ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

প্রকাশিত: ০৬:০১, ২৬ অক্টোবর ২০১৮

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

মোরসালিন মিজান ॥ মধ্যরাত। ঢাকার রাস্তা। সিএনজি অটোরিক্সায় একজন নারী যাত্রী। এই যাত্রী নির্বিঘেœ তার গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে। আজকের বাংলাদেশের কাছে এটা খুব স্বাভাবিক প্রত্যাশা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাজটিও খুব পরিষ্কার। একলা নারী যাত্রীটির নিরাপত্তা সবার আগে নিশ্চিত করবেন তারা। রাস্তার মোড়ে মোড়ে গভীর রাত পর্যন্ত তাদের যে দাঁড়িয়ে থাকা, এই একটি মাত্র কারণে। কিন্তু তারা কি সেটা উপলব্ধি করেন? উত্তর পাওয়া যাচ্ছে প্রতি মুহূর্তেই। সোমবার রাতের ঘটনাটি আরও বেশি উদ্বেগজনক। বিবেকবান মানুষদের একেবারে হতবাক করে দিয়েছে। এদিন রাতের রাস্তার ভীতিকর একটি ছবি দেখতে পেল ঢাকাবাসী। কয়েকজন পুলিশ সদস্য তাদের দায়িত্ব ভুলে তো গেলেনই, সেইসঙ্গে চাকরির বিপরীত ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। তাদের কা- দেখে সাধারণ বিদ্যা বুদ্ধির মানুষ যারপরনাই লজ্জা পেয়েছেন। নারী যাত্রীকে থামিয়ে তারা, কী আশ্চর্য, জানতে চাইলেন, নারী হয়ে এত রাতে বাইরে কেন আপনি? পুলিশের চৌকিতে তল্লাশি হতেই পারে। কিন্তু তল্লাশিতে কারও মন নেই। আদিম মানসিকতা নিয়ে তারা নারী মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। যাত্রীর ব্যাগে ডজন ডজন বোমা আছে? যদি তাই মনে করেন, পরীক্ষা করে দেখুন। নারী যাত্রী নিজেই ব্যাগ পরীক্ষা করার আহ্বান জানাচ্ছিলেন। তিনি অন্যায়টা কী করেছেন? পুলিশের কাছে জানতে চাইছিলেন। পুলিশ সদস্যরা সেদিকে গেলেনই না। একলা নারী। এত রাতে রাস্তায় একা। সুতরাং ভাল কেউ নন। হতেই পারে না। যেন স্থির সিদ্ধান্ত নিয়েই তারা আক্রমণ শুরু করলেন। নারী যাত্রীর মুখে টর্চ ধরলেন। ধরেই রাখলেন। একের পর এক উদ্ভট অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন। পাড়ার বখাটেদের মতো দুর্গন্ধযুক্ত মন্তব্য। সবই করলেন পুলিশের উর্দি পরা কিছু লোক। এবং তারা তা মোবাইল ফোনে ভিডিও করলেন। ছড়িয়ে দিলেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ভাবা যায়? ওই পুলিশ সদস্যদের চিন্তা এত উর্বর যে, অন্যায় করার পরও তারা মনে করলেন সবাই তাদের বাহবা দেবে। কিন্তু তা হলো না। ভিডিও দেখে রুখে দাঁড়ালো মানুষ। প্রতিবাদের ঝড় বয়ে গেল ফেসবুকে। সচেতন নাগরিকরা বলছেন, ভিডিও দেখে মনে হয়েছে নারীটিকে হেনস্তা করাই ছিল পুলিশ সদস্যদের মূল উদ্দেশ্য। আইনের লোক হয়েও তারা জানেন না, কোনটি আইন। কী করলে পরে আইন ভঙ্গ হয় সে সম্পর্কেও তারা অবগত নন বলে মনে হয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, পুলিশের সদস্যরা নানা অপরাধ নিয়ে সব সময় কাজ করেন। এর ফলে তাদের অনেকেই সাধারণ মানুষের সেন্স থেকে অনেক দূরে চলে যান। স্বাভাবিক চিন্তা করতে পারেন না। এর ফলেও কিছু ঘটনা ঘটছে বলে ফেসবুকে মত দিয়েছেন অনেকে। তিন বছর আগের একটি গবেষণা প্রতিবেদনেও চোখ বুলানো যায়। বেসরকারী সংস্থা এ্যাকশনএইড ‘নিরাপদ নগরী নির্ভয়ে নারী’ শিরোনামে এই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে দেখা যায়, জরিপে