওয়ার গৌরবময় ইতিহাস। এটাই নান্দনিক প্রকাশ, এটাই শিল্প। মেৎজ বলছেন এখানে দুটি সিগনিফায়ার প্রকাশিত : ১. ঊষর বিস্তৃত জমিনে তিনটি মুখম-ল, ২. তিনটি চেহারা দিয়ে ত্রিকৌণিক ভূচিত্র; আর আছে দুটি সিগনিফিকেট : ১. পীড়ন ও মরণ, ২. মাহাত্ম্য ও বিজয়। অর্থকেন্দ্রিক জ্ঞানের উপাদান (ডিনোটেটিভ মেটেরিয়াল) অর্থাৎ সিগনিফায়ার ও সিগনিফিকেট এখানে অর্থ বিকেন্দ্রিক জ্ঞান বা কোনোটেশনের পদ বা সিগনিফায়ার হিসেবে কাজ করছে। এখানে কোনোটেশনে উদ্ভাসিত হয় নিপীড়ন ও কষ্টার্জিত বিজয়ের কথা, প্রকাশিত হয় শহীদদের আত্মত্যাগের কথা। এসব কথা দৃশ্যে লেখা নেই। কিন্তু দৃশ্যে যা আছে, সেটা ওসবকেই মনে করিয়ে দেয়। তাই মেৎজ বলছেন, নান্দনিক ভাষার সিগনিফায়ার হলো পূর্ববর্তী ভাষার (ঘটনা, বিষয়) সিগনিফায়ার ও সিগনিফিকেটের যোগফল। নান্দনিক ভাষার সিগনিফায়ারের সঙ্গে পূর্ববর্তী ভাষার সিগনিয়ার-সিগনিফিকেটের সম্পর্ক নিবিড়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, মেৎজ বলছেন, শব্দশিল্প বলি, বা দৃশ্যশিল্প বলি, দুটোই অবস্থিত চিহ্নের জমিনে। এক অর্থে তারা পরস্পরের প্রতিবেশী। তাই বলে দৃশ্যশিল্প বা চলচ্চিত্রকে শব্দশিল্পের সঙ্গে তুলনা টেনে তাকে ভাষা বলা যুক্তিসঙ্গত নয়। বরং বলা ভাল ভাষা যেখানে বাক্য দিয়ে শেষ হয়, সেখান থেকেই যেন দৃশ্য ধারণ শুরু হয়। ভাষার আবার দুটো দিক আছে- একটি কথ্য, অন্যটি লেখ্য। লেখ্য ভাষা একজন লেখককেই লিখতে হয়। ভাষার সমুদ্র থেকে শব্দ শিকার করে সাজাতে হয় সাহিত্যে বা বইতে। বই জীবন্ত কারও মতো সংলাপ আদানপ্রদান করে না। চলচ্চিত্র হচ্ছে বইয়ের মতো, মেৎজ বলছেন, চলচ্চিত্রকে সবসময় নির্মাণ করতে হয়, বইয়ের ভাষার মতোই। চলচ্চিত্র কোন একটি নির্দিষ্ট ভাষার সাহায্যে সরাসরি কথোপকথনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কারও সওয়ালের জবাব দিতে পারে না, তাই মেৎজের প্রস্তাব চলচ্চিত্র অর্থপ্রকাশ বা সিগনিফিকেশন নয়, চলচ্চিত্র হলো ভাবপ্রকাশ বা এক্সপ্রেশন। বইও তাই করে। সে জন্য মেৎজ বলেন, চলচ্চিত্রের সঙ্গে ভাষার নয়, সাহিত্যের সাদৃশ্য আছে। তবে এ কথা বলা বাহুল্য নয় যে, সাদৃশ্য থাকলেও দুটো একেবারেই ভিন্ন মাধ্যম। সাহিত্য থেকে চলচ্চিত্র যে ব্যাপক অর্থেই আলাদা বস্তু তা বোঝা যায় যখন কেউ সাহিত্যের চলচ্চিত্রায়ন করেন। সাহিত্যে কোন বস্তুর রূপ-রস-গন্ধের ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব হলেও, চলচ্চিত্রে তা পুরোপুরি আনা সম্ভব নয়। কবিতায় গোলাপের গন্ধের কথা বলা গেলেও, চলচ্চিত্রে গোলাপের গন্ধের কথা ক্যামেরার মাধ্যমে বলা সম্ভব নয়। সেটা বলতে হলে চলচ্চিত্রের ভাষা ব্যবহার করেই বলতে হবে- হয় সংলাপের মাধ্যমে, নয় তো অভিনয়ের মাধ্যমে। দুই. সাহিত্য বা উপন্যাসের মতো চলচ্চিত্রেও, বিশেষ করে কাহিনীচিত্রে কাহিনীর বিন্যাস করতে হয়, চরিত্র নির্মাণ করতে হয়, গল্পের পরিণতি নিয়ে ভাবতে হয় ইত্যাদি। দুই মাধ্যমেই জীবনকে ধরার ও প্রকাশের চেষ্টা করা হয়। এসব মিল সত্ত্বেও পার্থক্যটা যে বিশাল তা আগের আলোচনা থেকেই স্পষ্ট। দুই মাধ্যমের চিহ্নায়ন ও নির্মাণ পদ্ধতি একেবারেই আলাদা, আর একারণে দুই মাধ্যমের রয়েছে আলাদা ধরনের ক্ষমতা। চলচ্চিত্র প-িত জেমস মোনাকো বলছেন, সাহিত্যের বড় গুণ হলো আপনি সেটা পাঠ করে কল্পনা করতে পারেন, আর চলচ্চিত্রের বড় গুণ হলো সেখানে কল্পনা করা যায় না। চলচ্চিত্র সরাসরি বস্তুকে প্রকাশ করে। সাহিত্যের মতো চলচ্চিত্রেও দুই অক্ষের মাধ্যমে ভাব প্রকাশিত হয় : একটি হলো উলম্ব, অন্যটি আনুভূমিক। চিহ্নবিদ্যার ভাষায় উলম্ব রেখাকে বলা যায় পদপ্রকরণ/দৃশ্যপ্রকরণ/প্যারাডাইম (চধৎধফরমস), আর আনুভূমিক রেখাকে বলা যায় পদসংযোজন/দৃশ্যসংযোজন/সিনট্যাম (ঝুহঃধমস)। ধরা যাক, একটি শব্দ ‘জলযান’, সাহিত্যে ব্যবহারের আগে এই শব্দটির নির্দিষ্ট কোন কোনোটেশন নেই, আছে ডিনোটেশন। এই ‘জলযান’ শব্দটিতে নির্দিষ্ট কোনোটেশন যুক্ত করা যায় না, যতক্ষণ না পর্যন্ত এই শব্দ কোন সাহিত্যে বা প্রসঙ্গক্রমে লেখক ব্যবহার করেন। এখন একটি বাক্যে যখন ‘জলযান’ ব্যবহার করা হয় তখন তার একধরনের অর্থ বিকেন্দ্রিক বোধ তৈরি হয় পাঠকের মনে। কিন্তু যদি ‘জলযান’ শব্দের বদলে ‘স্টিমার’ শব্দটি ব্যবহার হয়? অথবা ‘ডিঙ্গি নৌকা’? তাহলে কি একই ধরনের অর্থ বিকেন্দ্রিক বোধ বা কোনোটেশন তৈরি হবে? হবে না। এই ধরনের কোনোটেশনকে, জেমস মোনাকো বলছেন, ডাকা যায় প্যারাডিগম্যাটিক কোনোটেশন (Paradigmatic connotation) বা পদপ্রকরণজাত অর্থ বিকেন্দ্রিক বোধ। একইভাবে চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে যদি একটি জলযানকে দেখাতে চাই, তাহলে নির্দিষ্ট করে হয় একটি নৌকা, নয় তো একটি জাহাজকেই দেখাতে হবে। সেখানে ক্যামেরা কোণ কেমন হবে সেটার উপর নির্ভর