অংশগ্রহণকারী ৯৫ শতাংশ নারী মনে করেন, পুলিশি সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে হেনস্তার শিকার হতে হয় তাদের। কিন্তু অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা তেমন শোনা যায় না। এবার অন্যথা হয়েছে। আশার কথা এই যে, সাধারণের প্রতিবাদ আমলে নিয়েছেন পুলিশের উর্ধতনরা। কর্তৃপক্ষ দ্রুতই দোষী পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে প্রাথমিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। এর মধ্য দিয়ে তারা ঢাকাবাসীকে, বিশেষ করে নিজের পায়ে ভর দিয়ে চলা নারীদের সুন্দর একটি বার্তা দিতে পেরেছেন। আস্থা ধরে রাখতে পেরেছেন সাধারণ মানুষের। তবে সবচেয়ে প্রশংসা হচ্ছে সাহসী প্রতিবাদী সেই নারীর। কয়েকজন পুলিশ সদস্যের উপর্যুপরি আক্রমণের মুখেও নিজেকে অসহায় মনে করেননি তিনি। বরং জোরালো প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছেন। এই প্রতিবাদকে নারীর জেগে ওঠার প্রমাণ বলেই মনে করছেন সবাই। অবশ্য প্রতিবাদ অব্যাহত রাখাটাও জরুরী। কারণ সিএনজি অটোরিক্সায় একদিন বা দুইদিন এমন ঘটনা ঘটলেও, গণপরিবহনে প্রায় প্রতিদিনই নারী হেনস্তার ঘটনা ঘটছে। ভিড় ঠেলে বাসে উঠতে বাধ্য হচ্ছেন কর্মজীবী নারীরা। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া মেয়েরা আসা যাওয়া করছে। আর তখন ইতর পুরুষদের দ্বারা, বাসের হেলপারদের দ্বারা তারা আক্রান্ত হচ্ছেন। এমন ঘটনা প্রায়শই সামনে আসছে। এ অবস্থায় সব মহলের সজাগ দৃষ্টি, অব্যাহত প্রতিবাদ জরুরী বলেই মনে করা হচ্ছে। এদিকে নারী সাংবাদিকের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন ও আপত্তিকর মন্তব্য করে ভালই ফেঁসেছেন ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন। এই ভদ্রলোকের কত যে রূপ! একেকসময় একেক রূপে সামনে আসেন। এবার তিনি ‘ঐক্যফ্রন্ট’ হয়ে এসেছিলেন। আসতে না আসতেই আরেক অপকর্মে কুপোকাত। টেলিভিশন টকশোতে সাংবাদিক কলামিস্ট মাসুদা ভাট্টিকে তিনি কুৎসিত ভাষায় ব্যক্তিগত আক্রমণ করেছিলেন। নারী হিসেবে বিবেচনা করেই তাকে অমন বাজে ভাষায় আক্রমণ করেন মঈনুল। এরপর থেকেই প্রতিবাদ। তীব্র সমালোচনা। গত সপ্তাহের প্রায় প্রতিদিনই অভিযুক্ত ব্যারিস্টারের বিচার দাবিতে কোন না কোন কর্মসূচী পালিত হয়েছে। কাজও হয়েছে তাতে। এখন জেলে আছেন এই নারী বিদ্বেষী। অন্য প্রসঙ্গ। রাজধানীতে যাত্রা শুরু করল বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট। বিশ্বের সর্ববৃহৎ ৫০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হলো বুধবার। উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ইনস্টিটিউটের নামকরণও করা হয়েছে শেখ হাসিনার নামে। ১৮ তলা বিশিষ্ট ভবনে আগুনে পোড়াসহ বিভিন্নভাবে দগ্ধদের চিকিৎসা করা হবে। বাড়বে চিকিৎসা সেবার মানও। বিশ্বের সর্বাধুনিক যন্ত্রপাতিসহ উন্নততর চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকবে এই বার্ন ইনস্টিটিউটে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল সংলগ্ন চাঁনখারপুলে নির্মিত ইনস্টিটিউট বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান করবে। এর ফলে সাধারণ দরিদ্র রোগীরা বিশেষ উপকৃত হবেন, যা অন্য অনেক দেশে চিন্তাও করা যায় না।
×