করছে অর্থপ্রকাশ। ক্যামেরার কোণ যদি হয় ওপর থেকে, টপ শট, তাহলে বুঝতে হবে জলযানটি কোন কারণে অবদমিত বা চাপের মধ্যে আছে। আবার লো এ্যাঙ্গেল শট বা ক্যামেরার কোণ নিচ থেকে হলে বুঝতে হবে জলযানটিতে এক ধরনের মাহাত্ম্য যোগ করা হচ্ছে। মনে করে দেখুন আইজেনস্টাইনের ‘ব্যাটলশিপ পোটেমকিন’ ছবিটির কথা। সেখানে বহুবার জাহাজকে দেখানো হয়েছে লো এ্যাঙ্গেল থেকে। জাহাজ তথা জাহাজে অবস্থিত বিদ্রোহী নাবিকদের মহৎ করে তোলাই ছিল ওই ধরনের শটের উদ্দেশ্য। এই যে একটি বস্তুকে কিভাবে দেখানো হবে, কোন অর্থ আরোপ করা হবে, সেটাকে বলতে পারেন দৃশ্যপ্রকরণজাত অর্থ বিকেন্দ্রিক বোধ বা প্যারাডিগম্যাটিক কোনোটেশন। এতক্ষণ আলাপ হলো উলম্ব রেখা নিয়ে। এবার আসা যাক আনুভূমিক রেখার আলাপে। সাহিত্যে একটি শব্দ কোন শব্দের পর ও কোন শব্দের আগে বসছে তার ওপর নির্ভর করে অর্থ আদতে কি দাঁড়াবে। জীবনানন্দ যখন ‘সুচেতনা’ কবিতায় বলেন, ‘কেবলি জাহাজ এসে আমাদের বন্দরের রোদে/দেখেছি ফসল নিয়ে উপনীত হয়;’ তখন এই জাহাজের এক রকম মানে হয়। আবার পুর্ণেন্দু পত্রী যখন ‘বিষণ্ণ জাহাজ’ কবিতায় উচ্চারণ করেন, ‘আমাদের যাবজ্জীবন সুখের ভিতরে/একটু একটু করে ঢুকে পড়ছে সেই বিষণ্ণ জাহাজ/তার সেই ভয়ঙ্কর আর্তনাদ বাজিয়ে।’ তখন কিন্তু জাহাজ সম্পর্কিত আমাদের কোনোটেশন ভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। একেই বলা হচ্ছে পদসংযোজনজাত অর্থ বিকেন্দ্রিক বোধ বা সিনট্যাগমেটিক কোনোটেশন (Syntagmatic connotation)। চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে একে বাংলায় বলা যায় দৃশ্যসংযোজনজাত অর্থ বিকেন্দ্রিক বোধ। চলচ্চিত্রে দৃশ্যমালার ভেতর জাহাজ কোথায় থাকবে, আইজেনস্টাইন হলে বলতেন জাক্সটাপোজ (Juxtapose) হবে, কোন ক্রমে দৃশ্য সাজানো হবে, বা সম্পাদিত হবে, সেটার ওপর নির্ভর করবে দর্শকের সিনট্যাগমেটিক কোনোটেশন কি হবে, কেমন হবেÑ জাহাজ যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে, যুদ্ধ করছে, না যুদ্ধে পরাজিত হয়েছে, না হচ্ছে, অথবা জয় ছিনিয়ে আনছে- সেগুলো নির্ধারিত হবে দৃশ্যমালার সজ্জা দিয়েই। সুতরাং, কাঠামোর দিক থেকে দেখা যাচ্ছে এই জায়গাটায় সাহিত্য ও চলচ্চিত্রে মিল আছে: দুটোরই দুটি অক্ষ রয়েছে, যদিও অর্থ তৈরি ও প্রকাশে তাদের ধরন-ধারণ একেবারেই আলাদা। কি শূট করা হবে সেটা চূড়ান্ত করার পর, উলম্ব রেখায় চলচ্চিত্র নির্মাতা চিন্তা করেন কিভাবে শূট করবেন, আর সাহিত্যে লেখক ভাবেন কোন শব্দ দিয়ে বলবেন। এটাকে মোনাকো বলছেন প্যারাডিগম্যাটিক চয়েজ (Paradigmatic choice)। আর আনুভূমিক রেখায় নির্মাতা যখন ভাবেন দৃশ্যকে কোথায়, কিভাবে উপস্থাপন ও সম্পাদনা করবেন- সেটাই সিনট্যাগমেটিক চয়েজ (Syntagmatic choice) সাহিত্যের বেলাতেও লেখক এই অক্ষে ভাবেন- যে কথাটি বলা হলো, সেটি কিভাবে উপস্থাপন করবেন, এর আগে ও পরে কোন্ কথাটি বলবেন। আমার প্রস্তাবে চলচ্চিত্রে উলম্ব রেখায় সক্রিয় থাকে মিজ-অঁ-সেন, আর আনুভূমিক রেখায় সক্রিয় থাকে মন্তাজ। উলম্ব রেখায় থাকে ‘স্থান’, আনুভূমিক রেখায় থাকে ‘সময়’। অতএব আমরা বলতেই পারি, চলচ্চিত্র যখন স্থান নিয়ে কাজ করে, একটি শটে থাকে, তখন প্যারাডিগম্যাটিক কোনোটেশন কাজ করে। আবার যখন সময় নিয়ে কাজ করে, তখন সিনট্যাগমেটিক কোনোটেশন কাজ করে। এভাবে দুই ধরনের কোনোটেশনের ভেতর দিয়েই ভাব ও বোধের গ্রহণ-বর্জন চলে। উপন্যাসেও স্থান ও সময় থাকে, থাকে আরও বহুকিছু, কিন্তু সেগুলো কি পুরোপুরি চলচ্চিত্রে রূপান্তর সম্ভব? ফরাসী নন্দনতাত্ত্বিক এতিয়েন সুরিয়ো কিন্তু বলছেন সম্ভব নয়। আসলেই কি সম্ভব নয়? আসুন দেখি এ ব্যাপারে জর্মন চলচ্চিত্র প-িত সিগফ্রিড ক্রাকোয়ার কি বলেছেন। তিন. ‘থিয়োরি অব ফিল্ম’ (১৯৬০) বইতে এতিয়েনের যুক্তি তুলে ধরেন সিগফ্রিড। ১৯৫২ সালে প্রকাশিত ‘চলচ্চিত্রবিদ্যা ও তুলনামূলক নন্দনতত্ত্ব’ (ঋরষসড়ষড়মরব বঃ বংঃযল্কঃরয়ঁব পড়সঢ়ধৎব) নামের এক প্রবন্ধে এতিয়েন বলেন উপন্যাসে চার ধরনের কাঠামোগত বৈশিষ্ট্য থাকে। আর এই চারটি বৈশিষ্ট্যই কঠিনভাবে বাধা প্রদান করে সাহিত্যের চলচ্চিত্রায়নে। চারটি বৈশিষ্ট্য হলো : ১. সময় (Time) ২. লয় (Tempo) ৩. স্থান (Space) ৪. দৃষ্টিকোণ (Point de vue) সিগফ্রিড প্রথম ও চতুর্থ বৈশিষ্ট্য নিয়ে মন্তব্য করেছেন, যেহেতু এতিয়েন নিজে ওই দুই বিষয়ের ওপরই গুরুত্বারোপ করেছেন। সিগফ্রিড নিজের বইতে এতিয়েনের যুক্তি খ-ন করেছেন। এতিয়েন মনে করতেন উপন্যাসে সময়কে যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, চলচ্চিত্রে তা সেভাবে করা সম্ভব নয়। তা ছাড়া চলচ্চিত্রের ‘ফ্ল্যাশব্যাক’ কৌশলকে ‘বেখাপ্পা’ (ঈষঁসংু ফবারপব) বলে উল্লেখ করেন এতিয়েন। বোঝা যাচ্ছে, ফ্ল্যাশব্যাক কৌশলকে বিশেষ পছন্দ করেননি এতিয়েন। তবে এতিয়েনের দৃষ্টিভঙ্গিকে চ্যালেঞ্জ করে সিগফ্রিড উদাহরণ টানেন সত্যজিতের ‘পথের পাঁচালী’, কুরোসাওয়ার ‘রশোমন’ ও বারিমানের ‘ওয়াইল্ড স্ট্রবেরিজ’ ছবি তিনটির। তিনটি ছবিতে সময়কে কখনো সাজানো হয়েছে সরল বয়ানে, কখনও দর্শককে বার বার পেছনে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, কখনও আবার স্মৃতি ও স্বপ্নের হানায় সময়কে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে দক্ষতার সঙ্গে। চতুর্থ বৈশিষ্ট্য দৃষ্টিকোণের ব্যাপারে এতিয়েনের বক্তব্য ছিল উপন্যাসে লেখক যেভাবে একটি চরিত্রের ভেতর নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে, নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে পাঠককে গল্প শোনাতে পারে, সে রকমটি চলচ্চিত্রে সম্ভব নয়। এখানেও এতিয়েন চলচ্চিত্রের ক্ষমতাকে ছোট করে দেখেছেন বলে মন্তব্য করেন সিগফ্রিড। তিনি বলেন, উপন্যাসের মতো হয় তো ওরকম স্বাধীনতা চলচ্চিত্রকার ভোগ করতে পারেন না, তবে কোন চরিত্রের দৃষ্টিকোণকে প্রাধান্য দিতে সেই চরিত্রের দৃষ্টি প্রতিস্থাপন করতে পারেন ক্যামেরার চোখ দিয়ে। তা ছাড়া ‘রশোমন’ ছবিতে একেক জনের দৃষ্টিভঙ্গিতে যে একই ঘটনাকে দেখানো হয়েছে, সেটা তো চালচ্চৈত্রিক গুণেই বোধগম্য হয়েছে দর্শকের কাছে। কাজেই সাহিত্যের চলচ্চিত্রায়ন সম্ভব নয়, এবং এই অসম্ভবে উল্লিখিত চার বৈশিষ্ট্যই মূল বাধাদানকারীÑএই যুক্তি ঠিক নয়। ভাবনাটি খারিজ করে সিগফ্রিড বলেন, সাহিত্য ও চলচ্চিত্র মূলত দুই জগতের ব্যাপার। যে দুই জগতে দুই ধরনের প্রক্রিয়া জারি থাকে। সাহিত্যের দুনিয়ায় প্রধানত জারি থাকে মানসিক অন্বয় (Mental continuum), আর চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে, ক্যামেরা যেহেতু বাস্তবকে ধারণ করে, তাই সেখানে জারি থাকে বস্তুগত অন্বয় (Material continuum)। এখন মানসিক অন্বয় থেকে বস্তুগত অন্বয়ে রূপান্তর সম্ভব, সিগফ্রিড বলছেন দুই ভাবে এই রূপান্তর হতে পারে। সিগফ্রিডের প্রস্তাবে সাহিত্য থেকে এডাপট্যাশন বা অভিযোজন করা হয় দুই প্রক্রিয়ায় : ১. চালচ্চৈত্রিক অভিযোজন (Cinematic adaptations) ২. অ-চালচ্চৈত্রিক অভিযোজন (Uncinematic adaptations)। চালচ্চৈত্রিক অভিযোজনের ক্ষেত্রে একজন নির্মাতা পুরোপুরি বিশ্বস্ত থাকেন সাহিত্যের প্রতি। যেমন জন স্টেইনবেকের উপন্যাস ‘দ্য গ্রেপস অব র‌্যাথ’ থেকে জন ফোর্ড একই নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। জন ফোর্ড চলচ্চিত্রের প্রতি সৎ থেকে উপন্যাসকেই মোটামুটি অনুসরণ করেছেন। নিজে থেকে কিছু যোগ বা বিয়োগ করেননি। অপরদিকে অ-চালচ্চৈত্রিক অভিযোজনের উদাহরণে সিগফ্রিড বলেন, গুস্তাফ ফ্লুবারের উপন্যাস ‘মাদাম বোভারি’ থেকে জঁ রেনোয়ার তৈরি করা ছবির কথা। সেখানে রেনোয়া মূল উপন্যাসের কঙ্কালটাই শুধু রেখেছেন। তিনি বিশ্বস্তভাবে অনুসরণ করেননি ফ্লুবারকে। এখন সাহিত্যের অভিযোজন নানাভাবে ও নানা মাত্রাতেই হতে পারে চলচ্চিত্রে। উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়ন কিভাবে হবে আর সেটা কতটুকুইবা মূল বক্তব্যকে প্রকাশ করবে তা নির্ভর করে নির্মাতার মুন্সিয়ানার উপর। তবে এতটুকু অন্তত বলা যায় চলচ্চিত্রে শুরুর দিকে যে অন্ধ অনুকরণ হতো উপন্যাসের, বা রবীন্দ্রনাথের ভাষায় যে ‘চাটুবৃত্তি’ চোখে পড়তো তা কিন্তু এখন একেবারেই নেই। চলচ্চিত্র স্বতন্ত্র শিল্প হিসেবে এতোটাই শক্তি অর্জন করেছে যে এটি কখনো কখনো উপন্যাস বা অন্য শিল্প মাধ্যমকেও ছাড়িয়ে যায়। এর প্রধান কারণ চলচ্চিত্র দেখার জন্যÑ সাহিত্য পড়ার যেমন পূর্বশর্ত অক্ষরজ্ঞানÑ তেমন কোন জ্ঞান অর্জন করে নিতে হয় না। উপন্যাস পড়ার জন্য যেমন শব্দ ভা-ার থাকা দরকার হয়, তেমনি কোনো দৃশ্য ভা-ার থাকার প্রয়োজন হয় না চলচ্চিত্র দেখার ক্ষেত্রে। একজন অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষও চলচ্চিত্র দেখে বুঝতে পারেন। চার. চলচ্চিত্রের যেমন ঋণ রয়েছে উপন্যাস, মঞ্চনাটক অথবা কবিতার কাছে, তেমনি বর্তমান সাহিত্যও ঋণি হয়ে পড়ছে চলচ্চিত্রের কাছে। এর কারণ ইদানীং অনেক উপন্যাস, গল্প বা মঞ্চনাটকের বয়ান তৈরি হচ্ছে চলচ্চিত্রের আদলে। চলচ্চিত্রে যেমন করে মন্তাজ তত্ত্ব ব্যবহার হয়, তেমন করে দৃশ্যাবলী রচনা করা যায় সাহিত্যেও। আজকাল তো জনপ্রিয় চলচ্চিত্র থেকে গ্রাফিক নভেল আঁকা ও লেখা হচ্ছে হরদম। তুলনামূলকভাবে নবীন এই শিল্প পূর্বের সকল শিল্প থেকেই গ্রহণ করেছে। সাহিত্য ও মঞ্চনাটক থেকে নিয়েছে বয়ানের কৌশল ও সংলাপ, এমনকি মঞ্চে দর্শকদের সঙ্গে অভিনয়শিল্পীদের যোগাযোগ রীতিটাও (যেমন মঞ্চনাটকে চতুর্থ দেয়াল ভেঙ্গে দিয়েছেন ব্রেখট) গ্রহণ করেছে চলচ্চিত্র। এমন করে পেইন্টিং থেকে রঙের খেলা, ফটোগ্রাফি থেকে ফ্রেম ও আলো-আঁধারী নানা কিছু চলচ্চিত্র গ্রহণ করেছে বিনা দ্বিধায়। আর এটা সম্ভব হয়েছে চলচ্চিত্র মাধ্যমটির ধরনের কারণেই। এই মাধ্যমটি এখন বইয়ের মতোই সকলের হাতে হাতে বহনযোগ্য। ট্যাব বা স্মার্টফোনেই আজকাল অনেকে চলচ্চিত্র দেখে থাকেন। আগে ট্রেনে বা বাসে মানুষ যেমন করে উপন্যাসের বই পড়ত, এখন ঠিক সেভাবেই বেশ সহজে চলচ্চিত্র উপভোগের সুযোগ রয়েছে। ফরাসী তাত্ত্বিক আলেকজান্দার আসট্রুক যেমনটা বলেছিলেন ‘দ্য বার্থ অব নিউ আভাঁগার্দ : লা ক্যামেরা স্তিলো’ প্রবন্ধে, মানুষ একদিন পাঠাগারে গিয়ে বই খোঁজার মতো করে নানা স্বাদের চলচ্চিত্র খুঁজবে, ঠিক সেটাই এখন ঘটছে। আমি বলব অনলাইনই এখন হয়ে উঠেছে চলচ্চিত্রের ‘পাঠাগার’। মানুষ সেখানে গিয়ে নানা স্বাদের চলচ্চিত্র খোঁজে। তবে সে জন্য মানুষ প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে চলচ্চিত্র দেখা বন্ধ করবে না, কমবে হয় তো, তার পরও ই-বুকের যুগে কাগজের বইয়ের আবেদন যেমন এখনও আছে, ঠিক তেমনি অনলাইনে বিনামূল্যে ছবি দেখার যুগে, বড় পর্দায় ছবি দেখার আবেদনও থাকবে। মানুষ নানাভাবেই আমোদিত হতে চায়, বিনোদন পেতে চায়। সেটা হোক ই-বুক, কাগজের বই, ট্যাবের চলচ্চিত্র বা বড় পর্দার চলচ্চিত্র, মানুষের সবটাই চাই। সব কিছু থেকেই মানুষ বিনোদন নেবে, সকল মাধ্যমেই মানুষ সংস্কৃতি ও শিল্পচর্চা অব্যাহত রাখবে। কারণ মানুষ শুধু সাহিত্যে বাঁচে না, আবার শুদ্ধ চলচ্চিত্রেও নয়। পুঁজি ১. পবিত্র সরকার, সাহিত্য ও চলচ্চিত্র, নির্মাল্য আচার্য ও দিব্যেন্দু পালিত সম্পাদিত, শতবর্ষে চলচ্চিত্র (প্রথম খ-) : অনুভব ও অভিজ্ঞতা, আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৯৬, কলকাতা। ২. Christian Metz, Film Language: A semiotics of the cinema, Translated by Michael Taylor, Oxford University Press, 1974, New York. ৩. Siegfried Kracauer, Theory of Film: The redemption of physical reality, Oxford University Press, 1973, New York. ৪. James Monaco, How to read a film: movies media and beyond, Oxford University Press, 2009, New York. ৫. Alexandre Astruc, The birth of a new Avant-Garde: La Caméra-Stylo (1948), The French New Wave: Critical Landmarks, edited by Peter Graham with Ginette Vincendeau, A BFI book published by Palgrave Macmillan, 2009, London.
×